গল্প
বীরাঙ্গনা
প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:২৭
সখিনা বেগম সবেমাত্র বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। বধূবেশে শ্বশুরবাড়ি যাবে এই খুশিতে তার মনে আনন্দের জোয়ার বইছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ায় চারিদিকে গুলির শব্দে আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মনে। বউ-ঝিয়েদের মনে চিন্তা তো লেগেই আছে। তার ওপর যুদ্ধ করে দেশ রক্ষায় উদগ্রীব সমগ্র জাতি।
লাল বেনারসি, হাতে মেহেদি আর পায়ে আলতা মেখে বসে আছে সখিনা। কখন বর আসবে। এদিকে, বিয়ের জন্য কাজী সাহেবও হাজির। যথাসময়ে বিয়েও হয়ে গেল। সবাই আমিন বলে দোয়া শেষ করবে এমন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিয়ের আসরে হানা দেয়। তুলে নিয়ে যেতে চায় সখিনাকে। পরিবার থেকে শুরু করে সখিনার কত আকুতি-মিনতি। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
পরিস্থিতি টের পেয়ে জামাই রহিম উল্লাহকে আগে থেকেই লুকিয়ে রাখা হয়। বিয়ের আসরে কয়েকজনের বুকে গুলি চালিয়ে সখিনা বেগমকে শেষমেষ উঠিয়ে নিয়ে যায় পাক সেনারা। পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে সখিনাকে বাঁচিয়ে আনতে স্বামী রহিম উল্লাহ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তা কাজে আসেনি। পরিবার-সমাজের বাধায় সে পথে এগিয়ে যায়নি রহিম উল্লাহ। এদিকে সঙ্গিনী সখিনাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে শারিরীক নির্যাতন করেছে পাক সেনারা।
এ কেমন বিচার সখিনার প্রতি? চোখের সামনে থেকে সখিনা বেগমকে তুলে নিয়ে গেলেও পরিবার, সমাজ তাকে রক্ষা তো দূরের কথা, সখিনা বেগমকে খুঁজতেও চেষ্টা করেনি কেউ। বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর সখিনা যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন সান্ত্বনা তো দূরের কথা, সখিনার মা-বাবার কাঁন্না আর সমাজের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে সখিনার বেঁচে থাকার আশা নিঃশেষ হয়ে যায়। সমাজের মানুষগুলো যে শুধু ভর্ৎসনা করতে শিখেছে, কোনো পথ দেখাতে শেখেনি তা সেদিন বুঝতে পেরেছিল মেয়েটি।
অন্যদিকে, সখিনাকে পাক সেনারা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর স্বামী রহিম উল্লাহ চলে যান যুদ্ধে। নববধূর সঙ্গে এমন আচরণে হয়তো রহিম উল্লাহ সেদিন প্রতিশোধের নেশায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তবে সখিনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনায় সে আত্মহত্যারও করতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রামের মাস্টার মশাই সেদিন সখিনাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখান।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে একসময় শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে রহিম উল্লাহ তার বিবাহিত স্ত্রী সখিনাকে ঘরে তুলতে চাইলেও, সমাজের বাঁধায় তা আর সম্ভব হয়নি। সমাজপতিদের বেধে দেওয়া বিধান অনুযায়ী আবার বিয়ে করে রহিম উল্লাহ্। কিন্তু বিয়ের সেই আসরে জায়গা হয়নি সখিনার। বাঙালি নারীর অলংকার হিসেবে পরিচিত পাওয়া সখিনা সেদিন স্বামী হারালেও, রহিম উল্লাহ ঠিকই বেছে নিয়েছিল নতুন সঙ্গী।
সেদিনের সে ঘটনায় সখিনা বেগম সম্ভ্রম হারিয়ে সমাজ থেকে এক বার্তা পেয়েছিল। আর তা হলো, নারী শুধু ভোগের, দাসের, অবহেলার। যুদ্ধে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে সখিনার মতো নারীরা বীরাঙ্গনা উপাধি পেলেও, সমাজের মানুষের চোখে আজও তারা ধর্ষিতা, অসতি। স্বাধীনতার একুশ বছর পর সখিনা বেগমের মতো কিছু নারীদের হয়তো সরকারিভাবে স্বীকৃতি মিলেছে, কিন্তু সে তালিকার বাইরে থেকেছে এমন বহু নারী। এখনো বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সখিনার মতো অনেক নারী অগোচরে চোখের জল ঝরিয়ে যাচ্ছে তাদের সংগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কালো স্মৃতি নিয়ে।
কিন্তু কী পেলো তারা?
শুধুই একটি নাম ‘বীরাঙ্গনা’।
লেখক: সৌদি আরব প্রবাসী কবি ও সাংবাদিক