সব মানুষের দেশের নাম হোক পৃথিবী

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ১৫:২৫

চৈতী আহমেদ

যে নদীটা আমার নিজের, সেই নদীটার নাম নাফ! এমন মোহময় নদী আমি আর একটিও দেখিনি। এই নদীকে আমি জোয়ারে দেখেছি, ভাটাতেও দেখেছি। এই নদীর তীর ঘেষা যে পাহাড় সেই পাহাড়ের চূড়ায় আমি প্রথম পৃথিবী স্পর্শ করেছি! এই স্পর্শ আমার মধ্যে সঞ্চারিত করেছে অতল স্পর্শী জীবনের গহীন বোধ।

আমি আমার বোধের শরীর নাফের দিকে ক’দিন ধরে তাকাতে পারছি না। সেখানে ভাসছে একটি মানব শিশুর নিষ্প্রাণ মুখ! যেখানে ভাসছে সেই শিশুটি, তার একটু দূরেই আমার মানবী মায়ের গর্ভে জন্মে, আমি মানুষ হিসেবে পৃথিবীর উপর আমার অধিকার ব্যক্ত করেছিলাম সুতীব্র চিৎকারে। ভাসমান শিশুটি জন্মেছে একই নদীর অন্য পারে। অথচ ওর জন্ম মুহূর্তে ঘোষিত ভূমির অধিকার উচ্চারণের কারণে ওকে হারাতে হয়েছে ওর ঐটুকু প্রাণ।

পৃথিবীব্যাপী ভূমির অধিকার নিয়ে চলছে যে রাজনীতি সেই রাজনীতিই কেড়ে নিয়েছে ওর প্রাণ।

এই রকম নির্মম মৃত্যু দেখে দেখে আমার ভেতরের যে জাতীয়তা বোধের তীব্রতা, তা ফিকে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সচেতন মস্তিস্ক জানে ঐ রোহিঙ্গা শিশুটির দিকে তাকালে আমার আবেগ এসে ধুয়ে দেবে আমার জাতীয়তা বোধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ছবিটা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার নিয়ে ইসরাইলের মতো আলাদা একটা রাষ্ট্র গঠনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আজ ত্রিশ বছর ধরে চলমান। সেই চলমান ষড়যন্ত্রের কারণে ত্রিশ বছর ধরে থেমে থেমে মিয়ানমার সরকারের বিভিন্ন বাহিনী সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর চালাচ্ছে, নির্যাতন, হত্যা, বর্বরতা, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যখনই মগের মুল্লুকে সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে, যখনই মিয়ানমারের সরকারী বেসরকারী বাহিনীগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমায় পৌছে যায় তখনই এই পারে আওয়াজ ওঠে মানবতা গেলো বলে। তখনই চাপ আসতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গুটি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার ঝাণ্ডা উচ্চে তুলে ধরার। বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের একাংশ যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেয়ার পক্ষে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। যারা এই অভিযোগ করে, তারা মিয়ানমারে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠণ চালাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর, সেই মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক অবরোধসহ কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধানের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে এই বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীটির বোঝা তুলে দিতে চায় বাংলাদেশের উপর।

বর্তমানে কক্সবাজারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মূল অধিবাসীদের ছাড়িয়ে গেছে অনুমান করা হয়। তারপরও যারা রোহিঙ্গাদের দ্বারা অত্র অঞ্চলের পরিবেশ দূষণ, এবং অপরাধ বৃ্দ্ধির দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে রেহাই মিলছে না তাদের।

আমি ক’দিন ধরে দাঁতে দাঁত চেপে, আমার মানবিক আবেগের গলা চেপে ধরে নাফ নদীতে ভাসমান শিশুটিকে না দেখার চেষ্টা চালিয়ে আমার জাতীয়তা বোধটিকে তীক্ষ্ন করে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। নাফ নদীতে ভাসমান মৃত শিশুটির দিকে তাকাতে না পেরে আমার মনে হয়েছে, মানুষের পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে ঐ মানব শিশুটির অধিকার ছিলো। ওর নাগালের মধ্যে বাংলাদেশের ভূমিতেও ওর মানবিক অধিকার আছে। কোনো অজুহাতেই তাদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের পুশব্যাক করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার আমি আমরা কেউ নই। এতোদিন আমার জন্মভূমি বলে আমার বাংলাদেশ বলে আমি যে ভূমিটি কুক্ষিগত করে রেখে কিছু মানুষকে মরার জন্য বন্দুকের মুখে, নাফ নদীর পানিতে ভাসতে বাধ্য করেছি, আমি অন্যায় করেছি। আমি নিজের স্বার্থে শিশুটির মুখ না দেখতে চেয়ে অপরাধ করেছি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে দেয়া হোক। রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা বন্ধ করা হোক। পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

মনের মধ্যে এই মতো প্রতিক্রিয়া নিয়ে নাফ নদীতে ভাসমান মৃত শিশুটিকে নিয়ে কিছু লিখবো না ঠিক করেছিলাম। অনেকেই ইনবক্সে এসে জানতে চাইছেন। রোহিঙ্গা শিশুকে নিয়ে আমি কিছু লিখছি না কেনো?

আমি যে শিশুটির ঐ রকম ভাবলেশহীন মৃত মুখের দিকে ভালো করে তাকাতেই পারছি না। ভাবতে পারছি না ওর কোনো দেশে নেই, কোনো দেশ নেই বলে ফড়িংয়ের দোয়েলের মতো ওকে মরতে হয়েছে। ওর মৃত দেহ ভেসে উঠেছে জলের উপর। ওর যদি দেশ না থাকে শুধু একটা নদীর অন্য পারে জন্মে আমারই বা দেশ থাকবে কেনো? 

রোহিঙ্গারা আসুক, পৃথিবীর কেউ যদি ওদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে না আসে, তাহলে নিয়ে যাক তারা বাংলাদেশের স্বপ্নময় ভূমির একাংশ। নিয়ে তারা আলাদা দেশ গড়ুক। সেই দেশের নাম হোক পৃথিবী। তাতে আমি হয়তো আর বাংলাদেশের অংশ থাকবো না। কিচ্ছু আসে যায় না, ঘুচে যাক আমার বাংলাদেশের মোহ। এমনিতেই তো ঝড়ে পড়ে পৃথিবীর নাগরিক হওয়ার পথে। তবু রোহিঙ্গারা বাঁচুক, মৃত্যুর আগে ওদেরও পায়ের নীচে এক টুকরো মাটি থাকুক। ঐ শিশুটির মতো জলের উপর ভেসে না উঠুক আর কোনো মানুষের শিশুর মৃতদেহ! পৃথিবীতে মানুষ মানুষের মতো বাঁচুক, পায়ের নিচে নিজস্ব মাটির স্পর্শ নিয়ে বাঁচুক। ভূমিহীন মানুষকে মানুষ মনে হয় না। মনে হয় দোয়েল, শালিক। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। সব মানুষের দেশের নাম হোক পৃথিবী। মুছে যাক পৃথিবীর মানচিত্রের ভেতরের সব ভেদরেখা।

চৈতী আহমেদ এর ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত