‘নারী যে থানায় যাবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে’
প্রকাশ : ৩০ মে ২০১৮, ১৪:৫৪
নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া যৌন হয়রানিসহ সকল ধরনের অপরাধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনার মধ্যে দ্রুত অভিযোগ নেয়া, দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা করানো ও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএ টেস্ট অন্যতম৷ ফলে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণ আগের চেয়ে আরো সহজ হবে৷
শুধু ধর্ষণ নয়, সব ধরনের যৌন হয়রানির ব্যাপারেই আদালতের এই নির্দেশনা৷ আর ঘটনার শিকার নারী যে থানায় যাবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ তাদের থানা এলাকার ঘটনা নয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না৷ আদালতের এই নির্দেশনার ফলে নারীরা অভিযোগ দাখিলে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন নারীনেত্রী ও আইনজীবীরা।
হাইকোর্ট গত ২৭ মে (রবিবার) এক আদেশে এই ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছেন। আদালত বলেছেন, এই ১৮ দফা নির্দেশনার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে৷
আদালতের নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাত্ক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ কর্মকর্তা যদি অভিযোগ নিতে দেরি করেন, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বিধান তৈরি করতে হবে৷
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২১ মে রাতে ঢাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গারো তরুণী। রাত ৯টার দিকে কাজ শেষে ওই তরুণী কুড়িল থেকে উত্তরার বাসায় যাওয়ার পথে একটি সিএনজি স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন একটি মাইক্রোবাস থেকে দুই যুবক নেমে অস্ত্র দেখিয়ে মুখ চেপে ধরে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। ওই গাড়িতেই পাঁচজন তাকে ধর্ষণ করে। রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে দৃর্বৃত্তরা উত্তরার একটি সড়কে ফেলে দিয়ে মাইক্রোবাসটি নিয়ে পালিয়ে যায়। রাতেই ওই তরুণী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রথমে তুরাগ থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ মামলা না নিয়ে তাদের ভোররাত ৪টার দিকে ফিরিয়ে দেয়।
এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও তাদের এলাকার ঘটনা না বলে মামলা নেয়া হয়নি। সবশেষ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নেয় ভাটারা থানা।
ওই তরুণীকে চিকিত্সা ও ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয় আরো একদিন পর। এই ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও ব্লাস্টসহ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন বাদী হয়ে হাইকোর্টে রিট করে। রিটের শুনানি করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ ওই বছরের ২৫ মে রুল জারি করে।
২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেয় আদালত। আদালত তখন কিছু নির্দেশনাও দেয়। চলতি বছরের গত রবিবার (২৭ মে) প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে ধর্ষণের বিষয়ে ১৮ দফা নির্দেশনাসহ পরামর্শ দেন আদালত।
নির্দেশনায় বলা হয় কোন থানার আওতার মধ্যে ঘটনা সংঘটিত হোক-বা-না-হোক, সেটা মুখ্য নয়। অবিলম্বে এমন একটি সার্ভার তৈরি করতে হবে, যেন এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে করা যায়। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করেন, তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট বিধান তৈরি করতে হবে। রায়ে বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে।
একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে। এছাড়া যেকোনও রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যেকোনও ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক থানায় কনস্টেবলের নীচে নয়, এমন একজন নারী পুলিশ রাখতে হবে।
অভিযোগ পাওয়ার পর ডিউটি অফিসার একজন নারী কর্মকর্তার (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাধ্যমে ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্খী, সমাজকর্মী বা আইনজীবীর উপস্থিতিতে অভিযোগ রেকর্ড করবেন। সবক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সমস্ত তথ্য সংরক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক থানায় ভুক্তভোগীদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ নারী-সমাজকর্মীদের একটি তালিকা রাখার কথা বলা হয়েছে। অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দেয়া অধিকার সম্পর্কে ভুক্তভোগীকে সচেতন করতে হবে।
আদালতের নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, অভিযোগ পাওয়ার পর তাত্ক্ষণিকভাবে ডিউটি অফিসার 'ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার'কে জানাবেন। ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার কোনও নারী বা মেয়ে করণীয় সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম হলে, তাঁকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। লিখিত তথ্য গ্রহণের পর কোনও ধরনের বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুক্তভোগীকে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন। ভুক্তভোগীর দ্রুত সারিয়ে তুলতে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকতে হবে।
নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে '১০৯' নাম্বারে ফোন করে যেন প্রতিকার পেতে পারে, সে বিষয়টি প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ওয়েব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আদালত বলেছে, এই ১৮ দফা নির্দেশনার ভিত্তিতে সুনির্দষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
হাইকোর্টের এই সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা ও আইন তৈরি করতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার নারী অভিযোগ করতে গিয়ে এবং ঘটনা প্রমাণ করতে নানা হয়রানির শিকার হন। আর ডাক্তারি পরীক্ষা দেরি হলে ধর্ষণের অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়। তার প্রতিকার পেতেই আমরা ওই রিটটি করেছিলাম। আদালত যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে ভুক্তভোগীর হয়রানি কমবে এবং ঘটনা প্রমাণ আগের চেয়ে সহজ হবে।’
তিনি বলেন,‘আদালতের নির্দেশনা অনুয়ায়ী, থানা মামলা নিতে আর দেরি করার সুযোগ পাবে না, কারণ যে থানায়ই ভিকটিম হাজির হবেন, সেই থানাকেই মামলা নিতে হবে। আর ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে মামলা দেয়ার পরপরই। এরফলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাবে। ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক এবং তা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করার যে নির্দেশ হাইকোর্ট দিয়েছেন, তা-ও অনেক সহায়ক হবে ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য।’
ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, ‘এর আগেই কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আর টু-ফিঙ্গার টেস্টও নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা বাস্তবায়ন হতে দেখি না। আমাদের সবাইকে প্রথম যেটা বুঝতে হবে তা হলো, হাইকোর্ট ধর্ষণ নিয়ে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, সেটা আইন। এই আইন মানা বাধ্যতামূলক। আইন না হওয়া পর্যন্ত এটাই আইন।’
তিনি বলেন, হাইকোর্টের এই ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং সরকারকে এটা কার্যকর করতে হবে। তবে মিডিয়াকেও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। আদালতের রায়ে সেই নির্দেশনাও আছে।