কমলগঞ্জে মণিপুরি তাঁতপল্লীতে শেষ সময়ের ব্যস্থতা

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০১৬, ২০:৩২

জাগরণীয়া ডেস্ক

মৌলভীবাজার জেলার পাহাড় আর চা বাগান পরিবেষ্টিত অন্যতম পর্যটন উপজেলা কমলগঞ্জ। এ উপজেলায় বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম মণিপুরী সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায়ের ৯৫ শতাংশ মহিলা তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

ঈদকে সামনে রেখে মনিপুরী তাঁত শিল্পীরা সারা বছরের মন্দা ভাব কাটিয়ে এখন শেষ সময়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের শৈল্পিক ও নান্দনিক ডিজাইন আজ দেশ ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আমেরিকাতে স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ট্রেড ফেয়ারে মণিপুরীরা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। 

আসন্ন ঈদুল ফিতরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী তাঁতসামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। কমলগঞ্জ উপজেলার মণিপুরী অধ্যুষিত প্রায় ৩০টি গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে তাঁতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির কাজ। কমলগঞ্জের ভানুগাছ বাজার, আদমপুর, মাধবপুর ও গুলেরহাওর এলাকায় মণিপুরী সামগ্রী ও ব্যাগের দোকান খোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঈদে তাদের তৈরি তাঁতসামগ্রীর ভাল বিক্রি হয়।

ব্যতিক্রমী পোশাক হিসেবে ঈদ আর পূজায় মণিপুরি তাঁত শিল্পীদের তৈরি কাপড়ের চাহিদা বাড়ে। জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর, মঙ্গলপুর, রাণীরবাজার, কালারায়বিল, ভানুগাছ, বালিগাঁও, ইসলামপুর, তিলকপুর, ঘোড়ামারা, কোনাগাঁও, ছনগাঁও, তেতইগাঁও, হকতিয়ার খোলা, জালালপুর, কেওয়ালীঘাট, ভানুবিল, বন্দেরগাঁও, কান্দিগাঁও, ছয়চিরী, ভান্ডারীগাঁও, গঙ্গানগর, মকাবিল, গুলেরহাওর, টিলাগাঁও, মাঝেরগাঁও, নয়াপত্তন, হীরামতি গ্রামসহ প্রায় ৩০টি গ্রামে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মণিপুরী তাঁতীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

অন্যদিকে, উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করতে দোকানিরা বসেছেন বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী নিয়ে। কমলগঞ্জের মণিপুরীদের তাঁতে উৎপাদিত বিভিন্ন সামগ্রী স্থানীয়ভাবে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্রয় করে থাকেন। এ সব সামগ্রী আবার স্থানীয় গ্রামগুলোর দোকানগুলোতে বিক্রি করা হয়।  

মণিপুরী মহিলা তাঁতি শুক্লা সিনহা, সীমা সিনহা, কস্তুরি সিনহা, চিত্রালী সিনহা জানান, ঈদের পর দুর্গাপূজা আসছে। বাজারে চাহিদা থাকলেও কাঁচামালের অভাবে চাহিদা মতো পাইকারি বিক্রেতাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না। কাঁচামাল না থাকায় অনেকে তাঁতের কাপড় বোনা বাদ দিয়েছেন বলে জানান তারা।

মণিপুরি তাঁতশিল্পী অনামিকা সিনহা বলেন, ঈদ ও পূজা উপলক্ষে অনেক পাইকারই এসে অর্ডার দিচ্ছেন। সিলেটের বাইরে থেকেও অনেক পাইকার এসেছেন। তবে সুতা না পাওয়ার কারণে সব ক্রেতার চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। তিনি জানান, মনিপুরি তাঁত কাপড়ের কাঁচামাল এখন সিলেটে পাওয়া যায় না। ঢাকা, নরসিংদী কিংবা চট্টগ্রাম থেকে আনতে হয়।

তাঁতের কাপড় ব্যবসায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ বলেন, ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী তাঁতের কাপড় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। কমলগঞ্জসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মণিপুরি তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র। বাংলাদেশ ব্যাংক চালু করেছে এসএমই ঋণ প্রকল্প। এসব কেন্দ্র থেকে প্রায় সব মণিপুরী পরিবারের মধ্যে থেকে নারীরা তাঁতের কাপড় তৈরি শিখে নিয়েছেন। তার মতে, শুধু প্রশিক্ষণ প্রদান ও তাত ঋন দিলেই চলবে না। সর্বাগ্রে প্রয়োজন মণিপুরি কাপড়ের কাঁচামাল সহজলভ্য করা। 

প্রীতি মণিপুরী হ্যান্ডিক্রাফটসের স্বত্বাধিকারী এন প্রদীপ কুমার সিংহ জানান, এই শিল্পের বিশ্বব্যাপী প্রসার ও তাঁতীদের রক্ষার জন্য সুদের হার কমিয়ে প্রকৃত তাঁতীদের আরও বেশি করে ঋণ দিতে হবে। মণিপুরী তাঁতীদের জন্য আলাদাভাবে ঋণ সুবিধার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, আশানুরূপ সুতা না পাওয়ায় কোয়ালিটিফুল কাপড় তৈরি করা যাচ্ছে না। সুতার অপ্রতুলতা ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাঁতের কাপড় বুননে অনেকে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। ঈদ এবং পরে পূজা ও ঈদুল আজহা এই তিন উৎসবকে সামনে রেখে বৃহত্তর সিলেটের মণিপুরি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এখন মণিপুরি তাঁতগুলো খুব ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে।

তাঁতশিল্পীরা জানান, দেশ-বিদেশে বাহারি মণিপুরি পোশাকের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। তাই সবার আগে কাঁচামাল প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

0Shares
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত