হার না মানা এক শারমিনের গল্প
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৩৭
মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় ত্রিশোর্ধ্ব এক লোকের সাথে জোর করে বিয়ে ঠিক করে দেন মা। তাতে রাজি না হওয়ায় বিয়ের আগেই জোর করে ঐ লোকের সাথে সহবাসে বাধ্য করা হয়। কিন্তু নিজের এই জীবনকে নিয়তি বলে মেনে না নিয়ে লড়াই করেন শারমিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেই রুখে দেন বাল্যবিবাহের নামে নিজের জীবনের ধ্বংস।
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সত্যনগর গ্রামের কবির হোসেনের মেয়ে শারমিন। মা গোলেনূর বেগম। কবির হোসেন সৌদিপ্রবাসী হওয়ায় শারমিনকে নিয়ে তার মা গোলেনূর রাজাপুর শহরের থানা সড়কে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসের কথা। শারমিন তখন রাজাপুর পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। মা গোলেনূর এই বয়সেই শারমিনের বিয়ে ঠিক করেন প্রতিবেশী স্বপন খলিফার (৩২) সঙ্গে। কিন্তু শারমিন মায়ের এই অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে না নেয়ায় নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন মা। এতেও কাজ না হলে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। তাতেও রাজি না হওয়ায় একদিন ওই ছেলেকে (স্বপন) বাড়িতে এনে শারমিনকে তার মা বলে দেন, "এই ছেলে তোর স্বামী। ওর সঙ্গে তোর বিয়ে হয়েছে। এখন ওর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে হবে"।
মায়ের কথা শুনে শারমিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। স্কুলে আসা বন্ধ করে বাসার মধ্যে আটকে রাখা হলো তাকে। বাইরে গেলেও ছিল কড়া নজরদারি। বাবা তখন বিদেশে। কার কাছে যাবেন, কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না শারমিন।
সেই দুঃসময়ের স্মৃতিচারণ করে শারমিন বলেন, "সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। বয়স কম হলেও এটুকু বুঝতে পারছিলাম, আমার ওপর যা হচ্ছে তা পুরোপুরি অন্যায়। আমাকে ওই ছেলের সঙ্গে একটি ঘরে থাকার নির্দেশ দিলেন। এমনকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে আটকেও রাখলেন। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয়নি। বিয়ের বয়সও হয়নি। বিয়ের আয়োজন হয়নি, কবুল বলিনি, কোনো কাগজে সইও করিনি। কীভাবে এটা হলো। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল"।
শারমিন বলেন, "একবার চিন্তা করেছিলাম আত্মহত্যা করে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্ত হবো। কিন্তু পরে ভাবলাম, এটাও হবে হেরে যাওয়া। কিন্তু হেরে গেলে তো চলবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিই, যে করেই হোক আমাকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে"।
এর পরের গল্পটা শারমিনের সাহসিকতার ইতিহাস।
২০১৫ সালের ৬ আগস্ট। শারমিনকে চিকিৎসা করানোর কথা বলে তার মা খুলনায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে তোলেন। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন স্বপন। রাতে শারমিনকে ওই বাসায় স্বপন খলিফার সঙ্গে এক কক্ষে থাকার জন্য তার মা চাপ দিচ্ছিলেন। তাতে সম্মত না হওয়ায় মারধর করে তাকে (শারমিন) জোর করে স্বপনের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দেন মা।
কিন্তু ৭ আগস্ট সকালে শারমিন ওই বাসা থেকে কৌশলে পালিয়ে রাজাপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। স্বপন ও তার লোকজন শারমিনের পিছু নেয়। পিরোজপুরে এসে কথিত স্বামী স্বপন ও তার লোকজন শারমিনকে ধরে ফেলেন এবং বাস থেকে নামিয়ে রাজাপুরে নিয়ে শারমিনদের থানা সড়কের বাড়িতে আটকে রাখে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৬ আগস্ট বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় শারমিন। এক সহপাঠীনাদিরা আক্তারের বাড়িতে গিয়ে তাকে জানায় সবকিছু। এরপর দুজনে মিলে স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় সরাসরি ওই দিন রাতে রাজাপুর থানায় হাজির হয়। মা ও কথিত স্বামীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। পরে পুলিশ শারমিনের মা গোলেনূর বেগম ও কথিত স্বামী স্বপন খলিফাকে গ্রেপ্তার করে। ঝালকাঠির জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১–এর বিচারক মো. শফিকুল করিম শারমিনকে তার দাদি দেলোয়ারা বেগমের জিম্মায় দেন। এরপর থেকে সে দাদির কাছে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তার দাদি দেলোয়ারা বেগম এখন শারমিনকে নিয়ে এই বাড়িতেই থাকেন।
দেলোয়ারা বেগম বললেন, "ওরে নিয়া খুব চিন্তা আমার। প্রতিদিন স্কুলে নিয়া যাই, আবার সঙ্গে নিয়া আসি। বাইরে কোথাও গেলে সঙ্গে যাই। ওর জীবনটা ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছিল ওর মা। খুব সাহস করে একাই এর প্রতিবাদ করেছে। শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। এখন সবাই ওকে নিয়ে গর্ব করে। আমরাও গর্বিত"।
শারমিনের এই সাহসিকতার জন্য স্বর্ণকিশোরী ফাউন্ডেশন ২০১৫ সালে তাকে স্বর্ণকিশোরী পুরস্কার দেয়।
এখন লক্ষ্য কী? শারমিন দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, "আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা আছে। আর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা এবং সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে চাই"।