ক্ষুধা আর মৃত্যুভয়ে দেশ ছাড়তে চান সাঁওতালরা (ভিডিও)
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৬
চারদিনে দু-একবেলা খেতে পেয়েছেন কেউ কেউ। আবার পেটে একেবারেই দানাপানি পড়েনি অনেকেরই। এ পর্যন্ত কিছু মানুষের কাছে খাদ্যসহায়তা পৌঁছুলেও বাকিরা অভুক্ত। থাকার জায়গা নেই, মাথার ওপর ছাউনি নেই, খাওয়ার কিছু নেই, নেই দুই আনা সম্বল। অনেকেই তাদেরকে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে চাইলেও সেখানে পৌঁছাতে বাঁধা দিচ্ছে পুলিশ।
এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে এলাকা ছেড়ে পাশের দেশ ভারতে চলে যাওয়ার সুযোগ চাচ্ছে রংপুর চিনিকলের বাগদাফার্ম এলাকার সাঁওতাল পরিবারগুলো। যদিও চারদিক ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও স্থানীয় ক্ষমতাশালীরা। তাদের বাঁধার মুখে গ্রাম থেকে কেউ চাইলেই বের হতে পারছেন না।
‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন কী করে বাঁচব রে বাপু! তিনদিন ধরে খেতে পাই না। বাইরেও যেতে পারি না। না খেয়ে এখানে আমরা মরে যাব। ভারতকে বলো গেট খুলে দিতে, আমরা চলে যাব। ক্ষুধার জ্বালা আর সইতে পারছি না।’’ কথাগুলো বলছিলেন বাগদাফার্মের পাশের গ্রাম জয়পুরের মিনতি কিসকু (৪৫)।
বাগদাফার্ম-সংলগ্ন সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম জয়পুর ও মাদারপুরের চারদিকে ব্যারিকেড আকারে মোতায়েন করে রাখা হয়েছে পুলিশ। আশপাশেই রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজন। গ্রাম দুটি থেকে কাউকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। অন্য কাউকে গ্রামে ঢুকতেও দেয়া হচ্ছে না। কেউ খাদ্যসহায়তা দিতে গেলে তাতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। গ্রাম দুটির নারী-পুরুষের মুখে অনাহারের ছাপ। বিশেষ করে শিশুদের মুখে এ মলিনতা আরো প্রকট।
অনাহার সহ্য করতে না পেরে গ্রাম থেকে বের হতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়ে ফিরেছেন সোসানা মুরমু (৬০)। শিশুদের স্কুলে যেতে দেয়া তো দূরের কথা, খাবার বা কাজের খোঁজে সোসানা মুরমুর মতো অনেকেই গ্রাম থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ বা ক্যাডার বাহিনীর মারধরের শিকার হয়ে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন।
জানা গেছে, এখানকার সাঁওতালরা বাপ-দাদার ভিটা থেকে প্রথমবার উচ্ছেদ হয়েছিলেন ১৯৬২ সালে। ওই সময় রংপুর চিনিকলের জন্য আখ চাষের কথা বলে তাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়। যদিও জমি হস্তান্তর চুক্তিপত্রে আখ চাষ না হলে জমি ফেরত দেয়ার শর্ত ছিল। ২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে আখের পরিবর্তে অন্যান্য ফসলের চাষ শুরু হয়। এ সুযোগে এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে জমি লিজ দেয় চিনিকল কর্তৃপক্ষ। শর্তভঙ্গের কারণে গত বছরের জুন থেকে সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে ১৯৬২ সালে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল ও বাঙালিদের উত্তরসূরি প্রায় আড়াই হাজার পরিবার। ৬ নভেম্বর রোববার সেখান থেকে দ্বিতীয়বারের মতো উচ্ছেদ হল তারা। এদিন পুলিশের সহায়তায় তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া ছাড়াও চাল-ডাল থেকে শুরু করে কাঁথা-বালিশ পর্যন্ত যা ছিল সবই লুটে নেয়া হয়। এ ঘটনার পর বাঙালি পরিবারগুলো নিজ গ্রাম থেকে বের হতে পারলেও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন সাঁওতালরা। দ্বিতীয়বার উচ্ছেদ হওয়ার পর জীবন বাঁচাতে এখন তারা দেশ ছেড়েই চলে যেতে চাচ্ছেন।
মাদারপুরের বাসিন্দা লুকাস মুরমু (৭০) বলেন, ‘চেয়ারম্যান বুলবুল আমাদের ভরসা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন শরীরের সব রক্ত দিয়ে হলেও আমাদের এখানে স্থায়ী বসতির ব্যবস্থা করবেন তিনি। আমাদের কেউ তাড়াতে পারবে না। আর সেই চেয়ারম্যানের সামনেই তার লোকজন আমাদের সব পুড়িয়ে দিল। চেয়ারম্যানই সব করালেন। আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। এখন এ দেশে থাকার আর কোনো ভরসা পাই না।’
জানাগেছে, বাগদাফার্মে বাপ-দাদার জমিতে বসতি স্থাপনের সময় সাঁওতালদের ভরসা দিয়েছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সদস্য। বিশেষ করে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হওয়ায় এ বিষয়ে অতি উত্সাহ দেখিয়েছিলেন সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুল। ওই সময় শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সাঁওতালদের বসতভিটা রক্ষা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। অথচ রোববার তারই উপস্থিতিতে হামলার ঘটনা ঘটল সাঁওতালদের ওপর। পুড়িয়ে দেয়া হলো তাদের বসতভিটা। উদ্বাস্তু হয়ে পড়া সাঁওতালরা বর্তমানে আবারো হামলার আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছেন।