পরকীয়া: নারীর কফিনে শেষ পেরেক

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২৩:০৬

এক সহকর্মীর দৃষ্টিতে 'মৃদুভাষী', অন্য সহকর্মীদের দৃষ্টিতে 'গালাগালভাষী'। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানভীর আহমেদ তার সাবেক স্ত্রী আকতার জাহানকে একাডেমিক সভায় গালাগালি ও হয়রানি করতেন বলে সম্প্রতি তথ্য প্রমাণ মিলেছে। শুধু তাই নয় বিভাগের অন্য নারী সহকর্মীদের সাথেও তিনি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর সোমবার রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৬ জন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এই অভিযোগ লিখিতভাবে জানিয়েছেন। তবে দু'জন শিক্ষক জনাব সেলিম রেজা নিউটন ও সোমা দেব ঐ অভিযোগ পত্রে স্বাক্ষর করেননি। উল্লেখ্য, সোমা দেব তানভীর আহমেদের বর্তমান স্ত্রী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান সভাপতি প্রদীপ কুমার পাণ্ডেও ঐ ১৬ শিক্ষককের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। দেরীতে হলেও সহকর্মীরা জলির পাশে দাঁড়িয়েছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন যা তাঁদের নৈতিকতার দীপ্ত প্রকাশ।

আকতার জাহান জলির লাশ দাফন হওয়ার আগেই জনাব তানভীর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন যে ‘গতকাল থেকে মিডিয়াসহ অনেকেরই কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। তাই কিছু উত্তর এখানে দিয়ে রাখলাম'। সেখানে তিনি যে কথাটি জানিয়েছেন তা হচ্ছে জলির সাথে জুনিয়র এক সহকর্মীর পরকীয়া প্রেম থাকার কারণে তাদের সংসার ভাঙনের সূত্রপাত হয়।

পক্ষান্তরে জলি তার সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেছিলেন তার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নন। সত্য উদঘাটনে তাদের উভয়ের বিপরীতধর্মী বক্তব্য দু'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে জীবিত সাবেক স্বামী মৃত স্ত্রীকে চরিত্র হনন করে অপবাদ ছুঁড়ে দিয়েছেন, অন্যদিকে 'কেউ দায়ী নয়' বলে সাবেক স্বামীকে দায়মুক্ত করে গেছেন জলি। নিজের জীবনটি দিয়েও এতটুকু সম্মান পাননি এক সময়ের জীবন সঙ্গীর কাছে জলি। অথচ তানভীর নিজের কৃতকর্মকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো পরকীয়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ যেনো ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না অবস্থা!

যদি তানভীর আহমেদ এর সাথে জলির সংসার করা অবস্থাতেই পরকীয়া প্রেম থেকে থাকতো তাহলে আজ তানভীরের যে রকম দ্বিতীয় সংসারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, আকতার জাহানেরও সেরকম সংসারের খোঁজ পাওয়া যেতো। বাস্তব জীবনে এরকম কিছু দেখা যায়নি। দৃশ্যমান দ্বিতীয় সংসার পাতা জলির সাবেক স্বামীকে পরকীয়ার কোন ধরণের দোষ না দিয়ে এবং কাউকে দায়ী না করে নিজেই ক্ষয়ে গেছেন জলি। সাবেক স্বামীর মতো সাক্ষীও হাজির করেননি, সুইসাইড নোটেও উল্লেখ করে যাননি কোন পরকীয়ার 'শোনা কথা' কানে এসেছে বলে। এতে বোঝা যায় যে দু'জনের মধ্যে নৈতিকতা, আদর্শ এবং মূল্যবোধের বিস্তর পার্থক্য ছিলো।

তাই একান্ত ব্যক্তিগত দাম্পত্যের বিষয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি না করে নিভৃতে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। পিতৃতন্ত্রের ছাঁচে গড়ে ওঠা সমাজ তার সারল্য, তার রুচিবোধকে কটাক্ষ করে তাকে অপরাধী হিসাবে দায়ী করতে চেয়েছে। সে অপরাধবোধে ইন্ধন দিতে কাছের নারীরাও কুণ্ঠাবোধ করেন নি। মেলানিনের তারতম্যের কারণে সাদা চামড়ার জয় জয়কারের এই সমাজ তাকে 'কালো মেয়ে' সম্বোধন করেছে। করেছে দোষারোপ। অর্থের অভাবে, হতাশায় কোনোমতে মেলামাইনের প্লেটে যাপিত জীবনকে উপহাস করেছে।

যে মানুষ জাগতিক জীবনের মোহ ত্যাগ করতে পারে তার কাছে সোনার চামচ আর রূপার প্লেটে ভাত খাওয়ার চাহিদা হাস্যকর, যা জীবন ভোগের নেশায় মগ্নদের বোঝা কঠিন। অন্যে সকলের মতো এই জাগতিক সমাজ সংসারের হিসেব কিতেব হয়তো আর মেলাতে পারছিলেন না তিনি। ভালোবেসে যে হাতটি তিনি ধরেছিলেন সে হাতটি অবলীলায় অন্যের হয়ে যাওয়া, এমনকি নিজের বুকের ধনটিও অন্যের হয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি তিনি। পৃথিবীতে সকল মানুষ যুদ্ধবাজ, কৌশলী আর আত্মপ্রেমী হয়ে জন্মান না। বেঁচে থাকার এই কাড়াকাড়ি ষড়যন্ত্রে চরম ঘৃণায় তাই মৃত্যুকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি।

আমাদের সমাজ নারীকে শেখায় পরিনতি মেনে নিতে, ঘুরে দাঁড়াতে নয়। শেখায় মানিয়ে চলতে। জলির আত্মহত্যার জন্য উপযুক্ত শাস্তি দিতে হলে তাই দিতে হবে এই অবকাঠামোকে, এই স্বার্থপর সমাজকে, চারপাশের সম্পর্ক হারানোর ভয়ে চুপ করে থাকা মানুষগুলোকে।

আমাদের দেশে নারীর হত্যা রহস্যের মোড় ঘোরানোর নতুন এক কৌশল পরকীয়া। শুধু পুরুষই নয়, পুরুষতান্ত্রিক নারীরাও এই কৌশলের আশ্রয় নেয়। কারণ পরকীয়ার গুঞ্জন কনকর্ডের গতির চেয়েও দ্রুত ধাবমান। পরকীয়ার প্রচারণায় লিপ্ত নারী-পুরুষ উভয়েই এতে এক ধরণের যৌন উত্তেজনা অনুভব করেন। এখানে বিবেকের চেয়ে নিষিদ্ধ আনন্দ অনেক বেশী উপভোগ্য, উপাদেয়, রসালো, উত্তেজনাকর। একজন মৃত মানুষের স্মৃতিচারণায় পরকীয়ার অপবাদ ''কানে এসেছে বলে'' কালিমা গেঁথে দিতে নির্মম মানুষের একটুও বাঁধে না। এমনটি দেখেছি সাগর-রুনীর হত্যার ঘটনায় শুধু রুনীর বেলায়ও। যেখানে সাগরকে নয়, রুনীকেই অভিযুক্ত করা হয়েছিলো পরকীয়ায়। গৃহবধূক মিতু, শিক্ষক রুমানা, তনু এরাও রেহাই পাননি এই অভিযোগ থেকে। আত্মহত্যা, খুন হওয়া নারীর কফিনে পরকীয়ার শেষ পেরেকটি গেঁথে দিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে লম্পট পুরুষ আর তাদের ক্রীড়ানকে পরিণত হওয়া কিছু নারী।

লেখক: সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশিক্ষণ), বিমান বাংলাদেশ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত