কর্কট রোগ: কিছু সাদামাটা জ্ঞান
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:১৫
প্রায়ই ফেসবুকে কিছু পোস্ট দেখি যেমন: ক্যান্সার কোন রোগ নয়!! এটা বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানি ও কিছু অসাধু চিকিৎসকের প্ল্যান যে তারা পৃথিবীতে ক্যান্সারের আতংক তৈরি করেছে! কেমো–রেডিওথেরাপি সব ভুয়া! আদতে রোজ সকালে গরম পানিতে লেবু চিপে খেলে, বিকেলে থানকুনি চিবিয়ে খেলে, বিশ্যুদবারে এলভেরা গিলে খেলে, চিত হয়ে ঘুমালে, এই করলে... সেই করলে … ক্যান্সারের ‘জীবাণু’ শতভাগ মরে যায়! ইত্যাদি, ইত্যাদি!!
যেহেতু বেশিরভাগ লোকের ধারনা ক্যান্সারের নাই আনসার, তাই জনস্বার্থে এমন প্রলুব্ধকারি পোস্ট খুব শেয়ার হয়। রোগ নিয়ে রোগীর কনফিউশন বাড়ে, চিকিৎসা নিয়ে অনাস্থা বাড়ে।
আচ্ছা, আমাকে বলেন দেখি, আল্লাহ্র দুনিয়ায় কোন রোগটা আসলেই একটা ‘রোগ’? যে কোন অসুখের কার্যকারন খুঁজে দেখেন, আপনি আর আপনার খাসলতই সেই রোগ তৈরি করে। উদাহরণ দেই। যেমন – ডায়রিয়া, টাইফয়েড, আমাশয় – এগুলোর মানেই হল আপনি পচা বাসি হাগু মুতু মেশানো খাবার খেয়েছেন! ছোঁয়াচে অসুখ হয়েছে মানে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছেন অপুষ্ট থেকে। হার্টের ব্লক–এটাক এসব হয়েছে মানে হার্টের যত্ন নেন নি, ব্যায়াম করতেন না, চর্বি খেতেন! স্ট্রোক মানেই ব্লাড প্রেশার বেড়ে আছে নানা কারনে, এসব নিয়ে ভাবেন নি!
আররে! সে সব বাদ দেন! একটা সরকারি হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে শ্বাসকষ্ট– লাংস এর সমস্যা– হাঁপানি হুপানি- সাস্পেক্টেড টিউমার ... এসব নিয়ে সিট ভর্তি হয়ে থাকে ৮০% রোগীতে! অথচ কেবল ও কেবল মাত্র ধূমপান ১০০% বর্জন করা হলে এই বেডগুলো সব ফাঁকা থাকতো!
তার মানে, বেশিরভাগ রোগ করুণাময় আল্লাহ্ সাত আসমানের উপর থেকে নাজিল করেন না। আমরাই আদর করে রোগ ডেকে আনি! একইভাবে জন্মগত বা পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত ক্যান্সারগুলো বাদে বাকি বিশাল অংশ আসলেই কোন ‘রোগ’ নয় বরং আপনার দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলার পুরস্কার! বরং বলতে পারেন, আপনি নিজের অযত্ন করেছেন, সেটা ক্যান্সারে পরিনত করেছেন, বহুজাতিক ঔষুধ কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবসা করার পথ দেখিয়েছেন, এবং ক্যান্সার বিষয়ে ডাক্তারি করে কিছু চিকিৎসকের ভাত পানির ব্যবস্থা করেছেন!
যাহোক, বাস্তবতা খুবই করুণ। যে ভাবে পৃথিবীতে বিভিন্ন রোগের সুচিকিৎসা উদ্ভাবিত হচ্ছে, মানুষের মধ্যে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, লোকে আর বেঘোরে মরছে না সিম্পল কোন অসুখে ... এটাই ভাবা যায়, এক সময় মৃত্যুর কারন হবে শুধু দুইটা , হয় অপঘাতে - নয় ক্যান্সারে! মজার ব্যাপার বলি, যদি আপনি একেবারে নিজের প্রতি খুব যত্ন নিয়ে, নীরোগ হয়েও একশ বছরের বেশি বাঁচেন, বাঁচতেই থাকেন, তবুও খাদ্যনালীর ক্যান্সার হয়েই আপনার মৃত্যু হবে – এটা নিশ্চিত! কারন, যতদিন বাঁচবেন ততদিন খাবেন। খাদ্যনালীতে ঘর্ষণ হবেই! ১৫০ বছর বাঁচলে সে নালীর অবস্থা কি হবে ভেবে দেখেন!
তাহলে কি করলে একটা আপাত ক্যান্সার-মুক্ত জীবন পাওয়া যায়?
এইবার উত্তরে আসবে সেই তুকতাক উপদেশমালা! ... লেবুর রস, শারীরিক ব্যায়াম, পরিশ্রমের কাজ, পরিচ্ছন্ন জীবন, বয়সের সাথে নিজের পরিবর্তনগুলোর দিকে যত্নবান হওয়া, পজেটিভ জীবন বোধ, ইত্যাদি ইত্যাদি। শরীরকে যত কম আঘাত করবেন, তত বেশি ক্যান্সার মুক্ত থাকবেন। ভেতর/বাইরে যে কোন অঙ্গে যত কম ঘর্ষণ হবে, তত বেশি সুস্থ থাকবে সব। যে কোন ক্ষত, সেটা রেগুলার আরও আরও আঘাতের মুখোমুখি হলেই তা রূপ নেয় ক্যান্সারে। যে কোন বাজে রাসায়নিক এর সংস্পর্শে আপনি বার বার আসলেই তা রূপ নেয় ক্যান্সারে। জন্মগত, জিনগত, বংশগত কিছু অবস্থা আছে সেসবে ক্যান্সার থেকে বেঁচে থাকা মুশকিল, কিন্তু সেসব অবশ্যম্ভাবি প্রকারের কর্কট রোগ এর ইন্সিডেন্স নিতান্তই মামুলি, যত না বেশি নিজে থেকে দাওয়াত দিয়ে আনা ক্যান্সারের প্রকোপ!
বাংলাদেশে কি অবস্থা ক্যান্সার চিকিৎসার?
জ্বি, মাশা আল্লাহ্, হেলথের অন্যসব সেক্টরের মত ক্যান্সার চিকিৎসাতেও বাংলাদেশ ভালো। বরং এখানে আপনার আরও টেনশন মুক্ত থাকার উপায় আছে, কারন ক্যান্সার এর চিকিৎসা ৯০% একটি নির্ধারিত প্রোটোকল ফলো করে করা হয়। কোন কেমো– কোন রেডিও- কত ডোজ- সবই বইয়ে আছে। সে ডাক্তার দেশী হোক, ইন্ডিয়ান হোক, আমেরিকান হোক– আপনার চিকিৎসা সেইম। হ্যাঁ, কোন কোম্পানির ড্রাগ ইউজ করা হচ্ছে, কত দামি, এর উপর তো ভালো খারাপ নির্ভর করেই। দেশে থেকে ভালো মেশিন বা ভালো ড্রাগটা ব্যবহার করতে পারলে ক্যান্সার নিয়ে আপনার বিদেশ বিভূঁইয়ে ছুটে যাবার কোন দরকার নাই। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে বহু জায়গায় ক্যান্সারের নিরাময় করা হচ্ছে। মালপানি ঢেলে সেখানে আরোগ্য লাভ করা যায়। আমাদের দীন দুঃখিনী বাংলা মা সরকারি পর্যায়েও ক্যান্সার ইন্সটিটিউট বানিয়েছে মহাখালীতে, বড় বড় মেডিকেল কলেজগুলোতে ক্যান্সার ডিপার্টমেন্ট আছে, বিএসএমএমইউ-তে আছে। দরকার শুধু আপনার সুপ্রসন্ন ভাগ্য, প্রচুর রোগীর ভিড়ে দ্রুত রোগ নির্ণয়, আর দ্রুত চিকিৎসা। ক্যান্সারের বেশিরভাগ প্রকারেরই চিকিৎসা আছে, হায়াত থাকলে বেঁচে যাবেন!
নাগরিক হিসেবে আপনি কিভাবে চান দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা আরও নির্ভর যোগ্য হোক?
২০১৩ সালের একটা ঘটনা বলি। আমি তখন প্রায় দুই বছর ক্যান্সারের উপর কাজ শিখে, এলাকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ বিসিএস ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা দিতে বসেছি। এক সকালে এক বয়স্ক রোগিণী এলেন। কমপ্লেইন হিসেবে তার বুকের ক্ষত আর বাকি সকল লক্ষন দেখে নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে উনি এডভান্স ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। তাকে জানালাম এবং বোঝালাম দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিক্যালে যেয়ে ভর্তি হতে অপারেশনের জন্য। কিন্তু তার উত্তর হল, তিনি নিশ্চিত যে, এটা ক্যান্সার না! এটা দুই বছর আগে তার স্বামীর পিটুনি খেয়ে যে আঘাত পেয়েছিলেন সেটার ক্ষত! উলটো আমাকে অর্ডার করার সুরেই সে বলল, তাকে কিছু ভিটামিন আর বুকের ক্ষত সারাবার মলম দিলেই চলবে! বোঝালাম, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সব অপারেশন ফ্রিতে করানো হয়। সে অবলীলায় আমার পরামর্শ অগ্রাহ্য করেই বলে, সেখানে যাবার টাকাও তার নেই! বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে তার দিন কাটে!
কি করবো, ইচ্ছে তো হচ্ছিল তাকে বেঁধে রেখে নিজ দায়িত্বে মেডিক্যালে পাঠিয়ে দেই! কিন্তু বাস্তবতায় কি সেটা সম্ভব? হাল ছেড়ে দিলাম! সে মরতে যাচ্ছে এভাবে! উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এ আমার কোন ঢাল তলোয়ার নেই! বরং কিছু মিছু ভিটামিন দিয়ে আমি ক্যানসারের রোগীর চিকিৎসা করছি!
আমরা আম জনতা সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখতে চাই, ডাক্তার আমাদের বাড়ির উঠানে বসে থাকবে! হাসপাতাল হবে আমার কলতলায়! কিন্তু এভাবে কি এপ্রোপ্রিয়েট স্বাস্থ্য সেবা দেয়া যায়? স্বাস্থ্য হল একটা চর্চার ব্যাপার, একটা চলমান প্রক্রিয়া। আপনি নিজে সাবধান থাকবেন, নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করবেন, প্রয়োজন হলে তবেই হাসপাতালের শরণাপন্ন হবেন। তা না করে হাসপাতাল যদি বগলে নিয়ে ঘুরেও বেড়ান, তিন স্তরের হাসপাতাল/সাব সেন্টার/ কমিউনিটি ক্লিনিক আর শত শত ডাক্তার দিয়ে ঢেকেও ফেলা হয় আপনার এলাকা, আদৌ কি কোন লাভ হবে? তাই নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করুন, উপজেলায় ইউনিয়নে গ্রামে গ্রামে এত এত হেলথ ক্লিনিক দরকার নাই। এর চেয়ে জেলায় জেলায় কমপক্ষে দুই একটা বড় হাসপাতাল থাকুক যেখানে সব কঠিন রোগের আগাগোড়া চিকিৎসা মিলবে। সেখানে অবকাঠামো ভালো থাকবে বলে ডাক্তাররা থাকতেও চাইবেন। রোগীও যথার্থ চিকিৎসা পাবেন।
৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। দেশে বেড়ে চলছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা, বাড়েনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, বাড়েনি সে অনুপাতে বিশেষায়িত হাসপাতাল। ষোল কোটির এই বিশাল জনসমষ্টিতে ক্যান্সারের ভোগান্তি অনিবার্য, কিন্তু আমাদের গন্তব্য অনিশ্চিত!
লেখক: চিকিৎসক ও কূটনীতিক