বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, ধামাচাপা দিতে নির্যাতন
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০১৭, ১৭:১৬
ক্যাডার দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি, বিষয়টি ধামাচাপা দিতে দলীয় ক্যাডার ও এক নারী কাউন্সিলরকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পেছনে লেলিয়ে দিয়ে ঐ কিশোরী ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালানো হয়। এরপর দুজনেরই মাথা ন্যাড়া করে দেন তারা।
নির্যাতনের শিকার কিশোরী ও পুলিশ জানায়, মেয়েটি এ বছর বগুড়া শহরের একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। তার বাবা গ্রামীণ বাজারে সামান্য পুঁজির ব্যবসা করেন। আর মা ঢাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। এতদিন মেয়েটি বগুড়া শহরে নানীবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। তবে কিছুদিন আগে মা বগুড়ায় ফিরে গেলে সে তার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করে।
ঘটনার শিকার কিশোরী জানায়, মাস দেড়েক আগে সে রিকশায় চড়ে যাচ্ছিল। পথে চকযাদু ক্রস লেনে শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে তার রিকশা থামায় তুফানের সহযোগী আলী আজম। তিনি মেয়েটির মুঠোফোন নম্বর চান। সে একটি ভুয়া নম্বর দিয়ে চলে যায়। সপ্তাহখানেক পর তার নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দেন তুফান সরকার। নানা জিজ্ঞাসার একপর্যায়ে তুফান মেয়েটিকে বলে, তাকে সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তির সব ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। এ জন্য এসএসসি পাসের কাগজপত্রসহ চার হাজার টাকা দিতে বলেন। কথামতো সে তুফানের সহযোগী আলী আজমের হাতে টাকাসহ কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়।
মেয়েটি আরও জানায়, ১৭ জুলাই তুফান সরকার তাকে ফোন দেন। তখন তুফান তাকে বলেন, ‘ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি, তুমি বাসায় এসে কাগজপত্র নিয়ে যাও’। কিন্তু সে বাসায় যেতে রাজি হয়নি। এরপর তুফান সরকার তার সহযোগীদের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ি পাঠিয়ে মেয়েটিকে নিজের বাসায় তুলে নিয়ে যান। এ সময় বাসায় তুফানের স্ত্রী বাসায় ছিলেন না। সেখানে মেয়েটিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তিনি ধর্ষণ করেন। এতে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় তুফান তার ক্যাডার আতিকুর রহমানকে ওষুধ কিনে দিতে বলেন। আতিকুর স্থানীয় দোকান থেকে ওষুধ কিনে দিয়ে তাকে বাসায় পৌঁছে দেন। আর ধর্ষণের বিষয়টি ফাঁস না করার জন্য ভয় দেখানো হয়।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন তুফানের স্ত্রী আশা সরকার ও স্ত্রীর বড় বোন পৌর কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তার। গত ২৮ জুলাই (শুক্রবার) বিকেলে তারা ৮-১০ জন ক্যাডার পাঠিয়ে ওই কিশোরী ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে আনেন। প্রথমে মার্জিয়া নিজে এবং পরে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা সরকার ও শাশুড়ি রুমি বেগম মা-মেয়েকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এরপর তুফানের তিন সহযোগী প্রায় চার ঘণ্টা ধরে তাদের বেধড়ক মারধর করেন। এরপর তারা নিজেরা এবং পরে নাপিত ডেকে দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেন। এরপর সাদা কাগজে সই নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বগুড়া ছেড়ে চলে যেতে বলা হয় তাদের। না গেলে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়। তারা সেখান থেকে চলে আসার পর স্থানীয় এক প্রতিবেশী অসুস্থ মা-মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপরই ঘটনাটি জানাজানি হয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কিশোরী ও তার মায়ের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এর পেছনে যত বড় রাঘববোয়ালই থাকুক না কেন, কেউ রক্ষা পাবে না।
কিশোরী ধর্ষণ ও মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে ২৯ জুলাই (শনিবার) সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন বগুড়ার জেলা পুলিশের মুখপাত্র এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় কিশোরীর মা বাদী হয়ে ২৮ জুলাই (শুক্রবার) রাতে শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার, তার স্ত্রী আশা সরকার, আশা সরকারের বড় বোন বগুড়া পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তারসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগে দুটি মামলা করেছেন। পুলিশ সেই রাতেই শ্রমিক নেতা তুফান সরকার, তার সহযোগী শহরের চকসূত্রাপুর কসাইপট্টির আলী আজম ওরফে ডিপু, খান্দার এলাকার আতিকুর রহমান এবং কালীতলা এলাকার রূপমকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে নারী কাউন্সিলর ও তার মা-বোন বর্তমানে আত্মগোপন করে আছেন।
পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তুফান সরকার মেয়েটিকে কলেজে ভর্তির কথা বলে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছেন বলে স্বীকার করেন। এরপর তার সহযোগীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করা আতিকুর রহমান ২৮ জুলাই (শুক্রবার) আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
নির্যাতনের শিকার অসুস্থ মা-মেয়েকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আজ ৩০ জুলাই (রবিবার) সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোতালেব হোসেন বলেন, মেয়েটির শরীরের সাত-আট স্থানে রড বা লাঠির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন সে শঙ্কামুক্ত। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আছাদুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি বিব্রত। এ ধরনের ঘটনা যদি আমার নিজের কেউ ঘটাত, তারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইতাম, এখনো চাই। সহযোগী সংগঠনের একজন নেতার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যারা তুফান সরকারের মতো ব্যক্তিকে সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদ দেন, এ ঘটনার জন্য তারাও কম দায়ী নন’।