আদিবাসী ছাত্রীকে ধর্ষণচেষ্টা, ২৫ হাজার টাকায় নিষ্পত্তি!
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০১৭, ১৮:৪৭
গত ৮ জুলাই সকালে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার তবলছড়িতে এক আদিবাসী স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনার অভিযোগে ১০ জুলাই (সোমবার) সকাল ন'টার দিকে লাইস্র পাড়ার একটি পাড়া কেন্দ্রে স্থানীয় ইউপি মেম্বারের বরাবরে দায়ের করা মামলার সালিশ হয়েছে। এ সালিশে আসামীকে ৩০ বার বেত্রাঘাত দিয়ে ও অনাদায়ে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করিয়ে সালিশি রায় দেয়া হয়েছে বলে সালিশ সূত্রে জানা গেছে।
গত ৮ জুলাই (শনিবার) সকাল সাড়ে ন'টার দিকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার তবলছড়ি ইউনিয়ের ২নং ওয়ার্ডস্থ সুরুজ সরদার পাড়া এলাকায় লাইস্র পাড়ার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ত্রিপুরা কিশোরী (১৩)-কে শুকনাছড়ি সুরুজ সরদার পাড়ার সুরুজ মিয়া সরদারের ছেলে মো. শাকিব হোসেন ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনায় ভিকটিমের বাবাকে থানায় মামলা করতে গ্রামের কার্বারীসহ কতিপয় ব্যক্তি বাধা দিয়ে স্থানীয়ভাবে মীমাংসায় যেতে বাধ্য করে।
৯ জুলাই (রবিবার) মোঃ শাকিব হোসেনকে আসামী করে স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. তাজুল ইসলামের কাছে একটা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভিকটিমের বাবা। এর প্রেক্ষিতে ১০ জুলাই (সোমবার) সকাল ন'টায় সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়।
২নং তবলছড়ি ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য মোঃ তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে এ সালিশী মীমাংসা হয়। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাদেরও উপস্থিত ছিলেন।
সালিশ সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন, লাইস্র পাড়ার কার্বারী কলেন্দ্র ত্রিপুরা, ইউপিডিএফ প্রতিনিধি বিবরণ চাকমাসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের সদস্যবৃন্দ ও উভয় গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
সালিশের রায় হিসেবে আসামী মোঃ শাকিব হোসেনকে ৩০বার বেত্রাঘাত করা হয় এবং অনাদায়ে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়াও এ ধরণের কর্মকাণ্ড আর কোনোদিন করবে না মর্মে মোঃ শাকিব হোসেন ও তার বাবা মোঃ সুরুজ মিয়া সরদারের কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারনামা নেয়া হয়।
সালিশ সভার সূত্রমতে, ১১ জুলাই (মঙ্গলবার) এর মধ্যে জরিমানার টাকা কার্বারী কলেন্দ্র ত্রিপুরার হাতে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। কার্বারী জানান, এই ২৫ হাজার টাকা থেকে ভিকটিম পাবে মাত্র ১৮ হাজার টাকা। বাকী সাত হাজার টাকা কাচারী খরচ হিসেবে কার্বারী ও যুব সমাজ পাবে বলে সালিশে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে, মেম্বার মোঃ তাজুল ইসলাম জানান, সালিশের সিদ্ধান্তমতে, মঙ্গলবার পুরো ২০ হাজার টাকা ভিকটিমের বাবার হাতে দেয়া হবে। বাকী পাঁচ হাজার টাকা কার্বারীকে দেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, "আমিতো জানি না, ত্রিপুরা সমাজের নাকি এরকম প্রথা আছে যে, এরকম ঘটনা ঘটলে জরিমানা করে কিছু আয়োজন করে খেতে হয়। তাই তাদের দাবি মেনে নিয়ে পাঁচ হাজার টাকা তাদের জন্য বরাদ্দ করেছি"।
মেম্বার আরো জানান, সালিশ সভায় মেয়ের বাবা অনিরাপদ বোধ করে মেয়েকে আর স্কুলে পাঠাবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে, সালিশ সভার পক্ষ থেকে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরো জানা গেছে, আজ ১০ জুলাই (সোমবার) সকাল ন'টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সালিশ সভায় উপস্থিত থাকায় ভিকটিম আজ পরীক্ষা দিতে যেতে পারেনি।
ওয়ে আগে ৯ জুলাই (রবিবার) রাতে ভিকটিম'র সাথে মুঠোফোনে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার গণিত পরীক্ষা দিতে বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যায় সে। তার কাছে ছিল মা'র দেয়া ৩০ টাকা। টাকাগুলো সে হ্যান্ডবোর্ডের ক্লিপে রেখেছিল। যেতে যেতে হঠাত্ দেখে যে, ক্লিপে টাকা নাই। তাই সে টাকাগুলো খুঁজতে ফিরে যায়। পরীক্ষার সময় দেরী হয়ে যাবে বলে বান্ধবীরা তার সাথে না গিয়ে সোজা স্কুলে চলে যায়। টাকা খুঁজতে খুঁজতে সে একটা নির্জন এলাকায় পৌঁছলে হঠাত্ কী একটা শব্দ পেয়ে থমকে যায় সে। এসময় কিছু বুঝে না উঠতেই পিছন থেকে সুরুজ সরদারের ছেলে মো. শাকিব হোসেন তার চুলের মুঠি ধরে কোমরের বেল্ট টানতে শুরু করে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে পাশে একটা খাড়া সেগুন গাছের নাগাল পেলে মেয়েটি গাছটিতে ভর করে ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালিয়ে যায় স্কুলের দিকে। তারপর সে কোনোরকম পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ফেরে বিকালে।
এ ব্যাপারে ভিকটিমের বাবার সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি থানায় মামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে কার্বারী (গ্রাম প্রধান) কলেন্দ্র ত্রিপুরার পরামর্শ নিতে গেলে কার্বারীসহ অনেকে বিষয়টি স্থানীয় মেম্বারের মাধ্যমে মীমাংসা করতে পরামর্শ দেন। কার্বারীর পরামর্শে তবলছড়ি বাজারে গিয়ে মোকলেছ রাইটারের কাছে একটি দরখাস্ত লিখে ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. তাজুল ইসলামের নিকট জমা দিয়েছেন।
তবে ভিকটিমের বাবা জানান, তিনি পড়ালেখা জানেন না। দরখাস্ত লেখার পর তাকে পড়িয়ে শোনানো হয়নি। তিনি শুধু স্বাক্ষর করে সোজা মেম্বারের কাছে জমা দিয়েছেন।
এদিকে দরখাস্ত প্রাপ্তি স্বীকার করে মেম্বার জানান, দরখাস্তে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা বিষয়টি উল্লেখ নেই। বিষয়টিকে 'ইভটিজিং' বলে মন্তব্য করেছেন মেম্বার তাজুল ইসলাম।
তিনি জানান, দরখাস্তে লেখা আছে যে, "শাকিব হোসেন শুধু গতিরোধ করে মেয়েটির হাত ধরেছিল এবং মেয়েটি ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। দরখাস্তে ঘটনার বিবরণ মোতাবেক আমরা সালিশ রায় দিয়েছি"।
এই ঘটনার ব্যাপারে রবিবার বিকালে মুঠোফোনে মাটিরাঙা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহাদাত্ হোসেন টিটুর কাছে জানতে চাইলে, এরকম ঘটনার অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় আসেনি বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে, খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, "ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার মামলা গ্রাম্য সালিশে সমাধান করার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। একজন ইউপি মেম্বার এ ধরণের ঘটনার বিচার করার অধিকার রাখেন না। মামলাটি অবশ্যই থানায় দায়ের করার প্রয়োজন ছিল"।