ক্ষমতা
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০১৯, ২২:৩৫
অবশেষে বেতনটা বাড়ছে। এখন ৩ হাজার। মনে মনে আনন্দে নাচতে থাকে শারমিন। এখন মাসে মাসে সমিতির টাকা দিতে কষ্ট হবে না। আর দুই বছর জমালে একটা ভালো টাকা পাওয়া যাবে। বাসায় ফেরার পথে একটা কাঁচ ঘেরা দোকানে তাকায় শারমিন। ভেতরে হরেক রকম খাবার। দুইটা বনরুটির মাঝখানে মুরগির রান। বার্গার বলে। খেতে একেবারে বিস্বাদ। কিন্তু মেয়েটা খেতে চায়। আজকে একটা কিনে নেওয়াই যায়।
শারমিন ৮০ টাকা দিয়ে একটা বার্গার কিনে। মেয়ে স্কুলে গেছে, আসতে আসতে বিকেল। এখন বাসায় গিয়ে নিজের কাজ করে দুপুরে খেয়ে আবার আরেক বাসায় যেতে হবে। সেখানে রান্নার কাজ নিয়েছে দুই মাস হয়। ভালোই দেয়।
মোড় পার হয়ে একটা গলি, গলি থেকে ভেতরের দিকে তিনটা টিন শেডের ঘর। একটা রুম ভাড়া করে থাকে মায়ে মেয়ে। বিশেষ কিছু নাই। একটা চৌকি, একটা আলনা, একটা বাক্স, একটা আয়না একটা চেয়ার, একটা টুল। টুলে থাকে মেয়ের বই খাতা। আর এই চেয়ারেই থাকে মেয়ের যাবতীয় শখের জিনিস। নেল পলিশ, লিপস্টিক, চুড়ি, মাথার কাঁটা- আরও কত কি! শারমিন পারে না মেয়ের ইচ্ছে মত জিনিস দিতে। তাই যে যে বাসায় সে কাজ করে সেখানে খালারা কিছু ফেলে দিলে সে বলে কয়ে নিয়ে আসে মেয়ের জন্য।
মাত্র ক্লাস সিক্সে উঠলো মেয়েটা। এখনো কত ক্লাস বাকি। এত ক্লাসের পড়ার খরচ জোগাবে কি করে? আদৌ পারবে? হাঁটতে হাঁটতে একটা শ্বাস বেরিয়ে যায় শারমিনের বুক থেকে। পারতে তো হবে। এত কিছুর পর না পারাটা একটা পাপ।
মোড় পার হতে হতে একটা চোখের দেখা পায় সব সময়। আগ্রহী দুই চোখ। কাম নয় সরল ভালোলাগায় ভরপুর দুই চোখ। আবাসিকের দারোয়ান। প্রায় প্রতিদিনই এই সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে মোড়ে। শারমিনকে দেখার জন্য। শারমিনের বুক দুরুদুরু কেঁপে উঠে এই সময়। পথটা কাছে আসতেই হাত পা ঘামতে থাকে। চোখাচোখি হয় মাঝেমাঝে। মাঝে মাঝে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে যায়, যেন দেখতেই পায় নি।
এক পুরুষকে বিশ্বাস করে জন্মের জন্য ঠকেছে। আবার একই ভুল কিভাবে করে সে? না লাগবে না তার কোনো পুরুষ। সে এখনই ভাল আছে, যেমন আছে।
দুপুরে খেয়ে একটু গড়ায় বিছানায় শারমিন। ঘুমে চোখ ঢুলে পড়ে তবু উঠতে হয়। আলসেমি করার ক্ষমতা নাই ওর।
ঘর তালা দিয়ে বের হতেই শারমিনের চোখ আটকে যায় সামনে তাকিয়ে।
কে দাঁড়িয়ে আছে?
কেঁপে উঠে বুক। থরথর কাঁপতে থাকে এবং হঠাৎ এক আক্রোশে পুরো শরীর ঝাঁকি মেরে উঠে। হনহন করে বের হয়ে যায় শারমিন।
- শারমিন একটু কথা আছিলো। শারমিন!
পিছন পিছন আসতে থাকে লোকটা। সিরাজ। তার প্রাক্তন স্বামী।
আচানক পিছন ফেরে শারমিন। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। তবু অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখে।
- কী কথা?
কাঁচুমাচু মুখ করে সিরাজ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে শারমিনের সামনে। শারমিন আবার বলে, কি কথা?
সিরাজ কোনমতে মুখে রেখেই অস্পষ্ট ভাবে বলে, মাফ করন যায় না?
খেঁকিয়ে উঠে শারমিন। রাগে গড়গড় করতে থাকে কিন্তু রাস্তা বলে গলা উঁচুও করতে পারছে না। তবু হাত মুঠি করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, "হারামজাদা আর যদি সামনে আসস তোরে আমি জুতা পেডা করুম"। ভয়ে ভয়ে এক পা পিছিয়ে যায় সিরাজ।
শারমিন গনগন করে হেঁটে চলে যায়।
এই বাসায় সাধারণত এই সময়ে কেউ থাকে না। স্বামী স্ত্রী দুইজনই অফিসে থাকে। শারমিন পাশের বাসা থেকে চাবি নিয়ে ঢুকে কাজ করে দিয়ে যায়। আজ দেখলো আপা বাসায় আছে। ঘোমটা টেনে দরজা খুলে দিলো। শারমিন অবাক হয়, ঘরের ভেতর এত লম্বা ঘোমটা কেন?
তার আপা বেডরুমে শুয়ে আছে। শারমিন নিজের মনে কাজ করে চলে যাওয়ার সময় আপাকে বলতে যায়। দেখে আপা পাশ ফিরে কাতরাচ্ছে। হলো কি? জ্বর নাকি?
- আপা! শরিল খারাপ?
আপা একটু গোঙায়। পাশ ফিরলে শারমিন দেখে আপার নাক ঠোঁট ফোলা। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে, সেটা শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে।
শারমিন হা করে তাকিয়ে থাকে।
- আপা! কেমনে হইছে?
আপা কিছু বলতে পারে না, ফুঁপিয়ে চোখ মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে। শারমিন জানতে পারলো, আপার বর তার এই কাণ্ড করেছে গত রাতে। এমন নাকি প্রায়ই হয়। শারমিন আপার চোখেমুখে গরম পানির স্যাঁক দিতে থাকে। গা মুছে দেয়। চা করে দেয়। আর চেয়ে চেয়ে দেখে। এরা না শিক্ষিত? তাইলে এরাও মার খায় কেন? মারে কেন?
- আপা, এতই যখন পিডায় তাইলে থাকেন ক্যান? শারমিন একটু ভয়ে ভয়ে ফ্লোরে বসে জিজ্ঞেস করে।
- থাকি কি আর সাধে?
শারমিন বুঝতে পারে না। আবারও জানতে চায় কেন সে যায় না। সে না অনেক বড় কোম্পানিতে চাকরি করে! তাইলে এমন ব্যাডার ঘর করার কি দরকার? শারমিন অশিক্ষিত মগজে এর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না।
- ওর এই বাড়ি আর গাজীপুরের অনেক জমি আমার নামে লেখা। চলে গেলে এগুলো হাতছাড়া হয়ে গেলে! আর লোকে কী বলবে?
শারমিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার শিক্ষিত বড় চাকরি করা আপার দিকে। টাকা পয়সার লোভে, মাইনষে কী বলবে সেই ডরে মাইর খেয়েও স্বামীর পায়ে পড়ে থাকতে হবে? তবে পড়ালেখা করে নিজেরে শিক্ষিত বলার দরকারডা কি?
ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বের হয়ে আসে শারমিন। সন্ধ্যা হয়েছে, মেয়েটা একা আছে।
যেতে যেতে কিছু দৃশ্য চোখের উপর ভেসে উঠে শারমিনের। দুই বছর আগে কোনো এক বর্ষার রাতে শারমিনের ঘরে কড়া নড়ে। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টির আওয়াজে সে দরজা খুলে দেখে তার সিরাজ আর আরেকজন গলায় মালা দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায় আছে। চোখগুলো যেন খুলে বের হয়ে যাবে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল শারমিন। যেন পায়ের নিচে মাটিটা হুট করে সরে গেছে। সমস্ত শরীরে যেন কাঁটা ফুটলো। একটু যেন মাথা ঘুরে উঠলো। কাঁচুমাচু কণ্ঠে সিরাজ জানায়, সে বিয়ে করেছে আরেকটা। তাকে যেন মাফ করে দেয়। সেই রাতেই ঠিক সেই বৃষ্টির রাতেই সে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে বের হয়ে যায়। সেই যে ঘর ছাড়ে আর কোনোদিন পিছপা হয় নি।