অটিস্টিক শিশুর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০১৭, ০১:১৮

জাগরণীয়া ডেস্ক

অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের সবার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো একরকম হয়না। কেউ কেউ মারাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতায় ভোগে; কারও হয়তো সেই ক্ষমতা সীমিতভাবে থাকে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুর মধ্যে খুব অল্পবয়স থেকেই (২/৩ বছর) অটিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ২য় পর্বে জেনেছি শিশুবিকাশের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছে; সেগুলোর ভিত্তিতেই উদাহরণ দেয়া যাক।
 
সামাজিক মিথস্ক্রিয়া
শিশুকে নাম ধরে ডাকলে সাড়া তো দেয়ই না, এমনকি চোখ ফিরিয়েও তাকায় না। সে হয়তো নামের ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনা, একেবারেই নির্লিপ্ত থাকে। অথবা ডাকের ব্যাপারটা শুনে বুঝতে পেরে যে কাজ বা খেলায় সে ব্যস্ত ছিল সেটা কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে দেয়; কিন্তু যে ডাকছে তার দিকে ফিরে তাকায়না।
বাবামা বা নিয়মিতভাবে দেখা হচ্ছে এমন আপনজনদেরও চোখে চোখ রেখে তাকায়না। তার কাছে গিয়ে বা কোলে নিয়ে চেষ্টা করলেও দেখা যায়, খুব দ্রুতই সে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। eye-contact-এর অক্ষমতা অটিস্টিক শিশুর মধ্যে প্রকটভাবে দেখা যায়।
সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে মিশতে বা খেলতে চায় না। অন্য শিশুদের খেলতে দেখলে সে একপাশে সরে যায়। অন্যরা কী করছে, সেটা দেখতে বা তাদের খেলায় অংশ নিতে অনীহা বা বিরক্তি দেখায়। বেশীরভাগ অটিটিস্টিক শিশুকে ডায়াগনোসিসের আগেই পারিবারিক পরিমন্ডলে "অমিশুক" হিসেবে চিহ্নিত হতে দেখা যায়।
কোনো ধরণের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সাথে শেয়ার করে না। সাধারণতঃ শিশুরা কোনো খেলনা হাতে পেলে সবাইকে সেটা দেখাতে চায়। কথা বলে বা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিন্তু অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে এধরণের কোনো খেলনার প্রতি নিজস্ব কিছু আগ্রহ থাকলেও সেটা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস থাকে না।
স্বাভাবিক শিশুরা কারো কোলে চড়তে বা আদর পেতে পছন্দ করে। কিন্তু অনেক অটিস্টিক শিশু এই ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকে। অন্য কারো সংস্পর্শে যাওয়াটা তারা তেমন পছন্দ করেনা।

যোগাযোগ
পরিবেশ ও প্রতিবেশ এর সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা শিশুর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠার কথা। অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ তৈরি করার ক্ষমতা কমে যায়- দেখা যায় ২ থেকে ৩ বছর বয়সে স্বাভাবিক শিশুরা যেসমস্ত শব্দ উচ্চারণ করতে পারে সমবয়সী অটিস্টিক শিশুরা তা পারে না। তখন সমবয়সী অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করে বাবামা বিষয়টি বুঝতে পারেন।

আবার কোনো ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশু হয়ত স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে, কিন্তু একটি বাক্য শুরু করতে অস্বাভাবিক রকম দেরি হয় অথবা বাক্য শুরু করার পর তা আর শেষ করতে পারে না। এমনও হতে পারে ৩-৫ বছর বয়সেও দু'তিন শব্দের বেশী শব্দ দিয়ে বাক্য গঠন করতে পারেনা। নিজের প্রয়োজনের বিষয়টা উত্তম পুরুষে (ফার্স্ট পার্সোনে) না বলে নাম পুরুষে (থার্ড পার্সোনে) বলে। যেমন ‘আমি খাব’ না বলে ‘বাবু খাবে’ এভাবে বলে। বহুবার শোনা ছড়া থেকেও অল্প কিছু শব্দের বাইরে আর কিছু বলতে পারেনা। যেমন ‘তাই তাই তাই মামা বাড়ি যাই/মামী দিল দুধভাত পেট ভরে খাই/মামা এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই’ এ ছড়াটাকে সে হয়তো সংক্ষেপ করে এভাবে বলে ‘তাই তাই মামা যাই দুধ খাই লাঠি পালাই’। কিংবা ‘আয় চাঁদ টিপ যা’ ইত্যাদি।

শিশু একই শব্দ অথবা বাক্যাংশ বারবার উচ্চারণ করার প্রবণতা দেখাতে পারে। এসব শব্দ অর্থবোধক হতে পারে, নাও পারে। অটিস্টিক শিশুকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘তুমি কি দুধ খাবে?’ এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শিশু হয়তো প্রশ্নের শেষ অংশটিই আবার উচ্চারণ করে, ‘দুধ খাবে?’ শুধু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়েই নয়, কোন আলাপচারিতায়, অথবা হঠাৎ করেই, প্রাসঙ্গিক হোক বা না হোক, একই শব্দ অথবা বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে। কেন একই কথা বার বার বলছে, কিংবা সেসব শব্দের অর্থ কী, এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শিশু একঘেঁয়ে পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যায়। বাবা-মা মানা করলেও শোনে না, বরং বিরক্ত হয়, রেগে যায়, অথবা নিজেকে প্রকাশ করার অক্ষমতাজনিত হতাশা থেকে কাঁদতে শুরু করে।
৩ বছর বা তারও কম বয়সী শিশুরা তাদের বয়সোপযোগী নানা রকম খেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই তৈরি করে খেলে। সেভাবে কথা বলতে না পারলেও ইশারা-ঈঙ্গিত-হৈহল্লার মধ্য দিয়ে তারা লুকোচুরি বা গাড়ীর প্রতিযোগিতা বা প্লেন ওড়ানো বা লড়াই/যুদ্ধ-- এমন কল্পনাভিত্তিক খেলাধূলায় (imaginative play) মত্ত হয়। কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এরকম করে না। পুতুল, গাড়ী, স্টাফড অ্যানিম্যাল (টেডি বেয়ার, মিকিমাউস, খরগোশ এসব) ইত্যাদি নিয়ে কল্পনাশ্রয়ী কোন খেলা (যেমন পুতুলকে খাওয়ানো, পুতুল কাঁদছে, গাড়িটা জোরে চলতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলল এমন ভান করা) এরা খেলতে পারেনা।

আচরণ
অটিস্টিক শিশু বিশেষ ধরণের আচরণ বারবার করতে থাকে। হয়ত হাত দোলাতে থাকে বা আঙুল নাড়াতে থাকে। খেলনার বাক্স উপুড় করে খেলনা (ছোট বল বা মার্বেল) বের করে ফেলে; আবার ঢুকিয়ে রাখে। আবার বের করে, আবার ঢোকায়। এভাবে চলতে থাকে। কোন কোন শিশু ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়ে খেলতে চায়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় লবণদানি থেকে লবণ ঢেলে বাটিতে রাখছে, আবার সেটা আগের জায়গায় নিচ্ছে। বা দুটো গ্লাস নিয়ে একটা থেকে আরেকটায় পানি ঢালাঢালি করে চলেছে। এই পুনরাবৃত্ত কাজে তারা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়; কয়েক ঘন্টাও চলতে পারে। যা দেখে সাধারণতঃ পরিবারের সদস্যরা বাচ্চাটিকে (ভুলবশতঃ) শান্ত স্বভাবের ভেবে স্বস্তি বোধ করেন।

অনেক অটিস্টিক শিশু আওয়াজ পছন্দ করে না। জোরে কথা বললে বা টিভি চালালে অস্বস্তি বোধ করে, কান্নাকাটি বা চীৎকার করে।

তারা রুটিন মেনে চলতে ভালোবাসে। দৈনন্দিন যে ধরণের জীবনযাপনে সে অভ্যস্ত, তার কোন ব্যতিক্রম হলে অটিস্টিক শিশুরা মন খারাপ করে, কাঁদে বা চিৎকার দিতে থাকে। বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে সে অস্বস্তিতে থাকে। রাতে ঘুমাবার আগে হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় বদল করে বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস হয়তো প্রায় সব শিশুরই থাকে কিন্তু কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলে সাধারণ শিশুরা কিছু মনে না করলেও অটিস্টিকদের বেলায় দেখা যায় তারা কোনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।

পারিপার্শ্বিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন তারা সহ্য করতে পারে না। ধরা যাক, ঘরে আসবাবপত্রের অবস্থান অদল-বদল করা হলো। এতে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। গোসল করানোর জন্য তার জামা-কাপড় খুলতে হবে, বা গোসল শেষে আগে পরে থাকা জামাটার বদলে নতুন জামা পরতে হবে, এই সাধারণ পরিবর্তনের ব্যাপারগুলো তারা মানতে পারেনা। গ্রীষ্মের সময় জানালা খোলা রেখে ঘুমানো হলো, এতে অভ্যস্ত হবার পর শীতকালে জানালা বন্ধ করার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সে প্রতিক্রিয়া দেখায়। বা রাতে ঘুমানোর সময় শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করার শব্দেও সে কাঁদে বা চিৎকার করে। এই প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি অনেকক্ষণ ধরে চলে। এরকম প্রতিক্রিয়ার কারণে অটিস্টিক শিশুদের অনেককেই পরিবারে প্রাথমিকভাবে "জেদি" হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিশেষ কোন কোন খেলনা বা সাধারণ কোন বস্তুর প্রতি তার অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকে। সেটা সঙ্গে রাখতে চায় সবসময়। কিন্তু খেলনা হিসেবে সেটার যে বৈশিষ্ট্য, তা তাকে আকর্ষণ করেনা। যেমন কোন কোন শিশুর খেলনা গাড়ী চালানোতে আগ্রহ না থাকলেও কিন্তু সেটা উল্টে ধরে হাত দিয়ে চাকাগুলো ঘোরাতে দেখা যায়।

অধিকাংশ অটিস্টিক শিশু পেন্সিল বা কলম ধরে মুঠোবন্দী করে। দু'আঙ্গুল দিয়ে চিমটি দেয়ার মতো করে বা তিন আঙ্গুলে পেন্সিল ধরার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কিছু ধরতে পারেনা। হাত ধুয়ে মোছার আগে হাত থেকে পানি ঝেড়ে ফেলা বা কুলি করার কায়দাটা শিশুরা বড়দের দেখেই শিখে ফেলে। কিন্তু অটিস্টিক শিশু এই সাধারণ বিষয়গুলো আয়ত্বে আনতে পারেনা। শেখালেও দেখা যায় হাত ধুয়ে ঢেউয়ের মতো দোলাচ্ছে, পানি ঝরবে এমনভাবে ঝাড়তে পারছে না। হাত মুছতে গেলেও তোয়ালেটা এমনভাবে ধরছে যে ঠিকমতো মোছা হচ্ছেনা। Fine motor activity তে তাদের এমন বহু সমস্যা থাকে।

কেউ আঙুল দিয়ে কোন কিছু নির্দেশ করলে শিশু নির্দেশিত বস্তুর দিকে না তাকিয়ে বরং আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোটরস্নায়ুর সমন্বয় ক্ষমতার ঘাটতির জন্য এটা হয়।
অটিস্টিক শিশুর মোটরস্নায়ুতে সমস্যা থাকবেই। মোটরস্নায়ু কোন কাজ করার সময় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করে। এ স্নায়ুর জন্যই ভারসাম্য রেখে একপায়ে দাঁড়াতে পারা, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কোন কিছু ছুঁড়তে পারা, ডিগবাজি দিতে পারা ইত্যাদি গ্রস-মোটর ক্রিয়া সম্ভব হয়।

কোনো কোনো অটিস্টিক শিশু আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রেগে ওঠে বা ভয়ার্ত হয়ে যায়।

অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে পঁচিশ শতাংশের খিঁচুনি থাকতে পারে।

উপরের লক্ষণগুলোর মধ্যে যে কোন কোনটি সাময়িক সময়ের জন্য স্বাভাবিক শিশুদের মধ্যেও থাকতে পারে। তাই একটি লক্ষণ দেখেই বাবা মায়েদের তাদের শিশুটিকে অটিস্টিক ভেবে নেয়া ঠিক হবেনা। আর একজন অটিটিস্টক শিশুর মধ্যে যে উপরের সবগুলো লক্ষণ একসঙ্গে থাকবে তাও নয়। আবার বাবা মায়েদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে; এ ধরণের কয়েকটি লক্ষণ সন্তানের মধ্যে বেশি দিন ধরে দেখা যাচ্ছে কিনা। যদি তা হয় তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপণ্ণ হতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত