পঞ্চগড়ের ৫ জয়িতা
প্রকাশ : ১৭ মে ২০১৬, ২০:১৯
পঞ্চগড় জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত “জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ” শীর্ষক কাযক্রমের আওতায় জেলা কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত ৫ জয়িতার জীবন সংগ্রামের কাহিনী আমাদের পাঠকদের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বড়িংপাড়া গ্রামের খোদেজা বেগম অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী। ১৯৮৩ সালে নীলফামারী জেলায় এক কৃষকের সঙ্গে বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন ১০ ভাই বোনের মধ্যে প্রথম। বিয়ের পরে দেখেন তার স্বামীর আগের আরও একটি স্ত্রী ও ৩টি ছেলে সন্তান আছে। বিয়ের ৫ বছরের মধ্যে তারও দুটি ছেলে সন্তান জন্ম হয়। সংসার জীবনে ১০ বছরের মাথায় স্বামীর অসুস্থ্যতার কারণে খোদেজাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। জমি চাষে সংসার পরিচালনা শুরু করে। ১৯৮৬ সালে আনসার ভিডিপির জেলা কমান্ডার ঢাকা গাজীপুর সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান। ৬ মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে নীলফামারীতে টেইলারিং দোকান দেন। ২০০০ সালে নীলফামারী থেকে দেবীগঞ্জে গিয়ে সেখানেই টেইলারিং দোকান দেন। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি ডেনিস বাংলাদেশ লেপ্রোসি মিশন (কমিউনিটি প্রোগ্রাম) দুঃস্থ ও প্রতিবন্ধী মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেন। ২০০৫ সালে আনসার ভিডিপি থেকে হাউস ক্রিপিং কাজে সৌদি আরবের গিয়ে সন্তানদের কথা ভেবে আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এসে দেবীগঞ্জ থানার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শিক্ষিত অশিক্ষিত অসহায় পুরুষ মহিলাদের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেণ। বর্তমানে তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪০০/৫০০ জন পুরুষ মহিলা বিভিন্ন জায়গায় টেইলারিং দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এইভাবে অর্থ উপার্জন করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও স্বামীর চিকিৎসা করেন। এক সময় তার মাথার গোজার মতো ছাদও ছিল না। বর্তমানে একটি আধাপাকা বাড়ি রয়েছে এবং সন্তান দুটিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার থানা পাড়া গ্রামের পিয়ারী বেগম শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক নারী। শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর এমএ পাশ করেন। লেখাপড়া শেষ করে স্বামীর সাথে বিদেশে যান। সেখানে দুই বছর থাকার পরে সন্তান প্রসবের জন্য স্বামীর নির্দেশে দেশে ফিরে আসেন। এরপর স্বামীকে সন্তানের ছবিসহ তার খবর পাঠিয়ে দেন। এভাবে ছয়মাস কেটে গেলে এরপর স্বামীর আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। অনেক চেষ্টায় কোন খোঁজখবর পাওয়া না গেলে শুরু হয় তার জীবনে অন্ধকারের অধ্যায়। তিন মাস সন্তানকে নিয়ে ভালই কাটছিল বাবার আশ্রয়ে। তিন মাসের মাথায় তার বাবা মারা যায়। এরপর ভাই তার সন্তানদের খরচ দিত না দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। সন্তানকে দুধের জন্য নিজের অলংকার বিক্রি করেছেন। শেষে ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা পদে দরখাস্ত করেন। ওই বছর দেবীগঞ্জ উপজেলায় তার চাকুরী হয়। তার প্রথম নিয়োগ হয় বানিয়াপাড়া প্রাথমিক সরকারী বিদ্যালয়ে। যেদিন তিনি চাকুরীতে যোগদান করেন সেদিন পায়ে তার ভাল একজোড়া সেন্ডেল ছিল না। বর্তমানে তিনি একজন সফল শিক্ষক। প্রতিবছর ভাল ফলাফল তার স্কুল জাতীয় পুরস্কার (প্রধান মন্ত্রী এ্যাওয়ার্ড) পান। তার বিদ্যালয়টি বিভাগীয় পর্যায়ে ৪ বার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় এবং জাতীয় পর্যায়ে একবার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাতখামার গ্রামের মজিমা খাতুন একজন সফল জননী। ১৯৪১ সালের ১ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের এক নিভৃত গ্রামের জম্ম গ্রহণ করেন। মজিমা খাতুন শৈশব থেকেই পড়াশুনার প্রতি অদম্য আগ্রহের ফলে স্কুলে ভালো ছাত্রী হিসেবে পরিচিতি পান। অল্প বয়সই বিয়ে হয়। স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি পড়াশুনা চালিয়ে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতা করেন। ১৯৮০-১৯৯০ দশকে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পঞ্চগড় জেলার একজন সক্রিয় সংগঠক হিসেবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী-নির্যাতন প্রতিরোধসহ নারী উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করেন। প্রত্যন্ত গ্রামের একজন নারী হয়েও তিনি তৎকালিন সকল সামাজিক বৈরিতা ও প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। মজিমা খাতুন স্বামীর বেতনের সামান্য টাকায় অভাব অনটনে ও ধারদেনার মধ্য দিয়ে সংসার পরিচালনা করেছেন এবং ৭টি সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলান। ১৯৭৪ সালে সরকারি চাকুরী প্রাপ্ত হয়েও সন্তানদের পড়াশুনার স্বার্থে তিনি চাকুরীতে যোগ দান করেনি। আর্থিক অনটন দারিদ্র ও নানা প্রতিকুলতা অতিক্রম করে সন্তানদের সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা ও সকলেই সমাজে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্থানীয়ভাবে একজন অনুকরণীয় নারী ও সফল জননী হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল চিন্তারধারক তিনি। বর্তমানেও নানাভাবে সামাজিক ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার রণচন্ডি গ্রামের তাহমিনা আক্তার ময়না নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু এক নারী। তাহমিনা আক্তার (ময়না) পিতা-মোঃ আব্দুল মালেক, মাতা-মোছাঃ রওশনারা বেগম। ময়না পরিবারে ৪ ভাই ৮ বোনের মধ্যে ৬ষ্ঠ। ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় জেঠাতো ভাইয়ের অবুঝ প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এবং তার সঙ্গেই বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামী তাকে শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন শুরু করে। স্বামীর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ক্ষোভে-দুঃখে ৪ মাসের অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় একবার পালিয়েও যান। পরে আবার স্বামীর বাড়িতে ফিরে গেলে এক কন্যা সন্তান জন্ম হয়। কিন্তু স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। ময়না তার বাবার কথায় স্বামীকে তালাক দেয়। দীর্ঘদিন পর সব লজ্জা মেনে আবার ৯ম শ্রেণিতে পড়াশুনা শুরু করেন। ২০১০ সালে এস এসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ২০১২ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ন হয়। এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ-এ ভেটেরিনারী অনুষদে (ডিভিএম) ভর্তি হন। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ এ ৩য় বর্ষের একজন অধ্যয়নরত ছাত্রী। তার কন্যা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির একজন ছাত্রী।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ডকসা পাড়া গ্রামের মোছাঃ লাইলী বেগম সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী। মোছাঃ লাইলী বেগম, পিতা-মরহুম খামির উদ্দীন, স্বামী-তোফাজ্জল হোসেন, মাতা-মোছাঃ মকছেদা বেগম, গ্রাম-ডকসা পাড়া, উপজেলা-বোদা, জেলা-পঞ্চগড়, জন্ম ১৯৭৩ সালে। লাইলী বেগম দারিদ্রতার কারণে নবম শ্রেণি পড়ায় অবস্থায় বিয়ের পিড়িতে বসেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জানতে পারে তার স্বামী পালিত সন্তান। আর তাই শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবসময় তাকে অপমান করত। এমনকি গরম ভাতের মার ঢেলে নির্যাতন করতো। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে একসময় বাবার বাড়ি চলে আসেন। এইখানে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ১০,০০০/= টাকা লোন নিয়ে স্বামীকে কাচা মালের ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। এর সঙ্গে সঙ্গে নিজে জনকল্যাণ মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করে বোদা সমাজ কল্যাণ ফেডারেশনে নির্বাচন করে পরপর ২বার নির্বাচিত হন। এমনকি তিনি স্থানীয় এনজিওতে বাইসাইকেল চালিয়ে সমিতির কিস্তী আদায় করে জীবন সংগ্রামে সফলতার মুখ দেখতে পান। ১৯৯৫ সালে আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শ্রেষ্ঠ দলনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দু দু বার নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে বিজয়ী হন। ২০০৮-২০০৯ সালে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। বর্তমানেও তিনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্বরত আছেন।