বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল’, হলিক্রস ছাত্রীর আত্মহত্যা (ভিডিও)
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:১২
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য প্রাণনাশের পর এবার বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে ডার্ক ওয়েব গেম 'ব্লু হোয়েল'। এই নীল তিমির আক্রমনে বাংলাদেশে শিকার রাজধানী ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের এক কিশোরী। গত ৫ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) সকালে ওই কিশোরীর পড়ার কক্ষ থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, নিহত ঐ কিশোরীর নাম অপূর্বা বর্মন স্বর্ণা (১৩)। ওয়াইডব্লিউসিএ হাইয়ার সেকেন্ডারি গালর্স স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে। বর্তমানে সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
গত ৪ অক্টোবর (বুধবার) দিবাগত শেষ রাতে সে নিজের পড়ার কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে। পরদিন ৫ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) তার ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত কিশোরীর পিতার সন্দেহ, ইন্টারনেটভিত্তিক ডেথ গেমস ব্লু হোয়েলের কারণেই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ব্লু হোয়েলের কিউরেটরের নির্দেশ মতো লিখে যাওয়া একটি চিরকুটও উদ্ধার করা হয়। তাতে বড় করে লেখা, ‘আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়।’ লেখা শেষে গেমসের নির্দেশনা মতো একটি হাসির চিহ্ন আঁকা। চিরকুটটি বর্তমানে পুলিশের হাতে।
কিশোরীর পিতা অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মন বলেন, স্বর্ণা কয়েক বছর ধরে কম্পিউটার ও এনড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করছিল। বিভিন্ন বিষয় ডাউনলোড করে পড়তো। কিন্তু কিছুদিন আগে আমাদের মনে সন্দেহ জাগে। গত পনের দিন আগে আমি তার মোবাইল চেক করলে সে অভিমান করে। মনে হয়েছে আমি তার কক্ষের ঢোকার আগ মুহূর্তেই হয়তো কিছু গোপন জিনিস ডিলিট বা সরিয়ে ফেলেছে। তখন তাকে মোবাইলে একটি প্যারা পড়তে দেখি। এরপর থেকে যতই এই আত্মহত্যার দিন ঘনিয়ে আসে ততই সে আমাদের সঙ্গে বেশ আন্তরিকতা দেখিয়ে যাচ্ছিলো। যেন আমরা তাকে কোনোভাবে সন্দেহ না করি।
সুব্রত বর্মন জানান, আত্মহত্যা নির্বিঘ্ন ও মৃত্যু নিশ্চিত করতে আগে থেকেই স্বর্ণা বেশ পরিকল্পনা করে। চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে গত ৪ অক্টোবর বুধবার বাসায় ফেরার পর ইনস্যুলিন নেয়ার আগে স্বর্ণা তাকে একটি ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়। স্বর্ণার কক্ষে এসি থাকায় সুব্রত বর্মন তার কক্ষেই শুয়ে পড়েন এবং স্বর্ণাকে তার মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে অন্য কক্ষে ঘুমাতে বলেন। কিন্তু রাত একটার দিকে স্বর্ণা তার বাবাকে জাগিয়ে নিজের কক্ষে যেতে বলে এবং কিশোরী কাজের মেয়ের সঙ্গে যথারীতি সে নিজের কক্ষে যায়।
সুব্রত বর্মন বলেন, তার কক্ষের দরজার লক খোলা রাখা হতো। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমি ও তার মা মর্নিং ওয়াকে বের হওয়ার আগে তার মা স্বর্ণার দরজায় টোকা দেয়। কিন্তু দরজা বন্ধ পেয়ে সে চাবি দিয়ে দরজা খোলে। এরপর মেয়েকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় নাইলনের ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখে।
তিনি বলেন, খাটের উপর ডায়নিং রুমে বসানো একটি চেয়ার পড়ে থাকতে দেখি আমরা। চেয়ারটি ফ্যানের নিচে খাটের কোণে বসানো হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। তা খাটের পশ্চিম পাশে নিচে পড়লেই জেগে উঠতো কাজের মেয়েটি। তা যাতে না হয় এবং কোনো শব্দ যাতে না হয় সে জন্য তা খাটের বেডের উপর ফেলা হয়।
এভাবে আত্মহত্যার আগে-পরের নানা পরিস্থিতি ও আলামত বিবেচনা করে তার বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, তার আদরের মেয়ে ব্লু হোয়েলের শিকার।
অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মন আরো বলেন, তার মৃত্যুর পর আমি ব্লু হোয়েলের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছি। এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। বাংলাদেশের আইনে যদি এই অপরাধের জন্য উদ্ভাবকের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ থাকে আমি মামলা করব। এই গেমে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। তাই আমি অনুরোধ কেউ যেন কৌতূহলের বশেও এই গেমসে না ঢুকে।
ব্লু হোয়েল আসলে কী:
এটি আদতে সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন কিংবা নিছক গেম নয়। এটি সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক একটি ডিপওয়ে গেম। যেসব কম বয়সী ছেলে-মেয়ে অবসাদে ভোগে তারাই সাধারণত আসক্ত হয়ে পড়ে এ গেমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কোনো ক্লান্তি বা বিষণ্নতা দূর করার গেম নয়। আত্মহত্যার প্রবেশ পথ মাত্র। ভারতে ব্লু হোয়েলে আসক্ত হয়ে আত্মঘাতী কয়েক তরুণের সুইসাইডাল নোটে লেখা হয়েছে, ‘ব্লু হোয়েলে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায়না’।
জানা যায়, এই গেমে ৫০টি ধাপ রয়েছে। প্রথম দিকে একই গেমের কিছু সহজ কাজ থাকে। এক বা একাধিক কিউরেটর দ্বারা চালিত হয় এই গেম। কিউরেটরদের নির্দেশেই গেমের এক একটি নিয়ম মেনে চলতে থাকে অংশ গ্রহণকারীরা। নিয়ম অনুযায়ী একবার এই গেম খেললে বেরুনো যায় না। কেউ বেরুতে চাইলেও তাদের চাপে রাখতে পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয় বলে আলোচনা আছে। এই গেমের বিভিন্ন ধাপে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। যেমন ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা, সারা গায়ে আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করা, কখনো ভোরে একাকি ছাদের কার্নিশে ঘুরে বেড়ানো, রেল লাইনে সময় কাটানো, ভয়ের সিনেমা দেখা ইত্যাদি। চ্যালেঞ্জ নেয়ার পর এসব ছবি কিউরেটরকে পাঠাতে হয়। ২৭তম দিনে হাত কেটে ব্লু হোয়েলের ছবি আঁকতে হয়। একবার এই গেম খেললে কিউরেটরের সব নির্দেশই মানা বাধ্যতামূলক। সব ধাপ পার হওয়ার পর ৫০তম চ্যালেঞ্জ হলো আত্মহত্যা। এই চ্যালেঞ্জ নিলে গেমের সমাপ্তি।
রাশিয়ায় শুরু হলেও এই গেমের শিকার এখন এশিয়ার অনেক দেশ। ভারতে গত দু’মাস ধরে ব্লু হোয়েল নিয়ে চলছে শোরগোল। স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ব্লু হোয়েল লিংক সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের সরকার। পাশাপাশি এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি।
সাধারণভাবে গোপন গ্রুপের মধ্যে অপারেট করা হয় এ গেম। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের মতো জনপ্রিয় স্যোশাল ফ্লাট ফরমকে কাজে লাগায় এডমিনরা।
২০১৬ সালে রাশিয়ায় ব্লু হোয়েল গেমের কিউরেটর সন্দেহে ফিলিপ বুদেকিন নামের ২২ বছরের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেরায় ফিলিপ স্বীকার করে, এই চ্যালেঞ্জের যারা শিকার তারা এই সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি সমাজ সংস্কারকের কাজ করছেন।
কীভাবে বুঝবেন কেউ ব্লু হোয়েলে আসক্ত:
যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদেরকে সব সময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় স্যোশাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনো আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা।