হায় আইডেন্টিটি! হায় বিশ্বাস! হায় বিধান!

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০১৬, ০৩:২৩

মুন তসলিমা শেখ

আইডেন্টিটি এবং ক্রাইসিস। টানাপোড়ন। নিজেকে না জেনে মানুষ দুনিয়া জুড়ে বিবাদ বাঁধিয়ে বসে আছে। সে কে তাই সে জানে না। তাই নিয়ে কত রক্তপাত।

আমাকে কি আমার পাশের জনের মত দেখতে হতে হবে? বা ভাবতে? একই রকম কস্ট্যুম? জেশ্চার? অথচ আমার ভেতর বসত করে কোন এক অচেনা মানুষ। আরশি নগর। খোঁজ করিনি কোনকালে।

আজ আমার বস ভ্যাকেশনে গেল। ১৩ বছরের মতো এক অফিসে থাকলেও সে আমার বস কিছুদিন ধরে। আমার বস এক অসাধারণ মানুষ। সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনে সে গে। হোমোসেক্সুয়াল। এত ভাল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। এক সাথে এক জিম করি। হাত ধরে কথা বলি। হাগ দেই জোরে সোরে। স্ট্রেইট পুরুষ হলে এর কিছুই করা হতো না। কনভেনশনাল পৃথিবীর অনেক নিয়ম কানুন সামনে এসে যেতো। এ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এত চমৎকার একজন মানুষ আমার বস যে ভাবলে আমার চোখে জল এসে পড়ে। অফিসের মানুষকে মানুষ ভালবাসে না। অফিসে মানুষ থাকে কাজের পীড়নে। তবু এ গে মানুষটি ভেতরে আমার বন্ধু। যতটা সে আমার বন্ধু শুধু বস বলেই আমি তাকে সেটা জানতে দেই না। আমার আইডেন্টিটির কোন টানাপোড়ন নেই। বায়োলোজিক্যাল টানাপোড়নতো নয়ই। তবু অস্তিত্বের টানাপোড়ন যতটুকুন সেটাকে মোকাবেলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তখন ভাবি মানুষ যদি জানতো, ওরা কেমন আছে? ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবন খণ্ড খণ্ড দেখেছি। ওঁর টানাপোড়ন বুঝতে চেষ্টা করেছি। বুঝিনি। বুঝতে পারা আর অনুভব করাতো এক নয়।

একজন পুরুষের দেহে নারী অস্তিত্ব, এন্টিটি নিয়ে পৃথিবীতে কতটা মিসআন্ডারস্টুড হয়ে সে জীবন নিঃশেষ করে যায়। বা একজন নারীর দেহে বায়োলজিক্যাল পুরুষ স্বত্ত্বা নিয়ে সে আমৃত্যু যুদ্ধ করে যায়। শরীরের ভেতরের আপন স্বত্ত্বার সাথে। বহিরাবরণের সাথে। পৃথিবীর সাথে। আপনজনের সাথে। একটি হাত। একটি হাত তার দিকে আসেনা যে তার তাকে চিনতে জানতে উন্মোচন করতে সাহায্য করবে।

চোখ ভিজে ওঠে।

পৃথিবী এখনও রেডি নয়। আমরা আমাদের থেকে আলাদা কাউকে গ্রহণ করতে আজও প্রস্তুত নই। আমার ছেলে অটিস্টিক না হলে পুরো পৃথিবীটাই আমার কাছে অজানা থেকে যেতো। এই লিটল এঞ্জেল আমাকে মানুষে রূপান্তরিত করেছে। চোখের সামনে খুলে গেছে সাত মহাল। দেখেছি মানুষ এবং তার গোত্রের খোঁয়াড়।

এই যে এত রক্তপাত। চাপাতি। 'আল্লাহু আকবর।' হায় আইডেন্টিটি! হায় বিশ্বাস! হায় বিধান! যদি চিনতে মানুষ!

শ্যামল বাংলার শ্যামলা মেয়েটি ডিঙি নৌকায় তিন প্রহরের বিল পাড়ি দিয়ে দেখে, পাষাণ পাথর তার দেশ। মানতে কি কষ্ট! কার গায়ে সোঁদা মাটির গন্ধ। খুঁজে বেড়ায়? কাকে? নিজেকে না অন্য কিছু? কোথায় সে? খুব কাছে নিভৃতে যে বাস করে তাকেই সে জানে না। কেবল যা জানে না তার জন্য চিৎকার আহাজারি।

মুন তসলিমা শেখ এর ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত