প্রতিরোধের মার্চ
১৯৭১ এর উত্তাল ১৯ মার্চ
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০১৭, ২০:৫৮
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলতে থাকলেও জয়দেবপুরের ঘটনায় সবাই বুঝে ফেলে এ আলোচনা মূলত বাঙালি জাতির সঙ্গে প্রহসন মাত্র যা আলোচনার নামে শুধু কালক্ষেপণ মাত্র।
১৯ মার্চ ’৭১ শুক্রবার জয়দেবপুরের মাটিতেই শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। এদিনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির তরফ থেকে প্রথম গর্জে উঠেছিল আগ্নেয়াস্ত্র এবং বীর বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এ রেজিমেন্টের ২৫-৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন বাঙালি অফিসার- সৈনিক। ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ এলো, ১৫ মার্চের মধ্যে রাইফেলগুলো গুলিসহ ব্রিগেড সদর দফতরে জমা দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি অফিসার-সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করলো। ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার পাকিস্তানী এক ব্রিগেডিয়ার নিজেই ১৯ মার্চ দুপুরেই জয়দেবপুর সেনানিবাসে উপস্থিত হলেন। বাঙালি সৈন্যদের পাঞ্জাবিরা নিরস্ত্র করতে এসেছে এ খবর দাবানলের মতো জয়দেবপুর ও আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
১০ হাজারের ও বেশি মুক্তিকামী জনতা জড়ো হয়েছিল জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১৫০টির মত ব্যারিকেড দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবরোধ করে রাখে। জনতার হাতে ছিল হাতে লাঠিসোটা, তীর ধনুক। পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার সেনানিবাসে বসেই এ খবর পান। তিনি ব্যারিকেড অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেন। জনতা ক্ষোভে ফেটে উঠে, পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ারকে জানিয়ে দেয় ব্যারিকেড সরানো হবে না। এরপর পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার সামনে বাঙালি সৈন্য ও পেছনে পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন ঢাকার দিকে। কিন্তু ব্যারিকেডের জন্য এগোতে না পেরে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন।
পাকিস্তানি সেনারা সেদিন বহু কষ্টে ব্যারিকেড অপসারণ করে জয়দেবপুর বাজারে পৌঁছে এবং কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়। সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হয় কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। এছাড়া গুলিতে আহত হন ইউসুফ, সন্তোষ ও শাহজাহান আরো অনেকে। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তার আরো অনেক ব্যারিকেড অপসারণ করে ঢাকার পথে চান্দনা-চৌরাস্তায় উপস্থিত হয়। এখানেও উত্তেজিত জনতা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। চান্দনা-চৌরাস্তায় প্রতিরোধকালে হুরমত আলী নামে এক অসমসাহসী যুবক একজন পাঞ্জাবি সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করতে চেষ্টা করে। সে সময় অপর একজন পাঞ্জাবি সৈন্যের গুলিতে হুরমত আলী শহীদ হন। চান্দনা-চৌরাস্তায় কানু মিয়া নামে আরেক ব্যক্তি গুলিতে আহত হয় এবং পরে সে আহতাবস্থায় মারা যায়। পরে পাকিস্তানি বাহিনী টঙ্গীসহ রাস্তায় আরো অনেকগুলো ব্যারিকেড সরিয়ে অতি কষ্টে ঢাকায় পৌঁছতে সক্ষম হয়।
বীর বাঙালির জয়দেবপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা সেদিনই সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় বিবিসি থেকেও ফলাও করে এ প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা প্রচার করা হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময় জয়দেবপুরের এ প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন এবং এ সম্পর্কে বিবৃতি দেন। উত্তালমুখর সারা বাংলাদেশে তখন একটিই স্লোগান- ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’