খালিপেটে বদহজম

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ২২:০২

১।
আমার পিসতুতো দাদা ছোটবেলায় একবার তার খেলার সাথীর নাম জানতে চায়। ছেলেটি তার সমবয়সী, ধরা যাক বছর পাঁচেক হবে। উত্তর দিল, “মুস্তাকুল”। জবাব শুনে দাদার সে কি দারুণ অট্টহাসি! হাসি যেন থামেই না। হাসির সাথে কতটা তাচ্ছিল্য মিশিয়ে দাদার উচ্চারণ, “মুস্তাকুল! ইটা কুনো নাম নি? ভগবানে দেখি ইগুরে নামও দিসে না!” (মুস্তাকুল! এটা কোন নাম হল? ভগবান দেখি এটাকে নামও দেননি!”)

এখনও কোন হাসিঠাট্টার আড্ডা জমে উঠলে এই গল্পে ফিরে যাই মাঝে মাঝে। সোফা ভর্তি লোক হেসে ওঠে মুস্তাকুলের অসভ্য, অভাবনীয় নামকরণের কাণ্ডে। আমিও বেশ জমাটি একটা গল্প বলতে পেরে তৃপ্ত হই। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াই, কারণ গল্পটা আমার ততটুকুই জানা। আমি জানতে পারিনি কখনও দাদার এমন হাসি ও হাসির পরবর্তী শ্লেষ-মাখা কথা শুনে মুস্তাকুল কী বলেছিল। এর পরও কি মুস্তাকুল দাদার সাথে খেলতে আসত? আমি জানতে পারিনি, জানতে চাইনি। কারণ আমি হাসির দায় নিতে শিখেছি বটে, নৈঃশব্দের দায় কেবল এড়াতেই শিখেছি, আমার খুব পরিচিত একটা গোটা জাতির, দেশের মত।

২।
২০১০ সালে আমার প্রথম বাংলাদেশ যাত্রা। আশেপাশে সবকিছু দেখতাম প্রথমে ট্যুরিস্টের চোখ দিয়ে। তারপর অনেক সময় কাটলে বুঝতে পেরেছি যে ওটা ট্যুরিস্ট নয়, অন্যকিছু। বাংলাদেশকে জানাবোঝার শুরুর দিনগুলিতে আমার ব্যবহারে প্রচ্ছন্ন ছিল ভারতীয় ফোঁপরদালালি চরিত্র। এক্ষেত্রে শুধু ভারতীয় বললে ভুল হবে। আমার দৃষ্টি ছেয়ে ছিল হিন্দু, মধ্যবিত্ত, শহুরে সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক একজন ভারতীয়ের চেতনায় ফুলে ফেঁপে ঢোল। ফলত, যা দেখছি তাকেই আমার মত করে এক্সটিসাইজ করে ফেলার প্রবণতাও কম ছিল না একটুও।

আমি এসেছিলাম এমন এক দেশ থেকে যেখানে চারিদিকে কেবল সংখ্যার রাজত্ব। যেখানে সংখ্যাই ঠিক করে দেয় কে থাকবে কে থাকবে না, কাকে স্বাগত, আর কে অনাগত। আমিও সেই তালে তাল মিলিয়ে হয়ে উঠেছিলাম সংখ্যার হিসেবে পৃথিবীকে চিনতে। অভ্যস্ত ছিলাম না আমার দেশের এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে দশ মিনিটের ব্যবধানে অন্য দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে দেখতে। আর সেই গোষ্ঠীর কথ্যভাষায় বাক্যালাপ করতে তো আমি মোটেও অভ্যস্ত ছিলাম না। সেই অনভ্যাসের ফলেই সিলেটের বাবু-লিটনকাকুদের দিদিকে ফুফু ডাকতে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়েছিলাম। পরিবারের কোনজন ‘আপা’ আর কাকে ‘আপু’ সম্বোধন করব, এই মধ্যে তফাত বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো আমায়, মনে আছে। কাকে কী বলব আর কাকে কী একদম বলা চলবে না, তা ঠাহর করতে করতেই প্রথমবারের মতন ‘বিদেশ’ সফর চুকে গেল আমার।

বাড়ি এসে বুঝলাম, আসলে বিদেশ যাইনি মোটেও, অজানা, অদূরের পড়শিদের চিনতে গিয়েছিলাম মাত্র। কোন আবেগী কথা নয়, এই পড়শিরা আমার সাথে একই দেশে, একই রাজ্যের একই শহরে থাকে। আমার সাথে একই স্কুল-কলেজে যায়। কিন্ত তাও সে পড়শিই, পাশের পাড়ায় থাকে, আমার পাড়ায় নয়। অতএব এরা পর, অন্য। ইংরিজেতে যাকে বলে ‘Other’- আমার পড়শি সেই অন্য পাড়ার লোক। এই পাড়া স্রেফ ভৌগোলিক অবস্থান নয়, চিহ্নিত করে দেয় সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থান ও সর্বোপরি একটি মানসিকতাকেও।

৩।
এখন ২০১৭ সাল। সেক্যুলার হওয়ার বাণী এখন ছেঁড়া জিন্সের মতই সমানভাবে হাল ফ্যাশনের অংশীদার। কিন্ত অজ্ঞানতার ঠ্যালায় সেক্যুলার হতে চাওয়াও বড্ড বেদনাদায়ক। সর্বধর্মসমন্বয় হোক চাইব, কিন্ত পাশের পাড়ার আকিকা আর এ পাড়ার অন্নপ্রাশনের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে অকারণ সেলফোনের কীপ্যাডে আঙুল চালিয়ে প্রশ্নের বাণ নিপুণভাবে এড়িয়ে যাব।

আমার সিলেট-নিবাসী এক ছোট বোন, রামিসা, তার দিদি সালোয়াকে একদিন প্রশ্ন করেছিল। “আচ্ছা আপু, তুমারে আমি আপু ডাকি, তে ডানাদিদিরে দিদি ডাকি কেনে?” (আচ্ছা দিদি, তোমায় আমি আপু ডাকি, তাহলে ডানাদিদিকে কেন দিদি ডাকি?) বদলে সালোয়া একখানা দারুণভাবে রাজনৈতিক অথচ সহজ উত্তর দিয়েছিল তিন বছরের রামিসাকে। “ডানাদিদি ইন্ডিয়ায় থাকেন তাই তাকে দিদি ডাকো, আমি সিলেটে থাকি তাই আমি আপু।”

যার দেশে যে গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার ভাষাতেই, তার ভাবার্থেই ভাবতে, বুঝতে শিখবে সেই দেশের আপামর জনসাধারণ। থাকুক না সে দেশে অন্য পাড়ার লোকেরা। থাকুক দেশের নামের পেছনে আলতো করে একখানা লেজুড়-গণতন্ত্র। জাতির চেতনার পথ কিন্ত একটাই।

আর সেই চেতনার তেলে দেশকে ডুবিয়ে জাতীয়তাবাদের, থুড়ি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের গরম গরম ফুলুরি ভাজা চলছে রাস্তার পাশে, হাট-বাজার থেকে ইস্কুল-কলেজের বইপত্রেও।

কারণ সংখ্যা সর্বত্র থই থই করছে। বইয়ের পাতা থেকে রাস্তার মাইলফলকে।

আর এই সুযোগে দেশের চূড়ান্ত বদহজম হয়েছে। খালি পেটে সংখ্যায় কিঞ্চিৎ বেশি ফুলুরি খেয়ে।

লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত