ছোটগল্প: চড়

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০৩

ব্যাপারটা অদ্ভুত। একবার দুইবার তিনবার, পরপর তিনবার পা পিছলে পড়ে গেলো শিরিন। কোনো কারণ নেই পড়ার। মেঝে শুকনো। পায়েও ভাল জুতো। বেসিন ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে খানিক ঝাপসা আয়নায় নিজেকে দেখে কিছু ভাবার চেষ্টা করছে। ঠিক ভাবনা নয় অতীতের কিছু স্মৃতি হাতড়িয়ে সেখান থেকে কিছু তুলে আনার চেষ্টা।

শিরিনের পা কাঁপছে হালকা হালকা। নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে ধীরে। কোথায় যেন দরজায় নক পড়ছে। জানালার পর্দা এলোমেলো উড়ছে। দরজার ওপাশে কেউ চিৎকার করে যাচ্ছে। দরজায় টোকা পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে......

-----------------------------

কি হলো কি তোর? দরজা খোল। শিরিন দরজা খোল। খোল বলছি।

অথর্ব হয়ে বসে থাকা শিরিন যেন নড়তে ভুলে গেছে। ঘিনঘিনে নোংরা কুৎসিত একটা সাপ যেন এখনো তার সারা গায়ে কিলবিল করছে। এখনো যেন অজস্র কীট তার শরীরে হেঁটে যাচ্ছে। কী বীভৎস অনুভূতি তার ভেতরে লুটপাট খাচ্ছে সে বলে বুঝাতে পারছে না কাউকে। মনে হচ্ছে বাড়ির পিছনে ড্রেন আছে, নোংরায় যেটা সবসময় স্তূপ হয়ে থাকে, গন্ধে যেখানে শ্বাস নেওয়াও দুষ্কর সেখানে একটা ডুব দিয়ে আসলেও এমন কুটকুট করতো না শরীর। এমন বিশ্রী লাগতো না নিজেকে।

কীভাবে দূর করে এই ময়লা শরীর থেকে? কীভাবে? কীভাবে?

আছড়ে পড়ে শিরিন বিছানায়। চোখ বেয়ে ঘৃণার জল নামে। ছিঁড়ে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেকে। বড্ড অসহায় বড্ড দুর্বল লাগে নিজেকে। কেন সে মেয়ে হয়ে জন্মাল? কেন?

লক দরজা চাবি দিয়ে খুলে শিরিনের মা ঢুকে রুমে। সদ্য কিশোরী মেয়ের এমন বেহাল অবস্থা দেখে প্রথমেই মনে উঁকি দেয় এক চিরাচরিত ভাবনা। প্রেম করছে নাকি কারো সাথে?

শিরিন, কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? উঠ দেখি।

নিজের এই বিশ্রী চেহারা দেখাতে চায় না কাউকে শিরিন। নিজেকেই অদৃশ্য করে দিতে প্রবল ইচ্ছে আর করতে না পারার রাগে ফেটে পড়ে। তবু চিৎকার করতে পারে না। একটা চিৎকার যদি দিতে পারত সে! একটা বিকট চিৎকার!

কিছু বলবি তুই? কি হয়েছে? শিরিনের মা ক্রমাগত শিরিনকে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে। মেয়েকে উঠাতে চাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে বিছানা জাপটে ধরে আছে। অবশেষে এক হেঁচকা টানে মেয়েকে উঠিয়ে ফেললেন বিছানা থেকে। লাল চোখ মুখ দেখে শিরিনের মা কিছুটা শিউরে উঠলেন। একি হাল হলো তার মেয়ের!

শিরিন, মা আমার, বল কি হয়েছে তোর। বল মা। এমন করছিস কেন? সন্দেহ নয় আকুল সুরে জানতে চাইলেন মেয়ের কি হয়েছে।

শিরিন ঢুকরে কেঁদে উঠে মায়ের বুকে মুখ লুকালো। তীব্র বাঁধনে মাকে জড়িয়ে ধরে গোঙাতে লাগল। যেন বিলাপ চলছে বাড়ি জুড়ে। শোকের মাতম শিরিনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দেখা যায় না বুঝা যায় না। শুধু যার যায় সেই বুঝে।

মা, ও মা। মা।

হ্যাঁ মা বল কি হয়েছে?

আমি আর সবুজ চাচার কাছে যাবো না মা, আর কোনদিন যাবো না।

সবুজ চাচা? সবুজ চাচা কি করেছে? কেন যাবি না?

মা সবুজ চাচার কাছে আর যাবো না মা, আর যাবো না। কান্নার দমকে মেয়ে ঠিক মত কথাও বলতে পারছে না। নাকের পানি চোখের পানি সব মিশে একাকার।

বিলাপ যেন থামেই না মেয়ের। শিরিনের মা বুঝতে পারে না কি এমন হতে পারে যার জন্য মেয়ে এমন আহাজারি করছে!

খুলে বল আমাকে কি হয়েছে। বল আমাকে শিরিন।

কথাটা বলতে মুখে বাঁধে শিরিনের। যেন বললেই আবার সেই বিশ্রী ঘটনা পুনরায় ঘটবে। যেন বললেই আবার কোনও লোমশ হাত কিলবিল করবে তার শরীরে। যেন বললেই সে ডুবে যাবে আবার কুৎসিত অন্ধকারে।

মা, সবুজ চাচা আমার...

কি তোর কি?

সবুজ চাচা আমার বুকে হাত দেয় মা। যেন জমে থাকা নিঃশ্বাস পলকেই বের হয়ে যায়। একটা শান্তির পরশ এইসব বীভৎস অনুভূতির উপর প্রলেপ লাগায়।

কি বলিস এগুলা, পাগল হয়ে গেলি নাকি?

বিস্ফোরিত চোখে শিরিনের মা তাকিয়ে থাকে শিরিনের দিকে। শিরিন কথা খুঁজে পায় না। তার মা কি তাকে বিশ্বাস করছে না?

শিরিন তোর মাথা ঠিক আছে?

মা... থেমে থাকা কান্নার দমক আবার বাড়তে থাকে। স্রোতে ডুবে যাওয়ার সময় খড়কুটো পেয়েও যদি কেউ হারিয়ে ফেলে তখন কি করার থাকে আর?

মায়ের দৃষ্টি ক্রমেই শান্ত হয়। বুঝতে পারে মেয়ে তার সত্য বলছে। জড়িয়ে ধরে বলে, “মা এগুলা একটু আকটু হয় মেয়েদের সাথে, এগুলো মনে রাখতে নেই। আমার সাথেও কত হয়েছে, মেয়েদের কত কিছু মানিয়ে চলতে হয়। এখন থেকে একটু সাবধানে থাকবি। এত ছেলেদের সামনে যাবি না দরকার না হলে। চাচা হোক মামা হোক, সব পুরুষ এক”।

শিরিন নিথর পড়ে থাকে মায়ের বুকে। মা তাকে বলছে সে মেয়ে তাই তার সাথে এগুলো হবে! তাহলে সে মেয়ে হলো কেন? সে কি হতে চেয়েছে মেয়ে?

কান্না থেমে যায় শিরিনের। মা তার মুখ মুছে দিয়ে চুল জামা ঠিক করে দেয় আর বলে “দেখিস কাউকে বলিস না এসব, লোকে খারাপ বলবে”।

কাকে খারাপ বলবে মা?

শিরিনের মা একটু থতমত খায়। চোখ নামিয়ে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে মেয়েদেরই দোষ ধরে মানুষ। কি দরকার বলে বেড়ানোর? যা উঠে পর। হাত মুখ ধুয়ে নে।

শিরিন বসেই থাকে। তার ঘুম পায়। সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার দোষ ধরবে? নিজেকে ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল শিরিনের। নোংরা নর্দমার কীট মনে হতে থাকল। তার মেয়ে হওয়াই তার কাছে সবচেয়ে কুৎসিত ব্যাপার মনে হতে থাকল। সে কেন ছেলে হলো না? কেন?  

-------------------------------

বাথরুমের দরজায় টোকা পড়ে। শিরিন বাস্তবে ফিরে আসে।

এই শিরিন, এতক্ষণ কি বাথরুমে? ঠিক আছো?

শিরিনের স্বামীর উদ্বিগ্ন আওয়াজ পাওয়া যায় বাহির থেকে।

আসছি আমি, একটু।

তাড়াতাড়ি এসো, শওকতরা এসেছে।

যেন কেউ লবণ ছুঁড়ে দেয় শিরিনের বছর পুরনো কাটা ঘায়ে। দুলতে থাকে শিরিনের পৃথিবী। দু' হাত ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠে। বহু বছর আগে যা ঘটেছিল শিরিনের কিশোরী বয়সে আজ একই ঘটনা ঘটেছে শিরিনের মেয়ের সাথে। মাত্র ৯ এ পা দেওয়া মেয়ে তার। কি এমন আছে তার শরীরে? ফ্রক পরে যখন গোল গোল ঘুরে, দেখে মনে হয় সদ্য পদ্মফুল নাচছে। সেই পদ্মফুল আজ বিছানায় বিমর্ষ হয়ে পড়ে আছে।

শিরিন তার মায়ের মত মেয়েকে বলে নি যে তুমি মেয়ে হয়েছ বলে এসব তোমাকে সইতে হবে। বরং সে তার মেয়েকে শিখিয়েছে কেউ তাকে খারাপভাবে ছুঁলেই যেন সে সব খুলে বলে মাকে।

মেয়ে সব বলেছে তাকে। তার শওকত আঙ্কেল তাকে ছুঁয়েছে। তার খারাপ লেগেছে সেই ছোঁয়ায়। নিজেকে তার এখন অশুচি মনে হচ্ছে। মন খারাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এঘর থেকে ও ঘর। কেউ বুঝে না, কেউ জানে না। শুধু শিরিন জানে। শিরিনের কোলে মুখ গুঁজে বলেছে সব। যেন শিরিনেরই গায়ে কেউ থাবা দিলো। যেন সেই পুরনো ঘিনঘিনে অতীত আবার আক্রমণ করলো শিরিনকেই। মেয়েকে জড়িয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ। সেই দগদগে ঘা যা সে নিজে পেয়েছে আজ তার মেয়েও পেয়েছে? এতটুকু মেয়ের ভেতরে এখন কি হচ্ছে কি বয়ে যাচ্ছে শিরিন বুঝতে পারে।

কিন্তু বুঝতে পারে না মেয়ের এই যন্ত্রণা সে কীভাবে দূর করবে? সে মেয়েকে শিখিয়ে তো দিয়েছে কিছু হলেই যেন মাকে এসে বলে। কিন্তু সে নিজেকে তো শিখায় নি এর প্রতিবাদ করতে হয় কীভাবে? তার বেলায় সে কিছু করতে পারে নি, নিজের মেয়ের বেলায়ও পারবে না?

ডাইনিং টেবিলে সবাই আছে শুধু তুলতুল নিজের রুমে। শিরিন খাবার বেড়ে দিচ্ছে সবাইকে। শওকত থাকে লন্ডন । দেশে আসে প্রতি বছর। এক মেয়ে কলেজে পড়ে। পারিবারিক বন্ধু বলে সবার মধ্যেই বেশ ভাব আছে। সেই শওকত? কীভাবে?

ভাত বেড়ে দিতে দিতে মুচকি একটা বিকৃত হাসি হাসে শিরিন। তার সবুজ চাচার পক্ষে যেভাবে সম্ভব হয়েছিল সেভাবে শওকতের পক্ষেও সম্ভব। 

শিরিন ভাত মাখে, খেতে পারে না।

শওকত কথার মাঝে বলে উঠে, তুলতুল কোথায়? খেলো না আমাদের সাথে?

শিরিন জমে যায় মুহূর্তেই। চরম আক্রোশে সে ফেটে পড়তে চায় কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রেখে বলে, সে নিজের রুমে।

কি হয়েছে ওর? শরীর খারাপ?

ভাত মাখানো হাত শক্ত হয়ে যায় শিরিনের। মন, ওর মন খারাপ।

মন? হাহাহা এতটুকু মেয়ের আবার মন খারাপ কি?

ও তো এতটুকু মেয়েই, কিন্তু অনেকে তো ভুলে যায় সে যে এতটুকু।

কেন কি হয়েছে? শওকতের স্ত্রী কথা বলে।

ওর গায়ে কেউ বিশ্রীভাবে হাত দিয়েছে ভাবি। ও সেটা নিতে পারছে না। কীভাবে নিবে বলুন? ও তো এতটুকু বাচ্চা, তাই না শওকত ভাই?

সবার হাত থেমে যায়। শওকতের স্ত্রী মুহূর্তেই থমকে তাকায় শওকতের দিকে। কেন শিরিন শওকতের নাম বলল কথা শেষে? এর উত্তর খুঁজে শওকতের চেহারায়।

পিনপতন নীরবতা ভেঙে শওকতই বলে উঠে, ছি ছি ভাবি কি বলছে, কে করেছে এমন কাজ?

শিরিন তাকায় শওকতের দিকে। কঠিন ক্ষুব্ধ দৃষ্টি দিয়ে। শওকত চোখ নামিয়ে ফেলে। পানি খায়। ভাত মাখানো হাত কাঁপে। 

দেখে শান্তি লাগে শিরিনের। 

তার এক আঙ্কেল তাকে ধরেছে খুব নোংরাভাবে। কি করা যায় এখন বলেন তো। শিরিন দৃঢ় কন্ঠে বলে। 

শিরিনের স্বামী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। স্তব্ধ হয় শওকতের স্ত্রীও। 

শুধু শওকত ভয় পেতে থাকে। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। 

শওকত ভাই বলেন না কি করা উচিত। আমার এই অবুঝ মেয়েটার সাথে যে নষ্ট লোকটা এমন করেছে তার সাথে কি করা উচিত? 

ভাবি আপনি শওকতকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? শওকতের স্ত্রী কড়া গলায় বলে শিরিনকে। 

কারণ আপনার স্বামীই, তুলতুলের এই আঙ্কেলই তাকে ধরেছে। তার বুকে খামচি দিয়েছে। তার দু' উরুর ফাঁকে হাত গলিয়েছে। তীব্র কিন্তু শান্তভাবে শিরিন জবাব দেয়। এবং সবাই যার যার জায়গায় জমে যায়। 

এসব, এসব আপনি কি বলছেন ভাবি? থর থর গলায় শওকত বলে উঠে। 

ক্রুদ্ধতম চোখে শিরিন তাকায় শওকতের দিকে। 

সেই দৃষ্টি শওকত সহ্য করতে পারে না। চোখ নামিয়ে ফেলে। 

অস্বীকার করবেন সেদিন পরশু আপনার ভাই বাসায় ছিল না, আমি বাথরুমে ছিলাম। আপনি হুট করে এসে তুলতুলের সাথে ছিলেন। তুলতুলের মানা করার পরও আপনি তাকে জোর করে কোলে বসান। ওর জামার ভেতর হাত ঢুকান। ও ভয়ে কাঁপতে থাকে দেখে ওকে চকলেট দিয়ে মন ভোলানোর চেষ্টা করেন। অস্বীকার করবেন? সাহস থাকলে করে দেখান। 

শিরিনের গলায় কি যেন ছিল। যেন বজ্রকণ্ঠ। সে কন্ঠ উপেক্ষা করার শক্তি মানুষের নেই। 

শওকতের মাথা নিচে নামতে নামতে মিশে যায়। 

বিষ্ফোরিত চোখে শওকতের স্ত্রী তাকিয়ে থাকে শওকতের দিকে। 

এরপর আর কোনো কথা নেই। আওয়াজ নেই। শিরিন উঠে গিয়ে মেয়ের রুমে যায়। দেখে মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। সে থর থর করে কাঁপে। শিরিন দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। 

সাথে সাথে শুনতে পায় কারো গালে ঠাস করে চড়ের আওয়াজ। 

ফিরে তাকিয়ে দেখে শওকতের স্ত্রী হিংস্র বাঘিনীর মত দাঁড়িয়ে আছে শওকতের পাশে। শওকতের ভাত মাখা হাত তার চড় খাওয়া গালে।   

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত