নাজনীন সুলতানা: মুক্তিযোদ্ধা, প্রোগ্রামার, প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর

প্রকাশ : ২৫ মে ২০১৬, ১৭:৫১

জাগরণীয়া ডেস্ক

নাজনীন সুলতানা বাংলাদেশের প্রখ্যাত ব্যাংকার। তিনি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম মহিলা ডেপুটি গভর্নর। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালে সরাসরি সহকারী পরিচালক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগদান করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তার আরো বড় পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামার।
 
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
নাজনীন সুলতানার জন্ম ১৯৫৪ সালে। তাঁর বাবার নাম মোসলেহউদ্দিন খান এবং মায়ের নাম উম্মেহানী খানম। পড়াশোনা শুরু হয় রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুলে। তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে পড়ে ভর্তি হন মতিঝিল গভর্নমেন্ট গালর্স হাই স্কুলে। সেখান থেকে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকসহ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর স্বামী বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক আব্দুল কাইয়ুম।
 
মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক জীবন
নাজনীন সুলতানা ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনে বদরুন্নেসা কলেজের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বদরুন্নেসা কলেজের সকল ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। 
 
১৯৭১ সালের মার্চে বদরুন্নেসা কলেজের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রথম ডামি ও পরে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে যাবার প্রশিক্ষণ নেন।ডামি রাইফেল হাতে ঢাকার রাজপথে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের সেই বিখ্যাত মার্চপাস্ট এবং সশস্ত্র মহড়ার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র বিপ্লবের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, সংবাদ আদান প্রদান করেছেন। শুধু তাই না, যুদ্ধের সময় আহত মুক্তি যোদ্ধাদের নার্স হিসাবেও সেবা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে যুক্ত ছিলেন সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক গণ-সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গেও। বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডি শেষ করে যোগ দেন মহিলা পরিষদে। বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন তিনি। 
 
কর্মজীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান থেকে পাশ করে ১৯৭৮ সালে তিনি বিআইডিএসে যোগ দেন। পরবর্তীতে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পদার্থবিদ্যার রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাজনীন সুলতানা বাংলাদেশে ব্যাংকে কম্পিউটার উপ-বিভাগে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে তিনিসহ মাত্র ৪ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময়ে এ দলটি সব মিলিয়ে প্রায় ৮৫টি সফটওয়্যার তৈরি করে যেগুলো ব্যাংকের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগ তার হাতেই গড়া।
 
তাঁর লেখা প্রথম প্রোগ্রাম ছিলো আমদানি-রপ্তানির পরিসংখ্যান বিষয়ক। ১৯৮৪ সালে তিনি একই বিভাগের উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যার তৈরি করেন যদিও নিয়মতান্ত্রিক জটিলতায় সে সময়ে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৯২ সালে তিনজন সহকর্মী মলে টেক্সটবুক বোর্ডের আওতাভুক্ত কম্পিউটার বিষয়ক প্রথম বই 'মাধ্যমিক কম্পিউটার বিজ্ঞান' লেখেন। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম অ্যানালিস্ট হন এবং ১৯৯৬ সালে সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট হন। 
 
পরবর্তীতে ২০০০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম নারী নির্বাহী পরিচালক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অটোমেশনের সার্বিক কাজের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সিবিএসপি’র আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া এন্টারপ্রাইজ ডাটা ওয়্যারহাউস ও ব্যাংকিং প্রকল্পের পারচেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতেও (বিবিএস) কর্মরত ছিলেন।
 
করুণ বিদায় ও শুভানুধ্যায়ীদের আক্ষেপ
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে (সময়ের হিসাবে ৫ ফেব্রুয়ারি) সুইফট ব্যবহার করে অর্থ চুরির জন্য ৩৫টি পরামর্শ বা অ্যাডভাইস পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে। ১৫ মার্চ ২০১৬, মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। তাঁর পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
 
বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি স্বল্প পরিচিত মুখ হওয়ায় অনেক অবদান সত্ত্বেও তার এই করুণ বিদায় গণমাধ্যমে খুব বেশি আলোচিত হয়নি। তবে কর্মস্থল থেকে তার এমন করুণ বিদায়কে মেনে নিতে পারেননি তার শুভানুধ্যায়ীরা।
 
তার প্রসঙ্গে এক শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রাক্তন সহকর্মী, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর সৌমিত্র কুমার বিশ্বাস লিখেন, “আপার সাথে কাজের সূত্রে অনেক দেখা হয়েছে, অন্য বস রা যেখানে মুখ গোমরা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মত রাশভারী মুখে কথা বলতেন, সেখানে আপার ব্যবহার ছিল অমায়িক। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল যুগের সূচনা শুরু। এত অর্জনের পরও এমন দুঃখজনক ভাবে তাকে বিদায় নিতে হবে, এটা কখনো ভাবিনি। যে হাত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন, সেই হাত দিয়ে দেশের কোনও ক্ষতি তিনি করতে পারেন, এটা স্বয়ং ঈশ্বর এসে বললেও আমি মানতে নারাজ”।
 
একাত্তরের সময়কার স্মৃতি নিয়ে লিখা অন্যতম বই ‘একাত্তরের ডায়রি’ সম্পাদনা করেছেন নাজনীন সুলতানা। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত