পাহাড়ি কন্যা শিলং (১ম পর্ব)
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:৫৯
দেশের বাইরে ঘুরতে যাবার স্বপ্ন মনে মনে বুনছে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। গেলেও হাতেগোনা। আমি আর আমার তিনিও এই স্বপ্নবোনা মানুষগুলোরই একজন। অনেকদিন ধরেই দুজন পরিকল্পনা করছিলাম কম খরচে দেশের বাইরে কোথায় যাওয়া যায়। সিলেট থাকি। পাশেই মেঘ-পাহাড়ের রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। জাফলং-বিছানাকান্দি এসব ঘুরতে যাওয়া হয় প্রায়ই। সেখানে গিয়ে বড় উঁচু উঁচু পাহাড় দেখে আমাদের দু’জনের মনেই ইচ্ছা জাগতো ইস্ যদি দেখতে পারতাম পাহাড়ের ওপারে কি আছে! কাছ থেকে কেমন লাগে দেখতে পাহাড়গুলো? কিন্তু সময়-সুযোগ সায় দিচ্ছিলো না। পাসপোর্ট করেছি আমরা প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম যা আছে হবে। এবার যাবোই। কোনো বাধা ছাড়াই ভিসা পেয়ে গেলাম। এখন যাওয়ার অপেক্ষা। আমরা অপেক্ষা করছিলাম বৃষ্টির। কারণ বৃষ্টি না হলে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত এলাকা চেরাপুঞ্জির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো না। কিন্তু মন উতলা হয়ে আছে। তাই আর সাতপাঁচ না ভেবে বের হয়ে পড়লাম আমরা।
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, ০৮/০৩/২০১৮। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সকাল ৭টায় বের হলাম। উদ্দেশ্য তামাবিল জিরো পয়েন্ট বর্ডার। সিলেট থেকে তামাবিল যেতে দু’ঘন্টা সময় লাগে। ৯টায় বর্ডার খুলে। সকাল সকাল ভিড় কম থাকে তাই বর্ডার এর কাজগুলো নির্বিঘ্নে করা যাবে। ভার্সিটি গেট থেকে সিএনজি করে আমরা বন্দর পয়েন্টে গেলাম। ভাড়া জন প্রতি ১৫ টাকা। বন্দরে নাস্তা করে আমরা আবার সিএনজি নিলাম তামাবিলের জন্য। ভাড়া ৬০০ টাকা করে। তামাবিলে এসে পৌঁছলাম ৯.৩০ এ। প্রথমে ইমিগ্রেশন এ যেতে হলো। একটি করে ফর্ম দিলো। পূরণ করে জমা দিয়ে তারপর কাস্টমস এ। বলে রাখি ইমিগ্রেশন এর পুলিশ ঝামেলা করলেও করতে পারে।
দেশের কাজ শেষ করে আমরা প্রবেশ করলাম ভারতের ইমিগ্রেশন সেন্টারে। দেশের বাইরে প্রথম পা রাখলাম, ভাবতেই অবাক লাগছে। সেখানে কাজ শেষ করে আমরা ট্যাক্সি খুঁজতে থাকলাম সরাসরি শিলং এর। কিন্তু ভাড়ায় মিলছিলো না তাই আমরা লোকাল ট্যাক্সি নিয়ে ডাউকি বাজারে গেলাম। জন প্রতি ভাড়া ১০রুপি। বলে রাখি এখানে একটু দামাদামি করে উঠাই ভালো। আমরা আগে থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছিলাম। ডাউকি থেকে শিলং এর পুলিশ বাজার পয়েন্ট এ ভাড়া ঠিক হলো ২১০০ রুপি, মাঝে দু’টো জায়গা লিভিং রুট ব্রীজ (living root bridge) এবং মাওলিনং ভিলেজ (Mawlynnong village) দেখে যাওয়া সহ। living root bridge হচ্ছে গাছের শেকড় দিয়ে তৈরী সেতু, যার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে সবুজ পানির ধারা। Mawlynnong village বিশ্বের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম। ডাউকি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। অপরূপ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আমরা চলতে লাগলাম শিলং এর দিকে, আর মুগ্ধ নয়নে দেখলাম মেঘ আর পাহাড়ের মিল-বন্ধন। যতই গাড়ি এগোচ্ছে আমার মুগ্ধতা বেড়েই চলছে। যে পাহাড়গুলো এতদিন শুধু দূর থেকে দেখতাম আজ তার উপর দিয়ে যাচ্ছি, ছুঁতে পারছি। মাঝেমাঝে সূর্য উঁকি দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
চলতে চলতে আমরা চলে এলাম living root bridge এর কাছে। টিকেট কেটে (২০রুপি) প্রায় শ’দুয়েক সিড়ি ভেঙ্গে আমরা নিচে নেমে ব্রিজ এর দেখা পেলাম। প্রকৃতি নিজে নিজেই কিভাবে নিজের সৌন্দর্য বাড়িয়ে নিচ্ছে তা এই জীবন্ত সেতু দেখলেই বোঝার বাকি থাকে না। গাছের শেকড় পরম মমতায় একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে দুপ্রান্তকে এক করেছে। এখান থেকে চলে গেলাম মাওলিনং ভিলেজ (Mawlynnong village)। সবুজে ঘেরা গ্রাম, রাস্তার কোনায় কোনায় রয়েছে বেতের তৈরী ময়লা ফেলার ঝুড়ি। গ্রামটিকে দেখে আমাদের খাসিয়া পল্লীর মত মনে হলো। এখানেই একটি Bangladesh View Point নামে জায়গা আছে, বাঁশের তৈরী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। দুপুরের খাবার আমরা এই গ্রামেই সেরে নিলাম, ভাত-সবজি-ডাল-মাছভাজা। আবার রওনা হলাম। পাহাড়ের কোলঘেঁষে রাস্তা, সবুজে ঘেরা চারপাশ দেখতে দেখতে বিকেল ৩.৩০ এ আমরা পুলিশ বাজার এ এসে পৌছলাম। এবার শুরু হলো হোটেল খোঁজা। আগে থেকে বুকিং দিলে খরচ বেশি, তাই যেয়ে খোঁজাই ভালো। সব রকমেরই হোটেল আছে। হোটেল ভাড়া ১২০০-২১০০ রুপি এর মধ্যে। হোটেলে গিয়ে আমরা একটু রেস্ট নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম পুলিশ বাজার ঘুরতে। নানা ভাষার, নানা পেশার, নানা দেশের মানুষের সমাগম এই বাজারে। রাস্তা ভর্তি ছোটছোট খাবার দোকানে। শুনে এসেছিলাম এখানকার স্ট্রিট ফুড খুব বিখ্যাত। আসলেও তাই। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই। তবে অবশ্যই একটু সাবধানে, এখানে নানা প্রজাতির মাংস বিক্রি হয়। সবচেয়ে মজা লেগেছে মম। আরো খেলাম বিখ্যাত পানিপুরি। রাতে একটি বাঙালি খাবারের দোকান পেয়েছিলাম, নাম সুরুচি, খাবার মোটামুটি। তারা আমাদের মত মসলা দিয়ে রান্না করে না, তাই একটু খেতে কষ্ট হবে অনেকেরই। একটা কথা না বললেই নয় এখানকার জীবন অনেক দ্রুতগামী, কে কি করছে তা দেখার সময় কারো নেই। আমাদের দেশের মতই ওখানেও রাত ৮টার মধ্যে সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
পরদিন ভোর ৬টায় উঠে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে নাস্তা খেতে হবে। বের হয়ে পয়েন্ট এ যেতে দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য। রাতের খাবারের একটা দোকান নেই, সেইসব জায়গায় স্থান করে নিয়েছে লুচি-আলুর ডাল, রুটি-সবজি আর ডিমের দোকান। বুঝতে বাকি রইলো না তাদের সময় ভেদে একই জায়গায় ব্যবসার পরিবর্তন হয়। ২টা লুচি-ডাল ২০ রুপি। নাস্তা খেয়ে আমরা ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলাম। আজকের উদ্দেশ্য লোকাল টুরিস্ট প্লেসগুলো বেড়ানো। ভাড়া ঠিক হল ১৭০০ রুপি। স্থান- বারাপানি লেক (উমিয়ামলেক), ডনভস্কো মিউজিয়াম, এলিফেন্ট ফলস, গলফ লিংক, চার্চ, লেডি হায়দারি পার্ক, ওয়ার্ডস লেক। শিলং পিক এ এখন টুরিস্ট যেতে দেয় না, কারণ এটা তাদের এয়ারফোর্সের কার্যায়লের পাশ দিয়ে যেতে হয়। উমিয়াম লেকে দেখতে পেলাম পাহাড় আর পানির সখ্যতা, নীল-সবুজের মেল-মিলাপ। আমরা যেহেতু ফাল্গুন মাসে গিয়েছি তাই ফলসগুলোতে পানি ছিল না। তবে এলিফেন্ট ফলস এ ভালোই পানি ছিলো। ডনভস্কো মিউজিয়াম এ টিকেট মূল্য জন প্রতি ২০০ রুপি, ক্যামেরা আলাদা ১০০ রুপি। এখানে দেখা মিলবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরিচিতি থেকে শুরু করে সেখানের আদিম-অধিবাসীদের জীবন ধারা, তাদের ধর্ম, তাদের জীবিকা, হাতিয়ার, উৎসব, পোশাক-আশাক সব। লেডিহায়দারি পার্ক এবং ওয়ার্ডস লেকে গিয়ে মনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এ দু’টোর মাঝে গেলে বোঝার উপায় নেই যে বাইরে এত ব্যস্ত কোলাহলপূর্ণ জীবন। লেডিহায়দারি পার্কের একপাশে চিড়িয়াখানা, আর এক পাশে বসার জায়গা, সাথে বাচ্চাদের খেলার সকল আয়োজন। বসন্ত যেন তার সব সৌন্দর্য এখানে ঢেলে দিয়ে গেছে। লাল-নীল-হলুদ-বেগুনী ফুলের সমারোহে একাকার হয়ে আছে পার্কগুলো। ওয়ার্ডস লেকে কায়াকিং এর ব্যবস্থা আছে, সময় এবং মানুষ অনুপাতে টিকেটের মূল্য। ওহ একটা কথা বলে নেই এখানে যেকোনো টুরিস্ট প্লেসেই প্রবেশ মূল্য রয়েছে এবং ডিএসলার বা অন্য যেকোনো ক্যামেরার জন্য আলাদা মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সব জায়গা ঘোরা শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বিকেল ৫টায় রুমে ফিরলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আবার গেলাম পুলিশ বাজারের স্ট্রিট ফুড খেতে আর বাজার ঘুরে দেখতে। এখানে কেনার মত তেমন কিছু পাইনি। বেতের তৈরী কিছু জিনিস ছিলো কিন্তু সেগুলো আমাদের দেশেই খাসিয়াপল্লিতেও দেখেছি।