চন্দ্রাবতীর প্রেমকথা
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০১৭, ২৩:০২
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম যে নারী কবির নাম খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি চন্দ্রাবতী। ১৯৩২ সালে প্রখ্যাত লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর লেখা 'রামায়ণ' প্রথম প্রকাশ করেন। এছাড়াও 'মলুয়া' ও 'দস্যু কেরামনের পালা' তার অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম। 'মনসা মঙ্গল' কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশী দাস তার পিতা, মায়ের নাম সুলোচনা দেবী। ষোড়শ শতাব্দিতে জন্ম হয়েছিলো কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের অদূরে ফুলেশ্বরী নদীর (এখন মৃত ও অস্তিত্ব শূণ্য) তীরে পাটোয়ারী গ্রামে। এই মহিয়সী নারীর প্রতি আমার ভালোবাসা ভিন্ন কারণে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমিও গিয়েছিলাম নীলগঞ্জ রোড ধরে সেই স্মৃতিবিজরিত গ্রামটিতে। আমাদের কাজ ছিলো, চন্দ্রাবতী সম্পর্কে স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রবন্ধ লিখা।
চন্দ্রাবতীর সাহিত্য কর্ম নিয়ে লেখার সাহস বা সামর্থ্য, কোনটাই আমার নেই। তবে তার অন্তর্ধান আমাকে ব্যথিত করে। সেই ছোটবেলা থেকেই তার প্রতি আমার একটা মায়া কাজ করতো। বলা ভালো আমি তখন (এখনো) চন্দ্রাবতীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিশোরগঞ্জ শহরের শিল্পকলা একাডেমি আমার বাসার খুব কাছে, একবার 'চন্দ্রাবতী' গীতিনাট্য দেখতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম। ইদানিং নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। আমি নিজেও দুই কন্যার পিতা। কেন আমাদের মেয়েরা নিগৃহীত হচ্ছে, আমাকে ভাবায়, আমাকে পোড়ায়... আমি মাঝে মাঝে লিখি, প্রতিবাদ করি। কিন্তু একটা বিপ্লব প্রয়োজন। নারী ভোগ্যপণ্য নয়, একজন মানুষ। তাই আজ আমি চন্দ্রাবতী নিয়ে লিখবো।
ফুলেশ্বরী নদীর তীরে ছবির মতো শান্ত সুনিবিড় একটি গ্রামের নাম পাটোয়ারী। সেখানে সাধক, কবিয়াল দ্বিজ বংশী দাস ও সুলোচনা দেবীর ঘরে চন্দ্রাবতীর জন্ম ও বেড়ে উঠা। নদীর তীরে গাঁয়ের গহীনে পুকুর পাড়ে ফুল আর লতা গুল্মের সাথে তার মিতালী। নদীর ওপারে নানাবাড়িতে তখন বালক জয়ানন্দের অবাধ বিচরণ। ফুল, পাখি আর ঘাস ফড়িং জয়ানন্দ ভালোবাসে চন্দ্রাবতীর মতোই। ভাব হয় দুজনের মধ্যে। মনের অজান্তেই কিশোর মনে ভাললাগা বাসা বাঁধে। সেই সময়টাতে মেয়েদের বিয়ে হতো খুব ছোটবেলাতেই। চন্দ্রাবতী বেড়ে উঠছিলো তার আপন মনেই, মেয়ের যে বিয়ে দিতে হবে সেই খেয়াল তখনো হয়নি সাধক দ্বিজ বংশী দাস এর। তিনি কবি মানুষ, কিছুটা উদাস।
ঘটকের আবির্ভাব একদিন দাস বাড়িতে, চন্দ্রাবতীর বিয়ে তো দিতে হবে, তাই না? পাত্র সেই জয়ানন্দ, যাকে চন্দ্রাবতী ইতিমধ্যেই পছন্দ করেছে। সুপাত্র, উচ্চ বংশ আর রূপে গুণেও অপূর্ব। তাই দ্বিমত করার কোন কারণ ছিলো না চন্দ্রাবতীর বাবার। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক হয়ে যায় কোন এক বসন্ত রজনীতে। যথা সম্ভব আয়োজন করা হলো বিয়ের। সনাতন বিবাহ, তাই আয়োজন ব্যাপক, সাথে নানা লোকাচার। হলুদ বরণ কন্যাকে সাত ঘাটের জলে ভেজানো হলো, শুধু সাত পাক ঘুরানো বাকি। কিন্তু পাত্র ছাড়া সাত পাক হয় কি করে? বিয়ের লগ্ন যে বয়ে যায় সেই বসন্ত তিথিতে... জয়ানন্দের দেখা নেই। তখন তো আর ফেসবুক, ইমো বা ভাইবার ছিলো না! না ছিলো মোবাইল ফোন।
ইতিমধ্যে ঘটে গেছে এক অঘটন! জয়ানন্দ এরই মধ্যে অপরূপ এক রূপসী রমনীর প্রেমে পড়ে যান। নাম তার আসমানি, স্থানীয় একজন শাসনকর্তা কাজী তার পিতা। ত্রিমুখী প্রেমের বিয়োগান্তক পরিণতির শুরুটা এখানেই। এখানেই বাঁক নিয়েছিলো ভুল পথে। এই প্রেম ভালোবাসার এক জটিল সমীকরণ তখনো অনেকটা বাকি। চন্দ্রাবতীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার প্রাক্কালে জয়ানন্দ প্রেমে পড়েন এক মুসলিম নারীর। একে তো জাতি-ধর্ম আলাদা, তার উপর আসমানির বাবা তখন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। আসমানির সাথে জয়ানন্দের বিয়ে ঠিক করেন কাজী, আর সেই খবরে মুষড়ে পড়েন চন্দ্রাবতী।
বঁধু সাজে বরের প্রতীক্ষায় চন্দ্রাবতী ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেননি এমন পরিণতির। প্রেম, ভালোবাসা আর বিয়ের প্রতি একটা অযাচিত বিরক্তি চলে আসে তার। রূপে আর গুণে চন্দ্রাবতী কম ছিলেন না, তাই বিয়ের প্রস্তাব এলেও ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। বরং বাবার কাছে করুণ মিনতি জানালেন আজন্ম চিরকুমারী থেকে শিবের উপাসনা ও সাহিত্য নিয়েই কাটিয়ে দেবেন বলে। কন্যার আবদারে সাড়া দিয়ে একটি শিব মন্দির গড়া হলো ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। অনেক সময় নিয়ে আরাধনা ও ধ্যানে কাটছিলো চন্দ্রাবতীর দিনরাত্রি।
অন্যদিকে আসমানির রূপের আগুনে মুগ্ধ হলেও গুণের বহর অজানা থাকায় জয়ানন্দের ভ্রম কাটে সহসা। কিন্তু ইতিমধ্যে ফুলেশ্বরীর জল অনেক দূর গড়িয়েছে। বুঝতে পেরেছেন চন্দ্রবতীর সাথে তিনি ভয়াবহ রকমের অন্যায় করেছেন। “যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার” তাই অনুতপ্ত জয়ানন্দ বলেই ফেলেন “তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম শেওড়া”।
আর মন টেকেনি জয়ানন্দের, ছুটে আসেন চন্দ্রাবতীর কাছে, তার শিব মন্দিরের দরজায়। ভরসা ছিলো জয়ানন্দের, চন্দ্রাবতী তাকে ক্ষমা করে দেবেন, জয়ানন্দ যে ভুল করেছে, তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে বুকে সাহস সঞ্চার করে কোন এক সন্ধ্যায় শিব মন্দিরের দরজায় করাঘাত করেন। কিন্তু অভ্যন্তরে বিরহে কাতর চন্দ্রাবতী তখন শিবের ধ্যানে মগ্ন হয়ে একমনে আরাধনায় নিমজ্জিত। জয়ানন্দের আকুল করা আহবান তার কর্ণ কুহরে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলো। তিনি ভাবলেন, চন্দ্রাবতী তাকে উপেক্ষা করছেন, তাই ফেরার পথে সন্ধ্যা মালতীর লাল রঙে একটি 'পদ' লিখে গেলেন চন্দ্রাবতী ও পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে।
প্রভাতের রাঙা আলোয় চন্দ্রাবতী বেড়িয়ে এলেন মন্দির ছেড়ে, জয়ানন্দের লেখা পদ দেখে ভীষণ বিরক্ত হয়ে ভাবলেন, সাধনার দেবালয় তার অপবিত্র হয়ে গেলো, ধুয়ে ফেলতে হবে এক্ষুনি। তাই কলসী কাঁখে ছুটলেন ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। সেখানে জল আনতে গিয়ে দেখতে পেলেন ফুলেশ্বরীতে ভাসছে জয়ানন্দের নিথর দেহ।
নিজেকে স্থির রাখতে ব্যর্থ চন্দ্রবতী ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে। নিজেকে অপরাধী ভাবলেন, জয়ানন্দের মৃত্যুতে নিজের দায় অস্বীকার না করে আত্মঘাতী হলেন। ত্রিভুজ প্রেমের করুণ পরিণতি এখনো আমাদের সাহিত্যে কান্না হয়েই ঝরে...
আজকের প্রজন্মের কাছে আমার অনুরোধ, নিজেকে জয়ানন্দ ভেবো না, আসমানিকে মন্দ বলো না। চন্দ্রাবতীকে বুঝতে চেষ্টা করো প্লিজ...
নারী তুমি ছলনাময়ী...
নারী তুমি অবলা...
নারী তুমি বোঝ কম...
নারী তুমি বেয়াদব, বেহায়া, নির্লজ্জ...
পুরুষ আমি!
আমি কি শুদ্ধ?
দাঁড়িয়েছ কখনো নিজের সামনে?
পুরুষ তুমি শ্রেষ্ঠ!
তবে কেন জন্ম তোমার নারীর গর্ভে?
(তথ্য সূত্র: অনলাইন ও অফলাইনের ইতিহাস, গীতিনাট্য এবং আমার স্মৃতি। তবে চন্দ্রাবতীর প্রতি আমার প্রেম এখনো সত্য...)
লেখক: উন্নয়ন কর্মী