পাসওয়ার্ড

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:১৫

ফরিদা বেগমের অস্থির লাগছে, ভীষণ অস্থির। কি দিয়ে কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কিছুক্ষণ ব্যালকনীতে বসে রইলেন। উঠে ডাইনিংয়ে গেলেন, পানি খেলেন। ড্রইং রুমে বসলেন কিছুক্ষণ, আবার উঠলেন। বেডরুমে গেলেন মকবুল হোসেন কী করেন দেখার জন্য। নাহ্, মকবুল হোসেন বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর রুটিন ঘুম। রিটায়ার করার পর এই নিয়মই চলছে। অবশ্য জেগে থাকলেও যে ফরিদা বেগমের খুব উপকার হতো তাও না। মকবুল হোসেন এমনিতেই রাশভারী স্বল্পভাষী মানুষ। রিটায়ার করার পর কথা আরো কমিয়ে দিয়েছেন। অপ্রয়োজনীয় কথা উনার একদম পছন্দ নয়। 

বেডরুমের দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফরিদা বেগমের মনটা আরো খারাপ হলো। মানুষটা একটু বেশি কথা বললে, একটু আমুদে হলে কী এমন ক্ষতি হতো? সারাটা জীবন এক ধরণের নিঃসঙ্গতা বোধ নিয়েই কাটিয়ে দিলেন। মুখ ফুটে কখনো সে কথা বলা হয়নি কাউকে। ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর সেটা যেনো আরো জেঁকে বসেছে ফরিদা বেগমের উপর। 

ফরিদা বেগমের বয়স কত হবে? পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন, কিছুটা কম বেশিও হতে পারে। কিন্তু দেখতে কোনভাবেই চল্লিশের বেশি মনে হয় না। বেশ হাসিখুশি সজ্জন মানুষ। চেহারায় বার্ধক্য এখনো সুবিধা করতে পারেনি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছেলেটাও পাশ করে সবে একটি ব্যাংকে ঢুকেছে। 

ধানমন্ডির যে ফ্ল্যাটটিতে ফরিদা বেগম ভাড়া থাকেন তাতে তিনটি বেডরুম। ড্রইং, ডাইনিং মিলিয়ে মোটামুটি বাসাটা বড়ই। সারাদিন বাসায় একলা থাকেন। ঠিক একা বলা যায় না, মকবুল হোসেনও মোটামুটি বাড়িতেই থাকেন। শুধু বিকেল হলে এক ঘন্টার জন্য হাঁটতে বের হন, ডাক্তারের নির্দেশ। এর বাইরে পত্রিকা পড়ে আর শুয়েবসেই দিন কাটান। মাঝে মাঝে টক শো দেখেন। ব্যাস, এটাই প্রতিদিনের রুটিন। কোথাও যেতে চান না। মানুষের কোলাহল উনার ভাল লাগে না। শুধু নাতনী প্রিয়ন্তি এলে কোন নিয়ম খাটে না। প্রিয়ন্তির জন্য মকবুল হোসেনের কাছে কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। নানার সাথে প্রিয়ন্তির দারুণ বন্ধুত্ব।

মকবুল হোসেনের বয়স, ধরা যাক, সত্তরের মতো। ফরিদা বেগমের যখন বিয়ে হয় তখন মকবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত সরকারী কর্মকর্তা। বোনদের বিয়ে দিয়ে, ভাইদের মানুষ করে নিজে বিয়ের পিড়িতে বসতে তার কিছুটা দেরীই হয়ে গিয়েছিলো। ফরিদা বেগম তখন ষোড়শী, সবে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হই হই করছেন। দুজনের বয়সের পার্থক্যটা তাই একটু বেশিই। যদিও বয়সের ব্যবধান কখনো সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি, কিন্তু কেমন যেন ঠিক আবার জমেওনি। সেটা কতটা বয়সের কারণে আর কতটা মকবুল হোসেনের বৈশিষ্ট্যের কারণে বলা মুশকিল।

বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই ফরিদা বেগমের কোল জুড়ে আসে মেয়ে পিংকি এবং তার পর পরই ছেলে রাশেদ। দেরীতে বিয়ে বলে মকবুল হোসেনের তাড়া ছিলো, তাড়া ছিলো শ্বশুরবাড়ীরও। বিশেষ করে শাশুড়ীর। বয়স হয়েছে ওনার, নাতী-নাতনীর মুখ দেখে যেতে চান মরার আগে। ফলে সংসার জিনিসটা ভালো করে বোঝার আগেই মাতৃত্বের দায়িত্ব বুঝতে হয়েছিলো ফরিদা বেগমকে। 

ফরিদা বেগমের আর পড়া হয়নি। ছেলে মেয়ে মানুষ করতে করতে কোন ফাঁকে দিন গড়িয়ে বছর চলে গেছে তিনি টেরই পাননি। এখন ছেলে মেয়েরা বড় হবার পর তার অখন্ড অবসর। মকবুল হোসেনের দেখভাল করে আর সংসারের টুকিটাকি কাজ করার পর উনার তেমন আর কিছু করার থাকে না। আত্মীয় স্বজনকে মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই কথা আর এগুতে চায় না। তাই ইদানীং ফোন করাও কমিয়ে দিয়েছেন। ফরিদা বেগমের অকারণ গল্প করতে চাওয়ার চেষ্টায় মকবুল হোসেন কখনো সাড়া দেন না। ফরিদা বেগম কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। 

তাকে এই অসীম নিঃসঙ্গতা থেকে উদ্ধার করতে ছেলে রাশেদ একটি স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে। শুধু কিনে দিয়েই ক্ষ্নান্ত হয়নি, একটি ফেসবুক একাউন্টও খুলে দিয়েছে। বলেছে, “মা, ফেসবুক একটা দারুণ বিষয়। এবার দেখবে, তোমার সময় কোন দিক দিয়ে কেটে যাবে টেরই পাবে না”। ফরিদা বেগম প্রথমে বিরক্তই হয়েছেন, “দুর, এইসব ছাইপাশের আমি কী বুঝি? আমার এসবের দরকার নেই বাবা। তার চেয়ে বরং তুই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরিস। আমরা মা ছেলে মিলে গল্প করবো, আমার তাতেই হবে”।

রাশেদ দীর্ঘশ্বাস গোপন করেছে। মাকে কী করে বোঝাবে যে সেটা কখনই সম্ভব নয়। মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছে, “তাড়াতাড়িই ফিরবো মা, তুমি একদম চিন্তা করো না”। কিন্তু মনে মনে জানে তার তাড়াতাড়ি ফেরা হবে না। ব্যাংকারদের তাড়াতাড়ি ফেরার সুযোগ নেই। মায়ের নিঃসঙ্গতা রাশেদের খারাপ লাগে। সে মনোযোগ দিয়ে মাকে ফেসবুক ব্যবহারের খুঁটিনাটি শিখিয়ে দিতে চেষ্টা করে। যতটুকু পারা যায়।
প্রথম প্রথম ঝামেলা মনে হলেও ফরিদা বেগম ধীরে ধীরে ফেসবুকে আসক্ত হতে থাকেন। ছেলে মেয়ের ছবি দেখেন, লাইক দেন। ধীরে ধীরে তার বন্ধু সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আত্মীয় স্বজনরা তালিকায় যুক্ত হয়। খুঁজে পান কিছু পুরনো বন্ধুকেও। তার মজাই লাগে। খুঁজে খুঁজে পুরনো ছবি আপলোড করেন, নিজের, বাচ্চাদের। তার পুরনো ছবি দেখে ভাইবোনের ছেলেমেয়েরা, মেয়ের বান্ধবীরা যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, “ইশ আন্টি, কী সুন্দর ছিলেন আপনি!” ফরিদা বেগমের এসব প্রশংসা শুনে ভালো লাগে। খুঁজে খুঁজে আরো ছবি দেন। ভাবেন, যাক্, ছবিগুলো এতোদিনে কাজে লাগলো। কখনো কখনো অপরিচিত মানুষের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পান। এরা কেন তাকে রিকোয়েস্ট পাঠায় তিনি বুঝতে পারেন না যদিও। 

একদিন রাশেদকে আইডিগুলো দেখান, “দেখতো বাবা, ইনারা কারা। আমিতো চিনি না। তোদের পরিচিত কেউ মনে হয়”। রাশেদ দেখে হেসে ফেলে, “মা, তোমার পুরনো ছবি দেখে এরা হয়তো তোমাকে তরুণী ভেবেছে। সব মাথামোটার দল। তোমার প্রোফাইলটা একটু ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারতো আসল বিষয়টা। কিন্তু এদের এতো ধৈর্য থাকলে তো। আর বেশিরভাগই ফেইক আইডি, মানে আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখে। তাতে বদমাইশী করতে সুবিধা হয়। কেউ চিনতে পারে না। দেখো না কিসব অদ্ভুত নাম। ব্যর্থ জীবন, নীল আকাশ, এগুলো কারো নাম হয় নাকি। ওগুলো ডিলিট করে দাও। দাঁড়াও আমি করে দিচ্ছি”।

রাশেদ সবগুলো ডিলিট করে দেয়। কিন্তু তাতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসা বন্ধ হয় না। নতুন নতুন আইডি থেকে রিকোয়েস্ট আসতে থাকে। ফরিদা বেগমের কৌতুহল হয় এবং কয়েকটা উনি এক্সেপ্টও করে ফেলেন। ঝামেলার শুরু সেখান থেকেই। রাশেদকে এসব জানানো হয়নি। কেন জানাননি সেটাও উনার কাছে স্পষ্ট না। জানালে রাশেদ নিশ্চই কিছু মনে করতো না। তবুও বলা হয়নি। এখন রাশেদের কাছ থেকে সাহায্য চাইবেন কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছেন না। ফরিদা বেগম বেশ একটা বেকায়দায় পড়েছেন, তাও আবার ফেসবুক নিয়ে। অস্থিরতার কারণও এটাই।

ফরিদা বেগমকে ট্যাগকরে সেই ফেইক আইডির একজন একটি যুগল ছবি পোস্ট করেছে। সাথে আবার কয়েক লাইন রোমান্টিক কবিতা। আর উনি সেটা ডিলিট করতে গিয়ে শেয়ার করে ফেলেছেন। এখন টাইমলাইনে একই ছবি পরপর দুইবার কালের সাক্ষীর মতো জ্বলজ্বল করছে। ছবিটা স্টুডিওতে তোলা, বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো। কোন কোন জায়গায় আবার রং চটে গেছে। ছবিটা ফরিদা বেগমেরই কিনা ঠিক বোঝা যায় না যদিও, কিন্তু সেটা উনারই একটা পুরনো ছবি, বিয়ের আগের। এখন এই বিপদ থেকে বের হওয়ার উপায় উনার জানা নেই।

ফরিদা বেগমের হঠা‌তই পাশের ফ্ল্যাটের মিতুর কথা মনে পড়লো। ওর কাছে যাবে নাকি একবার? কিন্তু মিতু যদি বুঝতে পেরে যায়। তাহলে উনার লজ্জার সীমা থাকবে না। তার চেয়ে বরং মিতুর ছেলেদের কাছে যাওয়া যেতে পারে। বড় ছেলেটা সিক্সে পড়ে। আজকালকার বাচ্চা, নিশ্চই তাকে সাহায্য করতে পারবে। 

এখন তিনটার মতো বাজে। মিতু অফিস থেকে ফিরতে পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা মত বাজে সেটা ফরিদা বেগম জানেন। যেতে চাইলে উনার এখনই যাওয়া উচিত। মিতু ফেরার আগেই। ফরিদা বেগম তাই করলেন। মিতুদের বাসার কলিং বেল টিপে অপেক্ষা করতে থাকলেন। 

এবার ফরিদা বেগমের আরো বিপদ হলো। তাকে চমকে দিয়ে স্বয়ং মিতু দরজা খুলে দাঁড়ালো। অসময়ে ফরিদা বেগমকে দেখে মিতুও অবাক হলো।

মিতু: আরে খালাম্মা, আপনি? আসেন। 
ফরিদা বেগম: ইয়ে মিতু, ভেতরে আসবো না মা। তুমি আজ অফিসে যাওনি?
মিতু: না খালাম্মা। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো, ছুটি নিলাম। ভেতরে আসেন না খালাম্মা, কোন সমস্যা হয়েছে?
ফরিদা বেগম: না, ঠিক সমস্যা না। তোমার কী হয়েছে? জ্বর? আজকাল ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে। তোমার খালুতো এই ভুগে উঠলো।
মিতু: কিছুটা জ্বরের মতই। আর মাথাটা ভীষণ ব্যথাও করছিলো। বসেন খালাম্মা।

ফরিদা বেগম বসলেন। কিছুটা ইতস্ততঃ করে বললেন, বাচ্চারা কোথায়? বাসায় নেই?

মিতু: না খালাম্মা। বড়টা কোচিং এ। আর ছোটটা ছাদে, খেলতে গেছে।
ফরিদা বেগম: ও, ঠিক আছে। আমি তাহলে পরে আসবো। কোচিং থেকে কখন ফেরে? 
মিতু: এইতো, সাড়ে পাঁচটার দিকে। কেন খালাম্মা? 

ফরিদা বেগম বুঝতে পারছেন উনি নিজের কথার জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন। কোনরকমে বললেন, এই তেমন কিছু না। আমার মোবাইলটা একটু সমস্যা করছে। আমিতো এসব পারি না, রাশেদটাও বাসায় নেই। ভাবলাম তোমার বড় ছেলেটাকে দেখাই। আজকালকার বাচ্চারা তো এসব ভালো বোঝে।

মিতু হেসে ফেললো। কী সমস্যা করছে আমাকে দেখান খালাম্মা, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
ফরিদা বেগম: আরে না। তোমার শরীর ভালো না। তুমি বিশ্রাম নাও। আমি না হয় পরে আসবো। 
মিতু: কোন অসুবিধা নেই খালাম্মা। দিন, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

ফরিদা বেগম এমন উভয় সঙ্কটে আগে পড়েননি। উনার সাহায্যও দরকার, আবার বলতেও সংকোচ হচ্ছে। জড়তা ঝেড়ে ফেলে বলেই ফেললেন, “ইয়ে মিতু, আমার ফেসবুকে কী যেন হয়েছে। একটা ছবি কিছুতেই ডিলিট করতে পারছি না।

মিতু এবার বিস্মিত হলো। বাপরে, খালাম্মার ফেসবুকও আছে! বললো, কোন ছবিটা, দেখি।
ছবি আর পোস্টদাতার নাম এবং সেই সাথে কবিতার লাইন দেখে মিতু একটু থতমত খেলো। সে এতোটা ভাবেনি। পোস্টদাতার নাম ‘একলা পথিক’। ছবির নীচে লেখা -  

তুমি তা জানো না কিছু - না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে-
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই? 
শুধু তার স্বাদ 
তোমারে কি শান্তি দেবে?
আমি ঝরে যাবো-তবু জীবন অগাধ 
তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে।

এটা কার কবিতা? জীবনানন্দের না? মিতু সাবধানে জিজ্ঞেস করলো, “উনি কে খালাম্মা? আপনার বন্ধু?”

ফরিদা বেগম: আরে না। আমি চিনি না। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো, আমি ভুলে এক্সেপ্ট করে ফেলেছি। এখন কী বিপদ বলতো। সবাই দেখতে পেলে কী ভাববে? 

মিতু কথা বাড়ালো না। কিন্তু ফরিদা বেগমের জন্য ওর খুব মায়া হতে থাকলো। ইশ্, ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি, হয়তো প্রথম প্রেম। আবার খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু সেটা প্রকাশের সুযোগ উনার নেই। আর সেই মানুষটাই বা কেমন, এভাবে কেউ হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেয়? বেচারা খালাম্মাকে শুধু শুধু বিব্রতকর পরিস্থতিতে ফেলা।  

মিতু খালাম্মাকে ফেসবুকের কিছু বেসিক নিয়ম বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। এই যেমন, অন্যের পোস্ট করা ছবি ডিলিট করা যায় না, তবে চাইলে নিজেকে আনট্যাগ করা যায়। প্রাইভেসি সেটিংস এর কিছু খুটিনাটি আর ব্লক অপশন। বললো, এখন কী করবেন খালাম্মা? একমাত্র ব্লক করে দিলেই আপনার পরিচিত কেউ এই পোস্টটা আর দেখতে পাবে না। আমি কি এই আইডিকে ব্লক করে দেবো? 

ফরিদা বেগম বললেন, না থাক মিতু, ব্লক করো না। তুমিতো শিখিয়ে দিলে, আমি পরে ব্লক করে দিবো। তুমি বরং ছবিটা শুধু ডিলিট করে দেয়া যায় কিনা একটু দেখতো চেষ্টা করে। ফরিদা বেগমের গলাটা একটু মনমরা শোনালো যেন। 

মিতু জানে ছবিটা ডিলিট করা সম্ভব না। তাবুও চেষ্টা করতে থাকলো, যদি কোনভাবে পারা যায়। ফরিদা বেগমকে যদি এই বিপদ থেকে উদ্ধার করা যায়। যদিও এতো মিষ্টি একটা প্রকাশ মুছতে তার মোটেও ইচ্ছা করছিলো না।  

নাহ্, হলোনা। বরং মাঝখান থেকে ফেসবুকটাই হ্যাং হয়ে গেলো! নোটিফিকেশন ভেসে উঠলো, Facebook is not responding. মিতু বিব্রত ভাবে বললো, মাঝেমাঝে লগআউট করে আবার লগইন করলে ঠিক হয়ে যায়। আমি করবো? খালাম্মা শুকনো মুখে সম্মতি জানালেন। আর মিতুও পট করে লগআউট করে ফেললো।

এবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা এর মতো জানা গেলো ফরিদা বেগম পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন। উনার ছেলে এই একাউন্টটা খুলে দিয়েছিলো, এপর্যন্ত একবারও লগআউট করতে হয়নি, তাই পাসওয়ার্ডেরও দরকার পড়েনি। এখন একমাত্র ভরসা ছেলেকে জিজ্ঞেস করা। ফরিদা বেগম আরো মনমরা হয়ে গেলেন। বললেন, আমি বরং এখন যাই মিতু, অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। তোমার খালুকে বলে আসিনি। ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়ে এলো। 

মিতু: খালাম্মা, আমি খুবই সরি। আসলে হঠাত হ্যাং হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।
ফরিদা বেগম: তুমি কেন সরি বলছো মিতু। তোমার এখানে সরি হওয়ার কিছু নেই। তুমিতো চেষ্টা করেছো। না হলে আর কী করার আছে বলো? আমিই বোকামী করেছি, আবার। শুকনো হেসে বললেন, তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিলাম মা। আসি, কেমন?

মিতু অপরাধীর মতো মুখ করে রইলো। 
নতুন পাসওয়ার্ড তৈরির অপশনের কথা বলার আর সাহস পেলো না। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো। 

ফরিদা বেগম নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে দেখলেন মকবুল হোসেন ঘুম থেকে উঠেছেন বেশ কিছুক্ষণ আগেই। এখন হাঁটতে বের হবেন। ফরিদা বেগমকে ফিরতে দেখলেন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। ফরিদা বেগমের এক অদ্ভুত রাগ হলো।
 
ফরিদা বেগম: উঠে আমাকে খোঁজনি?
মকবুল হোসেন: না।
ফরিদা বেগম: কেন?

মকবুল হোসেন উত্তর দিলেন না। তাতে ফরিদা বেগমের আরো রাগ হলো। গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, আমি বাসায় ছিলাম না। কোথায় গিয়েছিলাম তোমার জানতে ইচ্ছা করে না? 

মকবুল হোসেন: জানার কি আছে? তুমি আর কোথায় যাবে? হয়তো ছাদে গিয়েছিলে। 
ফরিদা বেগম: আছে, জানার অনেক কিছুই আছে। আমিতো ছাদে যাইনি। তুমি কেন আমাকে খুঁজবে না? কেন জানতে চাইবে না আমি কোথায় গিয়েছিলাম? কেন জানতে চাও না আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে কিনা? কেন জানতে চাও না আমি ভালো আছি কিনা? সারাটা জীবনে একটিবারের জন্যও জানতে চেষ্টা করেছো আমি সুখী কিনা?

এই ফরিদা বেগমকে মকবুল হোসেন চেনেন না। উনি বিস্মিত চোখে ফরিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। এমন পরিস্থিতিতে কী বলতে হয় মকবুল হোসেনের জানা নেই। কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ইতস্ততঃ কণ্ঠে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ ফরিদা? ডাক্তারের কাছে যাবে? রাশেদকে ফোন করো বলো তবে অ্যাপোয়েন্টেমন্ট নিতে। 

ফরিদা বেগম সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, তুমি হাঁটতে যাও। আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। বলে আর দাঁড়ালেন না। মকবুল হোসেন হাঁটা থেকে ফিরে নাস্তা খাবেন। ঘরে বানানো নাস্তা। উনি বাইরের খাবার খেতে পারেন না। ফরিদা বেগম ফ্রিজ খুলে এটা ওটা নামাতে লাগলেন। 

ফরিদা বেগমের নিজেকেও ফেসবুকের মতো মনে হলো। যার পাসওয়ার্ড অন্য কেউ জানে। যে পাসওয়ার্ড উনি কখনো জানতে চাননি। এই শেষ বয়সে এসে যে পাসওয়ার্ড জানতে চাওয়া তার জন্য নিষিদ্ধ। উনি সেটাই করার চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক করেননি

এই জীবনটা কখনোই তার নিজের দখলে ছিলো না। আজও নেই। 

লেখক: কবি ও সাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত