তথ্য কমিশনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দরকার

প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০১৭, ১১:১৯

সাদেকা হালিম

বাংলাদেশ সংবিধানে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও সংবিধানের ৭, ৩২ ও ৩৯ ধারাকে তথ্য অধিকার আইনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৪-এ বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকবে এবং নাগরিকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে।’ তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চারটি পক্ষ জড়িত—আবেদনকারী, তথ্য সরবরাহের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আপিল কর্তৃপক্ষ ও তথ্য কমিশন।

তথ্য অধিকার আইনের লক্ষ্য হচ্ছে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতি প্রতিরোধ, দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আইনের অনুচ্ছেদ ৯(২) অনুযায়ী, আবেদনকারীকে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথ্য সরবরাহ করবেন। যদি ওই কর্মকর্তা তথ্য না দেন কিংবা আপিল কর্তৃপক্ষের কাছেও আবেদনকারী প্রত্যাখ্যাত হন, তাহলে তথ্য না পাওয়ার বিষয়ে ২৪ নম্বর সেকশন অনুযায়ী তথ্য কমিশনের কাছে অভিযোগ করা যাবে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সেকশন ২৫(১০) আবেদনকারীর অভিযোগ ন্যূনতম ৪৫ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে মীমাংসা করবে তথ্য কমিশন। প্রার্থিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে তথ্য কমিশন ধারা ২৭ মোতাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জরিমানা এবং আপিল কর্তৃপক্ষ আইনকে অবমাননা করলে বিভাগীয় শাস্তি বিধানের জন্য কমিশন সুপারিশ করতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের এই বিধান ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ পদক্ষেপ।

আইনে উল্লেখ আছে যে ‘তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য গোপন করিতে বা উহার সহজলভ্যতাকে সংকুচিত করিতে পারিবে না।’ কিন্তু লক্ষণীয়, তথ্য আইন বাস্তবে ব্রিটিশ প্রণীত দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন, ১৯২৩, যা এখনো বাংলাদেশে বিদ্যমান, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ধারাগুলো ভারতে প্রত্যাহার করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান।

মূলত সাধারণ পেশার মানুষ, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করেন। যেকোনো নাগরিক তথ্য অধিকার আইনের ৭ ধারায় বর্ণিত তথ্য ছাড়া অন্য সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওর কাছে তথ্য আহরণের নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে তথ্য চাইতে পারেন। তবে ধারা ৩২-এ আটটি গোয়েন্দা সংস্থা কোনো তথ্য প্রদান করবে না (যেমনটি রয়েছে ভারতসহ অন্য কিছু দেশে)। কিন্তু দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত তথ্য প্রদানে বাধ্য। লক্ষণীয় যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কৌশলে আবেদনকারীর আবেদন উপেক্ষা করছে।

তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্তৃপক্ষের দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়ার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ ও জটিল করে। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপিল কর্মকর্তা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অধস্তন এবং তিনি এসিআর প্রদান (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) করেন, তাই তথ্য কর্মকর্তা আবেদনকারীকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তথ্য প্রদান করতে পারেন না। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তথ্য অধিকার আইন জনগণকে সরকারি বিষয়ে অংশগ্রহণের এবং কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। এই আইন স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততাকে এগিয়ে নিচ্ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংলাপ বা আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে ভূমিকা রাখছে।

যেমন রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য ১২৮ কোটি টাকা জমা পড়ে। আবেদনকারী শাহদীন মালিক এই অর্থ কোন অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে কোন বিবেচনায় কত টাকা প্রদান করা হয়েছে, অনুদানপ্রাপ্ত ১২৮ কোটি টাকার মধ্যে কত টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ইত্যাদি তথ্য প্রার্থিত সময়ে না পেয়ে তথ্য কমিশনে অভিযোগ দেন। তবে তথ্য কমিশনে শুনানির আগেই শাহদীন মালিককে তথ্য সরবরাহ করা হয়।

প্রায়ই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, আর্থিক খাতে অনিয়ম প্রত্যক্ষ করি। এ ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ, পদোন্নতি ও অর্থের ব্যবহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত আইন মোতাবেক হচ্ছে কি না, সেই স্বচ্ছতা যাচাই করা যায়। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বচ্ছতার আওতায় আনা যায়। এই আইনের আওতায় সাধারণ মানুষ ২০১০ সাল থেকে তথ্য কমিশনের কাছে অভিযোগ করতে শুরু করেছে। তথ্য অধিকার আইনে এ পর্যন্ত (২০১০ থেকে ২০১৫) ৫০ জন নারী তথ্য চেয়ে না পেয়ে তথ্য কমিশনারের কাছে অভিযোগ করেছেন। এ সময়ে তথ্য কমিশনে অভিযোগ জমা পড়েছে ১ হাজার ৩৬টি। শতকরা হারে মাত্র ৪ দশমিক ৬৩। যে সমাজ পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষ প্রাধান্যের; সেখানে তথ্য অধিকার আইন সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারে, যদি তারা এই আইনের কার্যকর ব্যবহার করতে পারে।

দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে ১০ শতাংশ উন্নতি করা সম্ভব (ইত্তেফাক, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগের সংখ্যা ১ হাজার ৩৪৪। শুনানির জন্য গৃহীত হয়েছে ৮০৮টি অভিযোগ (মোট অভিযোগের ৬০ দশমিক ১২ শতাংশ), নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৮৫টি অভিযোগ (৫৮ দশমিক ৪১ শতাংশ) এবং পত্র প্রেরণের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৭৪টি অভিযোগ (৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ)। প্রকৃত অর্থে পত্র প্রেরণের মাধ্যমে আবেদনে ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে পুনরায় আবেদন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১০ শতাংশ আবেদনকারী পুনরায় আবেদন করেন। অর্থাৎ বিশাল জনগোষ্ঠী আমলাতান্ত্রিক ও আইনি জটিলতার কারণে তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তথ্য কমিশনের মূল লক্ষ্য ÿতথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। তাই প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতা বস্তুনিষ্ঠভাবে দূর করে তথ্য পাওয়ার পথ সুগম করতে হবে। ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র আটজনকে তথ্য না দেওয়ার জন্য জরিমানা করা হয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

তথ্য আইনের ব্যবহার ব্যাপক। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো বস্তুনিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় নিষ্পন্ন করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশন সহযোগিতা করতে পারে। তেমনিভাবে তথ্য অধিকার আইন ও দুর্নীতি দমন কমিশন অ্যাক্ট উভয়কেই সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি দূরীকরণে ব্যবহার করা যায়। দুই আইনেই কমিশনকে নিজস্বভাবে তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তথ্য আইন আপিল অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোড অব সিভিল প্রসিডিউর, ১৯৮০ এবং আদালতের সমন জারি, কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তথ্য কমিশনের সামনে উপস্থিত করতে বাধ্য করে ইত্যাদি। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের মাধ্যমে সাক্ষী তলব করা, অভিযোগ সম্পর্কে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেরা করা, বেসরকারি দলিলপত্র উপস্থাপন করা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যদিও দুদক দুর্নীতি দমনে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। দুর্নীতি চিহ্নিত হওয়ার পর সমুচিত শাস্তি বিধান করা যায়নি।

সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয় যেকোনো মামলায় অভিযোগপত্র হওয়ার আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে—এই বিধান বাদ দিয়েছে। এ নিয়ে অনেক বিতর্কের পর আইন মন্ত্রণালয় আইনটি পরিবর্তনের পক্ষে দুদক ও ফৌজদারি কার্যবিধির এখতিয়ার বহাল রেখে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আইন করার পক্ষে মত দিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি দমনে এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এক রকম এবং রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের জন্য আরেক রকম আইন হতে পারে না।

তথ্য, মানবাধিকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইনত স্বাধীন, কিন্তু সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। কার্যবিধি পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে এই তিন কমিশন সার্বিক সুশাসনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু এই তিন কমিশনের মধ্যে সমন্বয় নেই। তিন কমিশনের সমন্বয় বড় পরিসরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। তথ্য কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনগণকে তথ্য অধিকার আইনের উপযোগিতা সম্পর্কে অবহিত করা। তথ্য অধিকারকে একটি কৌশলগত ও নির্দিষ্ট সময় ছকে বেঁধে দেওয়া দরকার।

লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক তথ্য কমিশনার, তথ্য কমিশন
সূত্র: প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত