‘কনটেম্পরারি, মডার্ন নাচের জন্য শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখা জরুরী’
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:৪০
মনিপুরী নৃত্যের গুরু কলাবতী দেবী। এপার বাংলা ওপার বাংলায় তাঁর হাতে অনেক শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী তৈরী হয়েছে। ১৯৪৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতের মনিপুর রাজ্যে তাঁর জন্ম। তিনি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিপুরী নৃত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এবার বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম নৃত্য সংগঠন কল্পতরু’র সাতবছরব্যাপী নৃত্য কোর্সের পরীক্ষা নেয়ার জন্য। পাশাপাশি তিনি কল্পতরুতে একটি ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন। কল্পতরুর বনানী স্কুলে ওয়ার্কশপের ফাঁকে কথা বলেছেন ও ছবি তুলেছেন রাহাদ বিন মালেক।
রা. বি. মা. : আপনার নাচের শুরুর গল্পটা একটু বলবেন?
কলাবতী দেবী: আমি আসলে গান করতাম। আমার গানের গলা ভালো ছিলো। মনিপুরী গানের সাথে হাতের মুখের শরীরের অঙ্গভঙ্গীর একটা চল আছে। আমার গানের গুরুজী আমার অঙ্গভঙ্গী দেখে বললো তুমি নাচের স্কুলে যাও। নাচে তুমি ভালো করতে পারবে। পরে নাচের স্কুলে পাঠালেন। ১৯৫৫ সালের কথা, যখন আমার বয়স ১১। তখন থেকেই গানের পাশাপাশি নাচ শুরু করি। তারপর তো নাচেই রয়ে গেলাম। গুরু ক্ষ্যাতিতম্বী দেবী, গুরু আয়গা কুমারী, গুরু পাকা সিংহ এবং গুরু ওয়াই গাম্ভিনী দেবী’র কাছ থেকে আমি নাচের দীক্ষা নিয়েছি। ওয়াই গাম্ভিনী দেবী’র কাছে শিখেছি অষ্ট নাইকা ভেদ, রাসলীলার ক্রম শিখেছি ‘ক্ষ্যাতিতম্বী দেবী’র কাছ থেকে। এভাবে সবার কাছে কিছু কিছু দীক্ষা নিয়েছি। পাঁচ বছর শেখার পর ১৯৬০ সালে বোম্বে’র (বর্তমানে মুম্বাই) মনিপুরী ড্যান্স গ্রুপ ‘দ্যা ঝাভেরি সিস্টারস’এ আমি নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করলাম। আমার আরেকজন গুরু ছিলেন গুরু বিপেন সিং তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।
রা. বি. মা. : আপনার এই নাচের অনুপ্রেরণা কিভাবে এসেছিলো?
কলাবতী দেবী: গানই আমার নাচের অনুপ্রেরণা ছিলো। আর ছিলেন গুরু বিপেন সিং। তিনি আমাকে মনিপুরী নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠার পিছনে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। পরবর্তীতে আমরা দুজন দুজনের জীবনসঙ্গী হই। তাঁর কাছে আমি যখন প্রথম নাচ শিখতে যাই, আমার গানের গলাও ভালো ছিলো। তাই তার গানের কম্পোজের সময় বলতাম এই গানের সুরটা একটু লম্বা হলে ভালো হবে ঐ গানের অন্তরাটুকু এমন হবে। এভাবে তাঁর কাছে আসতে থাকি। তাঁকে বুঝতে থাকি। তাঁর সাথে আমার মতের অনেক মিল ছিলো। আমাদের অনেক কিছুই মিলে যেতো। আর মনের মিল তো ছিলোই। ১৯৭৩ সালে আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই।
রা. বি. মা. : মনিপুরী নৃত্যের অনেক ইতিহাস, নৃত্যের ঢং এইসব আপনি সংরক্ষণ করছেন। এগুলো ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কিভাবে রেখে যেতে চান?
কলাবতী দেবী: ইতোমধ্যে এইসব নিয়ে আমি দুইটা বই বের করেছি। নতুন একটি বইয়ের কাজ চলছে। তবে কবে বের করতে পারবো বলতে পারছি না। বয়স হয়েছে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারি না।
রা. বি. মা. : কি বলেন! আপনাকে দেখলাম দুই ঘন্টা ধরে বিরতীহীনভাবে নাচ করছেন শিক্ষার্থীদের জন্য। প্রথম ব্যাচ হয়রান হয়ে চলে গেলো দ্বিতীয় ব্যাচও হয়রান হয়ে গেলো কিন্তু তবুও আপনি নাচ করাচ্ছিলেন।
কলাবতী দেবী: (হেসে) আমি যেসব গুরুর কাছে নাচ শিখেছি তারা আমাদের কোন ছাড় দিতো না। নাচ মানে নাচই করতে হবে অন্য কিছু নয়। একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো যাবে না। এর জন্য কতো বকা শুনেছি! আর এখনকার মেয়েদের এতো সময় কোথায়? অবশ্য তাদেরও দোষ না। স্কুলের চাপ, কোচিং এর চাপ, বাসায় টিচারের চাপ। এইসব চাপ শেষ করে তারপর নাচের স্কুলে আসে। এতো চাপ শেষ করে তারপর নাচ শিখতে আসে। নাচের সময় এতগুলো বোল বলতে হয়, সেগুলো মুখস্ত করে বলা সোজা কথা নয়। তাদের তো রীতিমতো সাহসী বলবো।
রা. বি. মা. : বাংলাদেশে এবার নিয়ে কতবার এসেছেন?
কলাবতী দেবী: বাংলাদেশের সিলেটের কমলগঞ্জে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। যেখানে বিয়ে হয়েছে সেটাও মনিপুরী পরিবার। সেই সুবাদে অনেকবার এসেছি। আর নাচের জন্য তো এখনও আসছি। এবার এসেছি কল্পতরু’র সাত বছর ব্যাপী নৃত্য কোর্সের পরীক্ষা নিতে এবং পাশাপাশি একটি ওয়ার্কশপ করাবো। এই কোর্সের শিক্ষিকা হিসেবে আছে সুইটি দাস মৌ। সুইটি আমাদের কলকাতারই মেয়ে, তবে বিবাহসূত্রে সে এখন বাংলাদেশে থাকে। কল্পতরুতে প্রতিবছরই পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী ধাপে যেতে হয়। কোর্সের কারিকুলামের মধ্যে আছে নৃত্যশ্রী পূর্বপাঠ, নৃত্যশ্রী উত্তরপাঠ, নৃত্যশ্রী তীর্থ (আদি), নৃত্যশ্রী তীর্থ (মধ্য), নৃত্যশ্রী তীর্থ (অন্ত), নৃত্যভারতী (প্রথম বর্ষ), নৃত্যভারতী (চূড়ান্ত বর্ষ), অভিজ্ঞান নৃত্যভারতী (প্রথম বর্ষ) ও সর্বশেষ অভিজ্ঞান নৃত্যভারতী (চূড়ান্ত বর্ষ)। চূড়ান্ত পর্বে যে উত্তীর্ণ হয় তাকে নৃত্যম বিশারদ উপাধি দিয়ে সার্টিফিকেট দেয়া হয়।
এছাড়াও ভারত সরকার আমাকে বাংলাদেশের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের (ICCR) অধীনে মনিপুরী নাচ শেখানোর জন্য পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। তখন বছরে দেড় মাস করে বছরে দুইবার থাকতে হতো।
রা. বি. মা. : বাংলাদেশে এতোদিন নাচ শিখিয়েছেন, এখনও শেখাচ্ছেন। বাংলাদেশের মেয়েরা কেমন করছে বলে আপনার মনে হয়?
কলাবতী দেবী: বাংলাদেশের মেয়েরা খুব ভালো করছে। তাদের নাচ শেখার আগ্রহ দেখে আমি অভিভূত। যেমন তামান্নাকে আমি নাচ শিখিয়েছি। কলকাতায় আমার বাড়িতেই অনেকদিন ছিলো নাচ শেখার জন্য। ওয়ারদা রিহাব, শামীমা হোসেন প্রেমা এরা সবাই আমার কাছ থেকে নৃত্য শিক্ষা নিয়েছে। সবচেয়ে সিনিয়র স্টুডেন্ট হলো শর্মিলা বন্দোপাধ্যায়। তারা তো এখন বাংলাদেশে জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী। আর কল্পতরুতে নৃত্য শিক্ষিকা হিসেবে আমাদের কলকাতার মেয়ে সুইটি দাস মৌ কাজ করছে। যে বিবাহসূত্রে বাংলাদেশে বাস করছে। সে তো এখন এক অর্থে বাংলাদেশের হয়ে গিয়েছে। সুইটিকেও আমি নাচ শিখিয়েছি।
রা. বি. মা. : বাংলাদেশের নতুন যারা নাচে আসতে চায় তাদের জন্য আপনি কি বলবেন?
কলাবতী দেবী: ঐ যে বললাম সব চাপ শেষ করে তারপর তারা নাচ শিখতে আসে। তবে শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখতে একটু সময় লাগে। এর জন্য সময় দিতে হবে। অধ্যবসায় করতে হবে। আর এখন তো কনটেম্পরারীর যুগ চলে এসেছে।
রা. বি. মা. : এখন তো শাস্ত্রীয় নৃত্যের সাথে কিছু আধুনিক কনসেপ্ট আধুনিক ঢং আধুনিক ধারা কিংবা সমসাময়িক নৃত্য যোগ করা হচ্ছে যাকে আমরা কনটেম্পরারী বলি। এই কনটেম্পরারি সম্বন্ধে কিছু বলুন?
কলাবতী দেবী: শাস্ত্রীয় নৃত্যের সাথে আধুনিক ঢং যোগ করা জরুরী যুগের সাথে তাল মেলানোর জন্য। এই তাল মেলানোটা আমি খারাপ বলবো না। আমাদের শাস্ত্রীয় নৃত্যেও তো অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে তো আমরা রাসলীলার মধ্যেই থাকতাম। এখন তো রাসলীলার বাইরেও অনেক অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে। শুধু রাসলীলার নৃত্য করলে এখন কে দেখবে? সেটাও ভাবতে হবে আমাদের। এই ভাবনা থেকেই কনটেম্পরারির দরকার। তবে যাই হোক না কেনো। নতুন নতুন যারা নাচে আসতে চায় আর এখন যারা করছে তাদের জন্য বলতে চাই শাস্ত্রীয় নৃত্যটা শেখা অনেক জরুরী। শাস্ত্রীয় নৃত্য না শিখলে তোমরা কনটেম্পরারি, মডার্ন কিছুই করতে পারবে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে আটকে যাবে। আর একটা কথা বলতে চাই বাংলাদেশে নৃত্য সংগঠনও অনেক দরকার। যেমন কল্পতরুর প্রতিষ্ঠাতা লুবনা মারিয়াম নিরলসভাবে নতুনদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এমনভাবে আরো কিছু নৃত্য সংগঠন দরকার।
রা. বি. মা. : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সময় দেবার জন্য।
কলাবতী দেবী: তোমাকেও ধন্যবাদ।