যুক্তরাজ্যে কনিষ্ঠ কাউন্সিলর বাঙালি শরিফা
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:৫২
বয়স ১৮, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন মাত্র। ইতোমধ্যে শরিফা রহমানের নামের পাশে তুখোড় রাজনীতিবিদ বসে গেছে। কারণ ১৭ নভেম্বর ইংল্যান্ডের ডারলিংটন বারা কাউন্সিলের উপনির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণী।
তবে চমকের ব্যাপার আরও আছে। শ্বেতাঙ্গ–অধ্যুষিত ডারলিংটনে মোট ৫০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ কাউন্সিলরও এই বাঙালি কন্যা। সেই সাথে প্রথম কোনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনপ্রতিনিধি।
সব প্রথমের শরিফাকে উজ্জ্বল আলোয় এনেছে তার মেধা ও সমাজ বদলের প্রতিশ্রুতি। অভিজ্ঞদের পেছনে ফেলে, ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর পক্ষে লেবারের মতো প্রভাবশালী দলের মনোনয়ন অর্জন করাও চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।
শরিফার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগ (কাউন্টি) ডারহামের ডারলিংটনে। লোকমান খান ও সাজিদা রহমান দম্পতির সাত সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ শরিফা। শরিফা রহমান তখন কুইন এলিজাবেথ সিক্সথ ফর্ম কলেজে এ লেভেল পড়েন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বর্ণবাদবিরোধী সচেতনতা তৈরির জন্য গড়ে তোলেন ইয়াং অ্যাকশন গ্রুপ। এই দলের প্রচেষ্টায় একসময় ডারলিংটনে যাত্রা শুরু হয় বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন ‘স্টেপ আপ টু রেইসিজম’-এর শাখা।
শরিফা বলেন, অভিবাসী পরিবারের সন্তান হিসেবে জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলো খুব কাছ থেকে দেখে সমাজের বৈষম্য, বর্ণবাদ ও কুসংস্কারের নানা রূপ আলোড়িত করতো শরিফাকে। তাই বেছে নিয়েছেন বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন।
শুধু এই বোধই নয়, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছাড়া নিজের মতামত তুলে ধরার সুযোগ নেই। তাই তিনি বর্ণবাদবিরোধী সভা, সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিতে ছুটে যেতেন লন্ডন, নিউক্যাসলসহ বিভিন্ন শহরে। এ সুবাদে একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন লেবার নেতা জেরেমি করবিন, ডায়ান অ্যাবোটসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। এই নেতাদের সংস্পর্শ তাকে অনুপ্রেরণা জোগায় রাজনীতির ময়দানে আসার। যোগ দেন লেবার পার্টিতে। তখন বয়স ১৬।
বর্ণবাদবিরোধী ‘ডারলিংটন ইয়াং লেবার গ্রুপ’ যখন যাত্রা শুরু করল, তখন থেকেই তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বৈষম্য ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে ডারলিংটন শহরের সম্মানসূচক পদক ‘ইয়াং সিটিজেন অব দ্য ইয়ার’ দেওয়া হয় তাকে। নগরের উন্নয়নে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছেন এমন ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দিতে ‘বেস্ট অব ডারলিংটন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পদক দেওয়া হয়।
স্থানীয় এমপি জেনি চ্যাপম্যানের সহযোগিতায় ডারলিংটনে শরিফা সম্প্রতি চালু করেছেন একটি ‘পিস ক্যাম্পেইন’ (শান্তির পক্ষে প্রচারাভিযান)। যার মূল লক্ষ্য স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বর্ণবাদের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি। পুলিশ বিভাগ এ কার্যক্রমে নিয়মিত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান শরিফা। এসবের পাশাপাশি শরিফা একটি মোবাইল ফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে খণ্ডকালীন কাজ করছেন।
গত অক্টোবরের কথা। স্বাস্থ্যগত কারণে ডারলিংটন বারা কাউন্সিলের ‘রেডহল অ্যান্ড লিংফিল্ড’ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হ্যাজেলডিন পদত্যাগ করেন। শূন্য হয় আসনটি। তত দিনে ‘এ লেভেল’ পরীক্ষা শেষ হয়েছে শরিফার। সক্রিয় রাজনীতিক শরিফা নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। লেবার দলের প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নামেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে বাগিয়ে নেন মনোনয়ন। তারপর সভা, প্রচারপত্র বিলি আর দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে ভোটের প্রচারণা চলতে থাকে।
ভোটাররা নিরাশ করেননি শরিফাকে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি এবং ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টির প্রার্থীদের হারিয়ে বিজয় নিশান ওড়ান শরিফা। ভোটের হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন ২৪৯টি ভোট, যা মোট ভোটের ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশে শরিফাদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বরমরা গ্রামে। রাজনীতিকে পুরোপুরি পেশা হিসেবে নিবেন কি না, তা এখনো ঠিক করেননি তিনি। তবে রাজনীতি নিয়েই পড়াশোনা করতে চান।
শরিফা জানিয়েছেন, অনেকের মতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি তাকেও ভাবায়। সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে বেড়াতে আসবেন তিনি।