চোখের রেটিনা সমস্যা

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০১৭, ০৩:১৯

অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ

রেটিনা হচ্ছে চোখের ভিতরের একটি সংবেদনশীল পর্দা যেখানে আমরা যা দেখি সেই ছবিটি ধারণকৃত হয়। আমরা যখন চোখে কম দেখি তখন স্বাভাবিকভাবে মনে হয় চোখের চশমা অথবা ছানি জনিত সমস্যা। কিন্তু উপরোক্ত সমস্যা ছাড়াও চোখের একবারে ভিতরের অংশ রেটিনায় অনেক অসুবিধার জন্য চোখের কম দেখার বিষয়টি অনেক সময় আমাদের বিবেচনায় থাকে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেটিনার রোগ জনিত কারণে কম দেখার বিষয়টি আমরা কিভাবে বুঝতে পারব।

প্রথম: 
বলতে গেলে রেটিনা জনিত কারণে চোখে কম দেখার বিষয়টি রোগীদের বুঝতে পারা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সাধারণত: চোখে কম দেখলে রোগীরা চোখের ডাক্তার-এর কাছে যান এবং চোখের দৃষ্টিশক্তির সমস্যাটি রেটিনার কারণে হয়েছে কি না তা নিরুপন করে রেটিনা বিশেষজ্ঞ-এর নিকট পাঠিয়ে থাকে। তবে এই ধরণের যোগাযোগ বিলম্বিত হওয়ার কারণে রোগীদের দৃষ্টি শক্তির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে রেটিনা জনিত কারণে দৃষ্টি শক্তির সমস্যার বিশেষ কোন লক্ষণ আছে কিনা? অত্যন্ত সরলভাবে বলতে গেলে চোখের দৃষ্টি শক্তি হ্রাস চশমা দ্বারা উন্নতি না হলে, আঘাত জনিত কারণে চোখে কম দেখলে, চোখের সামনে কালো কিছু ভাসতে থাকলে, চোখের সামনে আলোর ঝলকানো দেখা দিলে, চোখে কালো পর্দার মত কিছু পড়তে দেখলে এবং কোন ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি হঠাত্ করে কমে গেলে রেটিনা জনিত চোখের সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে রেটিনার জন্য দৃষ্টিশক্তি কমলে চোখে কোন ব্যথা অনুভূত হয় না।
 
দ্বিতীয়ত: 
রেটিনার রোগ বয়স ও কারণ ভেদে বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কোন কোন রোগ জন্মের কিছু দিনের মধ্যে চিকিত্সা না করালে সারা জীবন অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। যেসব শিশু মায়ের গর্ভে আট মাস অথবা তার পূর্বেই ভূমিষ্ট হয় অথবা জন্মের সময় ওজন দেড় কেজি বা তার কম হয় সেই সব শিশুদের জন্মের ত্রিশ দিনের মধ্যে অবশ্যই রেটিনা পরীক্ষা করা জরুরী।
 
শিশুদের জন্য আরেকটি রোগ হল রেটিনার টিউমার। সাধারণত: তিন বছর অথবা তার নীচে শিশুরা চোখে কম দেখলে অথবা শিশুদের চোখের মনি সাদা দেখা গেলে তাহা জন্মগত ছানি বলে আমরা ধারণা করে থাকি। একই রকম উপসর্গ শিশুদের রেটিনা টিউমার হলেও হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় বা চিকিত্সা না করলে সারা জীবনের জন্য অন্ধ হতে পারে এমনকি শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আশার কথা হলো, সঠিক সময়ে উপরোক্ত দুইটি রোগ নির্ণয় ও চিকিত্সা করালে দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ ধরণের চিকিৎসা অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে বাংলাদেশেই সম্ভব।
 
তৃতীয়ত: 
আমাদের শারীরিক অনেক রোগ আছে যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, বার্ধ্যক্য জনিত সমস্যা ইত্যাদি কারণেও রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস ত্রিশ বত্সরের পূর্বে ধরা পড়ে এবং ইনসুলিন ছাড়া কন্ট্রোল হয় না, সাধারণ বিশ বত্সর পর প্রায় প্রত্যেকেরই রেটিনার সমস্যা দেখা দেয়। অপরপক্ষে যাদের ডায়াবেটিস ত্রিশ বছর-এর পর ধরা পড়ে তাদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ার সময়েই চোখের রেটিনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, কারণ তাদের শতকরা ২০ জনের কোন না কোন রেটিনার সমস্যা রোগ নির্ণয়ে সময় বর্তমান থাকে। এছাড়া ডায়াবেটিক রোগীর হঠাত্ করে দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে অথবা চোখের সামনে কালো কিছু ভাসতে থাকলে দ্রুত রেটিনা বিশেষজ্ঞ দেখানো উচিত।
 
উচ্চ রক্তচাপের কারণে যেমন মস্তিষ্কে অথবা হূদযন্ত্রে ষ্ট্রোক হতে পারে তেমনি ইহা রেটিনার রক্তনালীকেও বন্ধ করে রেটিনার স্ট্রোক করাতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপ জনিত ব্যক্তি হঠাত্ করে চোখে কম দেখলে রেটিনা বিশেষজ্ঞ-এর শরনাপন্ন হওয়া আবশ্যক। বার্ধক্য জনিত শরীরে অন্য সব অঙ্গের মত রেটিনা রোগাক্রান্ত করে। ছানি অথবা চোখের উচ্চচাপ জনিত কোন কারণ না থাকলে এবং চশমার দ্বারা দৃষ্টিশক্তির উন্নতি না হলেও চোখে আকা বাঁকা এবং অস্পষ্ট দেখা অথবা কোন ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ক্রমাগতভাবে ধীরে ধীরে কমতে থাকলে রেটিনাতে সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।
 
পরিশেষে, রেটিনা রোগীদের সকল প্রকার পরীক্ষা যেমন চোখের এনজিওগ্রাম, চোখের স্ক্যান এবং চিকিত্সা যেমন রেটিনার অস্ত্রেপচার, লেজার এবং বিভিন্ন ধরণের বিদেশী উন্নতমানের ইনজেকশন বর্তমানে বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এই ধরণের চিকিত্সা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল এবং ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালসহ কিছু বে-সরকারি হাসপাতালেও বিদ্যমান আছে। রেটিনা রোগীদের সচেতনতাই বিদ্যমান রেটিনা চিকিত্সার সুবিধাকে গ্রহণ করে অন্ধত্ব হতে মুক্ত তথা সবল দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
 
লেখক: বিভাগীয় প্রধান (রেটিনা বিভাগ), জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্র: ইত্তেফাক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত