হাসনাতের মোবাইল থেকেই বাইরে ছবি পাঠায় জঙ্গিরা

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০১৬, ১৪:২০

জাগরণীয়া ডেস্ক

হাসনাত করিম এর অবস্থান নিয়ে এক মাস লুকোচুরি আর ধোঁয়াশার পর অবশেষে যথেষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে রিমান্ডে নেয়া হলো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যলয়ের এই সাবেক শিক্ষককে। সেইসাথে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে তাকে সহযোগিতা করা কানাডার নাগরিক তাহমিদ হাসিব খানকেও গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

গত মঙ্গলবার পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, হলি আর্টিসান রেস্তোঁরায় জঙ্গিদের হাতে বিদেশিসহ ২০ জন নিহত হওয়ার পর থেকে হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খান পুলিশের ‘নলেজে’ আছেন। কিন্তু অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এ জন্য তারা না পারছিলেন হাসনাত করিমকে ছেড়ে দিতে, না পারছিলেন গ্রেফতার দেখাতে। ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে পুলিশের জঙ্গি বিরোধী অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত ও ১ জন গ্রেফতার হয়। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে একজন ছিল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী তাজ-উল-ইসলাম রাশিক যে কিনা মার্কিন নাগরিকও ছিল। গোয়েন্দারা ধানমন্ডির ১১/এ নম্বর সড়কের ৭২ নম্বর বাড়িতে রাশিকের বাবা রবিউল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানান যায়, গত বছর হাসনাত রেজা করিম দুই বার রাশিকের সঙ্গে দেখা করতে বাসায় এসেছিলেন। এই থেকেই হাসনাত করিমের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এরপর গোয়েন্দাদের নজরদারিতে থাকা স্থান থেকেই হাসনাত করিমকে গ্রেফতার দেখানো হয়। 

অবশেষে বুধবার রাতে তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই সঙ্গে গতকাল তাদেরকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। অন্যদিকে হাসনাত ও তাহমিদের আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। 

পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিম নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের একজন সক্রিয় সদস্য। তার সহযোগী কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খান। তাহমিদ বিভিন্ন সময় হাসনাতকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা আক্রমণ করলে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এই দুই জন। ওই বেকারিতে তারা উপস্থিত থেকে জঙ্গিদের সরাসরি সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া হাসনাত করিমের মোবাইল ফোনে নতুন একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে বাইরে ছবি পাঠায় জঙ্গিরা’।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ড আবেদনে আরো বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার দিন জঙ্গিরা তাদের নিজস্ব যোগাযোগের জন্য ‘উইকার’ (Wickr) নামে একটি অ্যাপস ব্যবহার করে। হাসনাতের মোবাইলে অ্যাপসটি পাওয়া গেছে। জঙ্গিরা রাত ৮টা ৪৪ মিনিটে হলি আর্টিজানে প্রবেশ করে ৮টা ৫৭ মিনিটে তার মোবাইলে অ্যাপসটি ডাইনলোড করে। অ্যাপসটি ব্যবহার করে সাধারণত জঙ্গিরা  যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য তথা জঙ্গিরা কী ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করেছিল, সে বিষয়ে জানার জন্য তাকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন। উইকার একটি যোগাযোগ অ্যাপস, ব্যবহারকারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে এটি। যে ডিভাইসে এটি ব্যবহার করা হয় সেই ডিভাইস থেকে সব ধরনের মেসেজ, ছবি ও ভিডিও কনটেন্ট মুছে ফেলা যায়। এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি।

তবে হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানের আইনজীবীরা শুনানিতে আদালতকে বলেন, তারা এ ঘটনার কিংবা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে মোটেও জড়িত নন। তারা ৩২ দিন ধরে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। তাই রিমান্ড আবেদন বাতিল করে তাদের জামিনের আবেদন করেন।

শুনানি শেষে মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন দুইজনকে আট দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, বুধবার রাত পৌনে নয়টার দিকে হাসনাতকে গুলশান থেকে ও তাহমিদকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এখন পুলিশ তাদের রিমান্ডে নিয়েছে, বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

উল্লেখ্য, হাসনাত করিম বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিক। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার সময় হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে ২০১২ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দাবি করেছে, হাসনাত রেজা করিমের বিরুদ্ধে হিযবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। তিনি ঐ সময় স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন।

ব্রিটেনের নাগরিক হলেও সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আবার যোগদান করেন। গুলশানের হামলার পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তাদের ওয়েবপেজে শিক্ষকদের তালিকা থেকে হাসনাত করিমের নামটি মুছে ফেলে। এরপর হাসনাত করিম তার বাবা রেজাউল করিমের বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিং নামে প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসাবে যোগ দেন। গুলশান-২-এর ৫ নম্বর রোডের ৬৮/এ নম্বর বাড়িতে তিনি বাবা-মার সঙ্গে বসবাস করেন। হাসনাতের দাবি, মেয়ে শেফা করিমের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি হলি আর্টিসানে সপরিবারে গিয়েছিলেন। তবে গোয়েন্দাদের দাবি, এটি ছিল তার লোক দেখানো একটি পরিকল্পনা। কারণ হলি আর্টিজানের মতো একটি স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে একটি ধর্মপ্রাণ পরিবারের জন্মদিন পালন করাটা ছিল 'এক ধরনের নাটক'।

অন্যদিকে তাহমিদ হাসিব খান আফতাব বহুমুখী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রহিম খান শাহরিয়ারের ছেলে। তিনি কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং কানাডার নাগরিক। গুলশান হামলার দিনই দুপুরে ঢাকায় আসেন তাহমিদ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত