পাহাড়ে কী করা দরকার

প্রকাশ : ২১ জুন ২০১৭, ১৯:২৩

শক্তিপদ ত্রিপুরা

প্রথমে বলে রাখি, আমি কোনো প্রকৃতিবিজ্ঞানী বা পরিবেশবিদ নই। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সাধারণ জ্ঞানের আলোকে আমি রাঙামাটির প্রাকৃতিক বিপর্যয়, এর কারণ ও প্রতিকারের বিষয়ে কিছু কথা বলব। রাঙামাটি জেলায় এ মাসে পরপর দুটি বড় ঘটনা ঘটেছে। তার একটি সরাসরি মনুষ্যসৃষ্ট, যা লংগদুতে সংঘটিত হয়েছিল, অন্যটি রাঙামাটি সদরে, যা মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। শেষেরটির জন্য দায়ী মূলত মানুষ। প্রকৃতির ওপর মানুষের মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারের ফলে পাহাড়ধস হয়েছে, তার ফলে শতাধিক মানুষ মারা গেছে; ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বিপর্যস্ত হয়েছে, হাজার হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে।

পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বনের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. খায়রুল ইসলামের মতে, পাহাড়ে বনভূমি কমে যাওয়ার সঙ্গে পাহাড়ধসের সরাসরি সম্পর্ক আছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে বনভূমি ধ্বংস হওয়া বা কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস এবং ওয়াটারএইডের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, গত এক যুগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ধরনের বনভূমি কমেছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৬ হেক্টর। [সূত্র: প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০১৭]

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে। লাখ লাখ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সেগুন ও রাবারবাগান করা হয়েছে। সম্পূর্ণ মনোকালচারের ভিত্তিতে এসব বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্রের নির্দেশে বন বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাগান গড়ে তুলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে শত শত ইটের ভাটা। সেগুলোতে পোড়ানো হচ্ছে বনের গাছ। ঢাকা-চট্টগ্রামের কাঠ ব্যবসার উৎস পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষরাজি। মূলত এসব কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষ ও প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে।

পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকার ও প্রশাসনের হলেও প্রশাসনে নিযুক্ত ব্যক্তি ও সরকারের ক্ষমতাবান-অর্থবান ব্যক্তিরা মিলেমিশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষ ও বন ধ্বংস করেছেন। তাই সেখানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। রাঙামাটিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ এটাই।

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রমুখী বা শহরভিত্তিক উন্নয়ন। সারা দেশের বিচারে সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক, আর পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে জেলা শহরকেন্দ্রিক। ভালো স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সব জেলা শহরে। সন্তানের ভালো শিক্ষা, ভালো চিকিৎসার জন্য মানুষ জেলা সদরে বসতি গড়ে তোলে। এভাবে রাঙামাটি জেলা শহরে অপরিকল্পিতভাবে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। আর্থিক অসংগতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও মানুষ যেখানে সস্তায় জমি পাওয়া গেছে, সেখানে জমি কিনে বসতি গড়ে তুলেছে। অনেকে ভাড়া বাসা নিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে। উপজেলা পর্যায়ে যদি ভালো স্কুল ও ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা থাকত, তাহলে এত মানুষ জেলা শহরে গিয়ে ভিড় করত না। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসতি গড়ে তুলতে বাধ্য না হলে এবারের পাহাড়ধসে রাঙামাটিতে মানুষের এত মৃত্যু হতো না।

তৃতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়িদের ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো ঘটনা থেকে শুরু করে বড় বড় সাম্প্রদায়িক হামলা-সহিংসতা ঘটে আসছে। এটা পাকিস্তান আমলেও দেখেছি। সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যাকাণ্ড এড়াতে পাহাড়ি মানুষ নিজ গ্রাম ছেড়ে জেলা শহরে বসতি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। ২ জুন ২০১৭ লংগদুতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের কারণে বহু পাহাড়ি মানুষ রাঙামাটি শহরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৮৯ সালে যখন লংগদু গণহত্যা সংঘটিত হয়, তখনো বহু পাহাড়ি পরিবার রাঙামাটি শহরে বসতি গড়ে তুলেছিল। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার শিকার এলাকার বহু পাহাড়ি পরিবার রাঙামাটি শহরে বসতি গড়ে তুলেছে। রাঙামাটি জেলা সদরে সমতল জমির অপ্রতুলতায় অনেক মানুষ খাড়া পাহাড়ে বসতি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। এবারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ হতাহত হওয়ার এটিও বড় একটি কারণ। পার্বত্য শান্তিচুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া, চুক্তিবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে গোষ্ঠীগত সহিংসতা সংঘটিত হয়ে আসছে।

চতুর্থ কারণ হলো সেটেলার বসতি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে বহু সেটেলার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে তোলে। এ কথা সবাই জানে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশির ভাগ জায়গা হলো খাড়া পাহাড়। এগুলো মানুষের বসতি গড়ে তোলার জন্য উপযোগী নয়, প্রাকৃতিক বন হিসেবে সংরক্ষণে প্রযোজ্য মাত্র। কয়েক দশক ধরে বসতি স্থাপনকারী অতিরিক্ত চার লক্ষাধিক লোকের চাপ পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ্য করতে পারছে না। বন বিভাগ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ধ্বংসের একটি অন্যতম কারণ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ওয়াটারএইড কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলামও পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকসংখ্যক মানুষের পুনর্বাসনকে এ অঞ্চলের বন ধ্বংসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন [প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক, ১৯ জুন ২০১৭]। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তার প্রভাবে বন ধ্বংস, বন ধ্বংসের ফলে পাহাড়ের প্রাকৃতিক সুরক্ষা বিনষ্ট। 

সমতলের যেসব মানুষকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসন করা হয়েছে, তারা জীবিকা ও নিরাপত্তার জন্য প্রথম পুনর্বাসনের জায়গা ছেড়ে ক্রমে গিয়ে বসতি গড়ে জেলা শহর ও শহরতলিতে। এভাবে রাঙামাটি শহর এলাকায় বসবাস ও গৃহনির্মাণের অনুপযোগী খাড়া পাহাড়গুলোতেও মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে, অনেকে পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি বানিয়েছে। প্রবল বর্ষণের ফলে মাটি নরম হয়ে পাহাড় ভেঙে পড়লে ঘরগুলো মাটিতে চাপা পড়ে সে ঘরের মানুষজন মারা পড়েছে।

পাহাড়িরা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করে না। তারা পাহাড়ের অবস্থাভেদে গাছ-বাঁশ দিয়ে মাচাঙ ঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছে। এটিই তাদের গৃহনির্মাণের ঐতিহ্যগত প্রযুক্তি। পাহাড় কেটে বা কুপিয়ে জুমচাষ বা কৃষিকাজ করে না। এটাই ছিল পাহাড়িদের ঐতিহ্য। কিন্তু এখন অবস্থা বদলে গেছে। অপাহাড়ি বসতি স্থাপনকারীদের দেখাদেখি এখন পাহাড়িরাও আজকাল কোদাল দিয়ে পাহাড় কুপিয়ে আদা-হলুদ ইত্যাদি চাষ করছে। শহরাঞ্চলে পাহাড়িরা ঘরবাড়ি বানানোর ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছে না, এখন তারাও পাহাড় কাটছে। ফলে তারাও পাহাড়ধসে হতাহত হচ্ছে, তাদেরও ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে।

নিজেদের জীবন, সম্পদ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পাহাড়িদের গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া দরকার। একতলা–দোতলা ঘর তোলার ক্ষেত্রেও পাহাড় না কেটে, প্রকৃতিকে আঘাত না করে ঐতিহ্য অনুসরণ করে ঘরবাড়ি বানাতে হবে। গাছ-বাঁশ-শণ বা টিন দিয়েও একতলা-দোতলা ঘর তৈরি করা যায়। পাহাড়িদের গৃহনির্মাণের পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে নতুন প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করা যেতে পারে, যাতে পাহাড় না কেটে গৃহ নির্মাণ করা যায়।

যে সমস্যাগুলো ওপরে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলোর স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্রীভূত ও শহরমুখী উন্নয়নের বিপরীতে বিকেন্দ্রীকৃত ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বসবাস ও কৃষিকাজের উপযোগী ভূমির সঙ্গে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে সমতলের বসতি স্থাপনকারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কমে আসবে, মানুষের অপমৃত্যু বন্ধ হবে এবং এ অঞ্চলে উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

শক্তিপদ ত্রিপুরা: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

সূত্র: প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত