আলোর পথযাত্রী

প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০১৭, ২১:৫২

বিদেশে থাকার প্রথম কয়েক মাস কেটেছে আড়ষ্ট হয়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম প্রথম সবকিছুতেই ভয় পেয়েছি, অবাক হয়েছি। আস্তে আস্তে কাটতে লাগল জড়তা। অনেক বন্ধু জুটল এই সময়ে। শুধু আমার বাসস্থান অরহুস শহর বা ডেনমার্কেই নয়, আমার বন্ধুমহল অনায়াসেই ছড়িয়ে পড়ল ফ্রান্স, গ্রীস থেকে জার্মানিতেও। বার পাঁচেক যাওয়া হয়ে গেছে জার্মানিতে ইতিমধ্যেই। কখনো কাজে, কখনো আড্ডা দিতে, কখনো বা যাত্রাবিরতিতে। কিন্ত গত বছরের মার্চ মাসের জার্মানি যাত্রা কেন জানিনা আমায় একদম ওলটপালট করে দিয়েছে।

অরহুস থেকে হামবুর্গ, জার্মানির অন্যতম ব্যস্ত শহর, পৌঁছতে লাগে বড়জোর চার কি পাঁচ ঘন্টা। এই কয়েকবারেই আমার বেশ পছন্দের হয়ে উঠেছে হামবুর্গ। নতুন, কিঞ্চিৎ অদ্ভুত কতগুলো বন্ধু হয়েছে বলে নয়, এই শহরটাকে মনে ধরেছে এমনিই। অকারণ। এমনই অকারণ এক আড্ডাবহুল বিকেলে আমার পরিচয় মারিয়ার সাথে। মারিয়া ওসেটিয়া বলে একটা না-রাষ্ট্র, না-দেশের মেয়ে। শুনেছি ওসেটিয়া এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, এখন কোথায়, কেন, কীভাবে কার অংশ তা জানি না। ওসেটিয়া নিজেও জানে না বোধহয় সেটা নিশ্চিতভাবে। যাই হোক, মারিয়া হামবুর্গেই থাকে, পেশায় সাংবাদিক। তার বাড়িতেই জমেছিল আড্ডা। আর বাঙালির যেমন স্বভাব। স্বর্গে গেলেও রবিঠাকুর না আউড়ে ছাড়বে না, ঠিক সেভাবেই আমিও তাকে খান কতক বাংলা গান শোনালাম। ব্যস আর যাই কোথা! ওমনি জেদ ধরে বসল মার্চ মাসে হামবুর্গে নারী দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে আমায় নাকি গাইতেই হবে। আমিও ভাবলাম এমনিই বলছে বোধহয়। ভুলে গেলাম বেমালুম। কী সাংঘাতিক মেয়ে, আমি অরহুস ফেরার দুদিন পর ফোন করে বলে, “তাহলে ৪ তারিখ আসছ তো? ৫ তারিখ গাইতে হবে কিন্তু!”

৪ তারিখ চেপে বসলাম ট্রেনে। পৌঁছে গেলাম হামবুর্গ। ৫ তারিখ মারিয়ার সাথে যখন অনুষ্ঠানগৃহে যাচ্ছি, তখনও জানতাম না অনুষ্ঠানটির ব্যপ্তি বা উদ্দেশ্য আসলেই কেমন। গিয়ে তাক লেগে গেলো। ‘ফ্রাউয়েনপারস্পেক্টিভ ইন হামবুর্গ’ নামের একটি সংগঠন ইরান থেকে আসা শরণার্থী নারীদের নিয়ে কাজ করে। শুধু তাই নয়, এদের কর্মকান্ডের সাথে, চেতনায় পরতে পরতে সম্পৃক্ত হয়ে আছে বামপন্থী রাজনীতি। বলাই বাহুল্য, উত্তেজনার পারদ আকাশ ছোঁয়!

মজা পেলাম অন্য একটা জিনিস দেখে। অনুষ্ঠানটি হবার কথা হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে, এবং সে উপলক্ষে সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর জুড়ে পোস্টার। ভালো কথা। কিন্ত যেখানে আমার নাম থাকার কথা, সেখানে দেখি জ্বলজ্বল করছে “শবনম সুরিতা (রেহনা) ফ্রম বাংলাদেশ”। প্রথমত,আমি বাংলায় গান গাই বলেই উদ্যোক্তারা ধরেই নিয়েছেন আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এবং দ্বিতীয়ত, আমার নাম গুগলে সার্চ দেবার ফলে তারা সম্মুখীন হয়েছেন আমার গাওয়া ইউটিউবে “রেহনা তু” নামক একটি গানের। বেচারিরা এতকিছু জটিলতা বুঝতে পারেনি তাই নিজেদের মত করেই ব্যাখ্যা করে নিয়েছে। মানুষ যে আজও এতটা সরলভাবে ভাবতে পারে জানা ছিল না।

এরপর থেকে গোটা সন্ধ্যাটাই কাটল এক অসামান্য বিমুগ্ধতায়। একে একে শুনলাম স্পেন, মেক্সিকো, জার্মানি, ফ্রান্স, আফগানিস্তান, ইরান, পেরু, ওসেটিয়া, পাকিস্তানের শিল্পীদের গান-কবিতা। এতদিন শুধু লোকমুখে শুনতাম, সঙ্গীতের কোন ভাষা লাগে না। সেদিন সেটাকে বাস্তবায়িত হতে স্বচক্ষে দেখলাম। আমিও গাইলাম আমার মাতৃভাষায়। মৌসুমী ভৌমিকের গান থেকে রবীন্দ্রনাথ গাওয়া হয়ে গেলে ফৈজ আহমেদ ফৈজের গান ধরলাম। মুখে মুখে তর্জমা করার চেষ্টা করলাম যতটা পারি। আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে হলভর্তি বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ দর্শকাসনে। আর মঞ্চে একের পর এক গান হচ্ছে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের। কিন্ত কেউ এতটুকুও বিরক্ত নন। কারও উৎসাহে একচুলও ফাঁকি নেই। ফলস্বরূপ, মাথার ভেতর সমস্ত মানচিত্র ঘেঁটে ঘ।

এতদিন ডেনমার্কে থাকায় মঞ্চে গাওয়ার অভ্যেস চলে গিয়েছিল। তার ওপর নেই সাথে সঙ্গত করার জন্যে বাবা বা পরিচিত যন্ত্রশিল্পীরা। জন্মদিনে নিজেকে একখানা নাইলন স্ট্রিং গিটার উপহার দিয়েছি। সেটাই অল্প অল্প পিড়িং পিড়িং করে গাইতে হলো। ভয়ে ভয়েই ছিলাম। কিন্ত গাইতে ওঠার আগে উদ্যোক্তা দলের এক নারীকর্মী, ফারিয়া, যখন অসম্ভব মায়ার সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, অপরিচিত এক প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। সেই নারী তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ ১১ বছর কাটিয়েছেন ইরানের জেলে, বামপন্থী মনোভাব থাকা ও রাজপথে লড়াই করতে নামার দোষে। হারিয়েছেন নিজের পিতাকে স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে। এখনও জার্মানির মাটিতে প্রতিদিন লড়ে যান আরব, ইরানীয় নারীদের অধিকার রক্ষার্থে। তাঁর জীবনে প্রতিটা দিনই যেন অদম্য প্রাণশক্তি, জেদের প্রতীক। গাওয়ার আগে তিনিই আমার পরিচয় করিয়ে দেন একজন ছাত্রী, সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে। আমায় আবারও অবাক করে দিয়ে বলেন,"তুমিও আমাদের এই আন্দোলনের একজন। আমাদের কমরেড"। আমার কাছে তার প্রত্যুত্তর সেদিন ছিল না। আজও নেই।

তারপর আমি ভয় ভুলে গিয়েছি। প্রাণ ঢেলে গেয়েছি যতটুকু পারি। সেদিন সন্ধ্যা শেষে ফিরে এসেছি একবুক প্রতিজ্ঞা, সাহস আর সততা নিয়ে। আপোষ না করার পাঠ ঝালিয়ে নিচ্ছি তাই ক্রমাগত। ফারিয়া আমায় কমরেড বলে ডেকেছেন। এই সম্বোধনের উত্তরাধিকার যে অনেক বড়। ভুলে গেলে চলবে না। আমায় জেগে থাকতে হবে। জাগাতে হবে। আমরণ।

[নারী দিবস আসন্ন, তাই স্মৃতিচারণের হাত ধরেই জীবনের পাঠশালায় ফিরে যাই। শিখি মানুষ হওয়া, নারী হওয়া। কারণ নারীবাদের ইতিহাস, নারীমুক্তির আন্দোলনের সাথে যে স্মৃতির, বিস্মৃতির বহুকালের নাড়ির সম্পর্ক।]

শবনম সুরিতা'র ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত