প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে বেশি সংখ্যক রেকর্ড গড়েন কাদম্বিনী
প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৭, ১৪:৫৯
কাদম্বিনী বসুর (গঙ্গোপাধ্যায়) (১৮৬১-১৯২৩) জন্ম রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছরেই। অর্থাৎ ১৮৬১ সালে। তিনি আমাদের জানা মতে এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন – বিশেষ করে নারীর উচ্চ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে। সংক্ষেপে এই রেকর্ডগুলো হলো-
ক) তিনি প্রথম নারী যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন।
খ) ১৮৮০ সালে তিনি ও চন্দ্রমুখী বসু প্রথম দুই নারী যাঁরা এফ. এ. পরীক্ষায় পাশ করেন।
গ) তিনি ও চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮২ সালে ভারতীয় নারীদের মধ্যে (বৃটিশ অধিকৃত সকল দেশের মধ্যেও) প্রথম বি.এ পাশ করেন।
ঘ) ১৮৮৭ সালে প্রথম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্র্যাক্টিস করার বিশেষ সার্টিফিকেট পান।
ঙ) ভারত উপমহাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনি-ই প্রথম (১৮৯৬ সালে) নারী যিনি বিদেশ থেকে মেডিকেল ডিগ্রী (এডিনবরা থেকে LRCP, LRCS , LFPS ডিগ্রী) অর্জন করেন।
চ) কাদম্বিনী জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সদস্যদের অন্যতমা।
ছ) কংগ্রেস অধিবেশনে (১৮৮৯ সালে বোম্বাইতে) যোগ দেওয়া প্রথম দুই নারী প্রতিনিধির মধ্যে অন্যতম।
জ) তিনি ছিলেন কংগ্রেসের কোন অধিবেশনে প্রথম নারী বক্তা।
১৮৯০ সালে কলকাতার অধিবেশনে তাঁর ইংরেজি ভাষণ ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। রাজনীতি ও নারী আন্দোলণের নেত্রী অ্যানি বেসান্তের মতে, “The first woman who spoke from the Congress platform, is a symbol that India’s freedom would uplift India’s womanhood.”
বাংলার প্রথম চারজন নারী ডাক্তারের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রাক্টিস করেছেন প্রথম ডাক্তার কাদম্বিনী। স্বামী প্রাক্তন শিক্ষক, বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও নারী-প্রগতির অগ্রদূত দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কাদম্বিনী পাঁচ শিশু সন্তানের মা হওয়া সত্বেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দিতেন, বিশেষ করে নারীদের যারা অসুস্থ হলেও হাসপাতালে আসার সুযোগ পেতেন না সবসময়।
উচশিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন, পেশা জীবনেও কাদম্বিনীকে অনেক বাধার সন্মুখীন হতে হয়। তখনকার ‘বঙ্গবাসী’ নামে সাময়িক পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল একটি কার্টুন ছেপে ডাঃ কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ কাদম্বিনী নাকি মোটেই ঘরোয়া নন। ঘর- সংসারের দিকে, ছেলেমেয়ের দিকে তাঁর নাকি মন নেই, নিষ্ঠাও নেই। এতগুলি সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নাকি মাতৃধর্ম পালন করছেন না। এর ওপর আবার সমাজসেবা, স্বদেশী করে বেড়াচ্ছেন, সভাসমিতি করছেন বাইরে। সুতরাং বঙ্গবাসী পত্রিকায় একটা কার্টুন এঁকে দেখানো হলো, বারবণিতা ডাঃ কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাকে দড়ি দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী নন কাদম্বিনী কিংবা তাঁর স্বামী। মামলা হলো। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের ১০০টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হলো। সেই সময় এই ধরনের মামলা করা, বিশেষ করে এক শক্তিশালী পুরুষ কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোন নারীর মানহানির মামলা করাটা মোটেই সহজ ছিল না।
স্বামীর সঙ্গে কাদম্বিনীর সতেরো বছর বয়সের ব্যবধান ছিলঁ। স্বামী মারা যাবার পরেও অনেকদিন বেঁচেছিলেন তিনি। কাদম্বিনীর জীবনের সাধ ছিল নিজের টাকায় যেন নিজে চলতে পারেন। শারীরিক বা অর্থনৈতিকভাবে কারো ওপর যেন ভরসা করতে না হয়। ঘটেছেও তাই। জীবনের শেষ দিনটাতেও তিনি রোগীর বাড়ি গেছেন। একটি জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন। ঘরে এসে পরিতৃপ্ত কাদম্বিনী পুত্রবধুকে বলেছেন, একটা সার্থক ও সুন্দর দিন ছিল সেটা। এত ভাল লাগছিল তার তিনি শূণ্যে উড়ে বেড়াতে চাইছিলেন। আর কী আশ্চর্য, এর পরেই স্নান করতে গিয়ে কঠিন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বাবলম্বী, স্বাধীনচেতা কাদম্বিনী সবসময় বলতেন কারো, এমন কি নিজ পুত্রেরও গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না। কর্মাবস্থায় তাই মরতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হাত ব্যাগে কড়কড়ে পঞ্চাশটি টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সেদিনকার রোজগার।