ভূটান ভ্রমণের আদ্যোপান্ত
প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৬, ১৭:৩৭
প্রথমবারের মত ভ্রমন কাহিনী লিখছি সুতরাং কোন ভুল হলে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। আমি গত ২৬ এপ্রিল রাতে শ্যামলী এস.আর বাসে করে ভূটান ঘুরে আসলাম। যাওয়ার আগে শুনতাম ছবির মতো সুন্দর একটা দেশ কিন্তু যাওয়ার পর বুঝলাম তার থেকেও সুন্দর গোছানো একটা দেশ ভূটান। এবার আসি বিস্তারিত বর্ণনায়, কিভাবে যাবেন, কই থাকবেন, কি করবেন? প্রথমেই ভারতীয় ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন হবে যা ঢাকার গুলশান শাখা থেকে করিয়ে নিতে পারবেন।
প্রথম দিন: আগে থেকে টিকিট করে রাখা শ্যামলী বাসে উঠে পরুন। আরামবাগ থেকে রাত ৮টায় এবং কল্যাণপুর থেকে ৯টায় ছাড়ে। সময় লাগে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা। তার মানে পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে আপনি বুড়িমারি সীমান্তে। ৯টায় ইমিগ্রেশন অফিস খুললে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ঢুকে পরুন ইন্ডিয়াতে। দুই সীমান্তের বর্ডারের কাজ শেষ করে আপনার জন্য অপেক্ষারত বাসটিতে উঠে পরুন।
ভুটানের যাবার জন্য শ্যামলীর বাসটি থেকে ময়নাগুরি নামক জায়গায় নেমে ১টা লোকাল বাসে উঠে পড়ুন, ভাড়া নিবে ৩০ টাকা জনপ্রতি। গন্তব্য ফালাকাটা। ঐখান থেকে নেমে সাফারি নামের গাড়িতে উঠুন ভাড়া পড়বে ৩০/৩৫ টাকা যা আপনাকে জয়গাঁও ভূটান-ইন্ডিয়া বর্ডারের কাছাকাছি নিয়া যাবে। এরপর ৭ টাকা ভাড়া দিয়ে অটোতে (আমাদের দেশে সিএনজি) উঠে চলে যাবেন জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে এবং এক্সজিট সিল লাগিয়ে সোজা চলে যান ভূটান।
মনে রাখবেন ভূটান-ইন্ডিয়া ওপেন বর্ডার, যখন খুশি যাওয়া ও বের হওয়া যায়। কোন সমস্যা নেই। আমার মতে খাওয়া দাওয়ার কাজটা জয়গাঁও তে সেরে নেয়াই উত্তম হবে।
আমরা ফুএেন্টসলিং থেকে ১টা ৮ সিটের গাড়ি ভাড়া করি এবং সোজা চলে যাই ওদের রাজধানী থিম্পুতে। যেতে যেতে প্রায় রাত ১১:৩০। ও ভালোকথা, বাংলাদেশ এবং ভুটানের সময় একদম এক (GMT+6 ) । আমরা থিম্পুতে Yoesel Hotel 2 তে ছিলাম যার ডাবল বেড রুমের ভাড়া ছিল ৭০০ রুপি এবং ট্রিপল বেড রুমের ভাড়া ছিল ৯০০ রুপি। গোছানো, ছিমছাম হোটেল।
দ্বিতীয় দিন: সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশের হোটেলের রেস্টুরেন্ট Hotel Choephal Norkye থেকে নাস্তা করে নেই। এখানের খাওয়া মজার। আমাদের প্রথম দিনের নাস্তার আইটেম ছিল চিজ এগ, পরোটা, ডাল ফ্রাই ও কফি। আমরা প্রথই দিনই থিম্পু থেকে পুনাখা নামক শহরে যাওয়ার পারমিট করিয়ে নিয়েছিলাম যেন পরবর্তীতে কোন সময় নষ্ট না হয়।
অফিসিয়াল কাজ শেষে আমরা থিম্পুতে সিটি ট্রিপ দিলাম এর মধ্যে zoo, Dzhong, Monestry ছিল কিন্তু বুদ্ধা পয়েন্ট ছিল মনে রাখার মতন ১টা জায়গা। এক কথায় চমৎকার। অসম্ভব সুন্দর ১টা শহর। দেখলেই মন ভরে যায়।
তৃতীয় দিন: যাত্রা এবার পুনাখা। সকাল ১০টায় রওনা দিলাম, ২/২:৩০ ঘণ্টার মতন সময় লাগে পৌছাতে। যাওয়ার পথে Dochu La Pass, Punakha Dzhong, এবং Suspension Bridge তো মাথা নষ্ট করে দেয়।
আবহাওয়া অন্য শহর থেকে একটু ভিন্ন কিন্তু খুবই উপভোগ্য। কেউ ভূটান গেল, কিন্তু পুনাখা গেল না, তাহলে তার ভূটান যাত্রাই অপূর্ণ। সারাদিন ঘুরে রাতে আবার থিম্পুতে ফিরে গেলাম কারন পুনাখাতে থাকার মতন ভাল হোটেল নেই। আর থিম্পু হয়ে যেহেতু পারো যাওয়া লাগে তাই থিম্পুতে চলে যাওয়াটাই ভাল সিদ্ধান্ত।
চতুর্থ দিন: থিম্পু এবং পুনাখা দেখা শেষে এবার আমাদের যাত্রা স্বপ্নের শহর পারো এর উদ্দেশে। এখানে আমরা ছিলাম Hotel Dragon এ, এটা ইন্ডিয়ান হোটেল খুব সম্ভবত এর মালিক কলকাতার লোক। তাই এখানে সব ধরনের বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। যেমন; সাদা ভাত, আলু ভর্তা, আলু ভাজি, শুকনা মরিচ দিয়া আলু ভর্তা, খাসির তরকারি, মুরগির তরকারি, সবজি এক কথায় পুরা ১৬ আনা বাঙালি খাওয়া তবে দাম একটু বেশি। তবে কয়েক দিন টানা ফ্রাইড রাইস আর চাওমিন খেতে খেতে আমরা অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তাই বাঙালি খাবার পেয়ে এই সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করি নাই।
এখন আসি আসল কথায়, পারো হচ্ছে ওদের সবথেকে সুন্দর শহর, এই শহরেই ওদের একমাত্র আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট আছে। থিম্পু থেকে আসার পথে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে যা না দেখলেই নয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল case bridge. এটা যেমন মজার তেমনই ভয়ঙ্কর।
পঞ্চম দিন: এবার পারোর সব থেকে বড় আকর্ষণ Tiger Nest/ Paro Taktsang, যেটা ওদের ধর্মীয় এবং পর্যটনের দিক থেকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিন হাজার ফুট হেঁটে উঠতে হবে আবার নেমে আসতে হবে। পায়ে হাঁটার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নাই। আমাদের উঠতে সময় লেগেছিল প্রায় ৩:৩০ ঘণ্টার মতন আবার নামতে সময় লেগেছে ১ ঘণ্টার বেশি। দিন শেষে এটাই ছিল সব থেকে মজার এবং সারা জীবন মনে রাখার মতন একটা ঘটনা।
ষষ্ঠ দিন: ভুটানের সব সুন্দর স্মৃতি সাথে নিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য আরেক সৌন্দর্যের রানি দার্জিলিং। চা বাগানে ঘেরা অপরূপ সুন্দর দার্জিলিং শুধু টিভিতেই দেখেছি কিন্তু এবার সুযোগ এসেছে সামনে থেকে দেখার। এবার রওনা হলাম পারো থেকে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। সকাল ১১টা। আমাদের যাত্রা শুরু। ৪:৩০/৫ ঘণ্টা সময় লাগে ফুএেন্টসলিং পৌছাতে। পথে যাত্রা বিরতি বেশি নিলে সময়তো একটু বেশি লাগবেই। অবশেষে ভূটান বর্ডার গেটে পৌছালাম স্থানীয় সময় ৫টায়। এক্সিট সিল নিয়ে হেঁটে চলে গেলাম ইন্ডিয়ার ভিতর সোজা ওদের ইমিগ্রেশন অফিসে আর লাগিয়ে নিলাম এন্ট্রি সিল। যেহেতু দার্জিলিং যাব তাই রাতটা শিলিগুড়ি থাকতে হবে। ৩,৫০০ টাকায় একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম এবং রাত ১০:৩০ নাগাদ শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম। বলে রাখা ভাল যে ইন্ডিয়া ঢুকেই ইন্ডিয়ার ১টা মোবাইল সিম কিনি ইন্টারনেট প্যাকেজ সহ। তাই অনলাইনেই ১টা হোটেল বুক দিয়ে সরাসরি উঠে পড়ি হোটেলে। ২ রুম, ২ রাত সর্বমোট ৩,০০০ রুপি। রাতে আরেকটা গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম পরের দিন সারা দিন যেন ভালভাবে ঘুরতে পারি কোন ঝক্কি ছাড়া।
সপ্তম দিন: ভোর ৪:৩০ টায় ঘুম থেকে উঠে আগের দিন ঠিক করে রাখা গাড়ি করে পুরো দার্জিলিং শহরটা ঘুরে দেখলাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Zoo, Rock Garden, Bazar, Tiger Hill. বলে রাখা ভালো যে দার্জিলিং শহরে ঢাকার মতন ট্রাফিক জ্যাম হয়। সারাদিন ঘুরাফিরা শেষে এবার হোটেলে ফিরার পালা। বাস শিলিগুড়ি থেকে ছাড়ে বলে শিলিগুড়িতেই আবার ফিরে গেলাম।
অষ্টম দিন: গত কয়েক দিনের ক্লান্তি পুষিয়ে নেবার জন্য এবার একটা সেই ঘুম দেয়ার পালা কারন বাস তো সেই ১:৩০ এ। যে কথা, সেই কাজ। ১০ টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিলাম এবং সকালে নাস্তা করলাম স্ট্রিট ফুড দিয়ে। ২০ রুপিতে ৩ টে পরটা এবং refillable ডাল। চমৎকার স্বাদ, পেটেও তৃপ্তি, জিহ্বাতেও তৃপ্তি। হাল্কা ঘুরে, বিধান মার্কেটে শপিং করে বাসে উঠে গেলাম। গন্তব্য এবার বাংলাদেশ।
কিছু করনীয়:
১. ডলার চেংরাবান্দাতেই ভাংগাবেন কারণ পুরো ভুটানে আমার চোখে কোন মানি এক্সচেঞ্জার পরে নাই। ভুটানে কোন সমস্যা ছাড়াই ইন্ডিয়ান রুপি চলে, সুতরাং ইন্ডিয়ান ৫০০ আর ১০০ করে টাকা নিয়া যান।
২. দার্জিলিং যদি যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলেও ডলার চেংরাবান্দাতেই ভাংগাবেন কারণ দার্জিলিং শহরে রেট অনেক কম দেয়।
৩. অবশ্যই ১০০ ডলারের নোট নিয়ে যাবেন কারণ ৫০ বা খুচরা নোটে কম রেট দেয়। আর সর্বদাই চেষ্টা করবেন নতুন ১০০ ডলারের নোটটা নিতে। (আমি চেংরাবান্দাতে ৬৬ রুপি করে পেয়েছিলাম) ।
৪. ভূটান ও দার্জিলিং এ হোটেলে অবশ্যই দামাদামি করে উঠবেন এতে ২০০/৩০০ টাকা প্রতিদিন শুধু হোটেলেই সেভ হবে।
মোবাইল সিম: B-Mobile & Tashicell নামের দুটো কোম্পানি আছে, Tashicell বেস্ট। কারণ এটাতে 3G ইন্টারনেট আছে কিন্তু B-Mobile এর টুরিস্ট সিমের জন্য কোন ইন্টারনেট অফার নেই।