কালীগঞ্জে বুড়ি ভৈরব নদী প্রভাবশালীদের দখলে
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:২৮
নদীর মধ্যে ৫৩ জন প্রভাবশালীর কাটা অবৈধ পুকুর আর নির্মান করা বাড়িসহ নানা স্থাপনার কারণে মৃত্যু ঘটেছে বুড়ি ভৈরব নদীটির। এই নদীর ঝিনাইদহ অংশ দেখলে এখন আর বোঝার উপায় নেই এখানে একটা নদী ছিল। যে নদীতে একসময় জাহাজ চলতো। এখনও এই নদীতে রয়েছে জাহাজঘাটার স্মৃতি। অথচ মাত্র কয়েকজন দখলদারের কারণে সেই নদীটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। নদীর মধ্যে গড়ে উঠা ঘরবাড়ি আর পুকুরের মতো সামান্য একটু জলাশয় রয়েছে। যেটাও এমন ভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এটা একটা নদী। সেই সঙ্গে ওই জলাশয়েও চাষাবাদ শুরু করেছেন ওই প্রভাবশালী দখলদাররা।
স্থানীয় কাষ্টভাঙ্গা ভূমি অফিস জানায়, ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এই বুড়ি ভৈরব নদীটি। যে নদীতে একসময় জাহাজ চলতো। সেই নদীটি ৫৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি অবৈধভাবে শতাধিক পুকুর কেটে মেরে ফেলেছে। এই দখলদারের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা রয়েছে। তারা ইতোমধ্যে নদীর কালীগঞ্জ অংশের ৩ শতাধিক একর জমি দখল করে নিয়েছে। ১৭০ ফুট প্রস্থের নদীটি বর্তমানে ৪০ ফুটে নেমে এসেছে। এতকিছুর পরও দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা কিছুই করতে পারছেন না বলে জানান ওই অফিসের এক কর্মকর্তা। তবে তারা দখলদারদের একটি তালিকা তৈরী করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট প্রেরণ করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে নদীর পাড়ের একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীটি বর্তমানে প্রভাবশালীরা সম্পূর্ণ গিলে ফেলেছে।
সাতগাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিদ্দিকুর রহমান জানান, ৩০/৪০ বছর পূর্বেও এই নদীতে প্রচুর পানি থাকতো। তারা এলাকার লোকজন বর্ষার সময় নদীতে মাছ ধরতেন। তারও পূর্বে নদীতে জাহাজ চলতো। এই নদীতে চলাচলকারী জাহাজ বারোবাজার এলাকায় ঘাটে এসে থামতো। এখনও সেই জায়গাটিকে সকলেই জাহাজঘাটা নামেই চেনেন।
তিনি আরো জানান, ২৫/২৬ বছর পূর্বে যখন নদীর দু’পাড়ে কিছু চর সৃষ্টি হয় সে সময় এলাকার এক শ্রেণীর মানুষ বন্দোবস্ত নেবার চক্রান্ত করে। অনেকে ভূমিহীন ধরে এনে তাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়ে পরে নিজেরাই জমি দখল করেন।
তিনি আরো জানান, মূলত এই বন্দোবস্ত দেবার পর থেকে শুরু হয়েছে নদীর পানির গতিরোধ, চাষের নামে নদীর জায়গা ভরাট, নদীর মধ্যে বাড়িঘর নির্মান, এমনকি নদীর জায়গা কেনাবেচা। যা এখনও চলছে।
নদীর পাড়ের আরেক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে জানান, ভূমিহীনদের জীবিকার জন্য ১৯৮৮/৮৯ সালে নদী পাড়ের জেগে ওঠা জায়গা বন্দোবস্ত দেন সেই সময়ের সরকার। আর এই বন্দোবস্তের সুযোগে প্রভাবশালীরা গোটা নদীর জায়গা দখল শুরু করে।
বুড়ি ভৈরব নদীটি ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার যে ইউনিয়নে অবস্থিত সেই কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান জানান, মর্জাদ বাওড়ের সুইচ গেট থেকে শুরু হয়ে গৌরিনাথপুর, নিত্যানন্দী, ঘোপপাড়া, সাতগাছিয়া, মাসিলা, ফুলবাড়ি, ঝনঝনিয়া হয়ে নদীটি যশোরের নওয়াপাড়া ভৈরব নদীতে মিলেছে। এখানে কালীগঞ্জ উপজেলার মধ্যে তিনটি মৌজায় প্রায় ৩’শ একর জমি রয়েছে। যার জমির মধ্যে ৬৬ একর জমি ১৯৮৯-১৯৯০ সালে ৬০ জন ভূমিহীনের মাঝে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বন্দোবস্ত দেবার সময় ১৩ টি শর্ত দেয়া হয়। যার মধ্যে উলেখযোগ্য শর্ত রয়েছে জমির শ্রেনী পরিবর্তন করা যাবে না, পুকুর করা যাবে না, বর্গা দেয়া যাবে না এবং বিক্রি করতে পারবে না। এ ছাড়া প্রতি বছরের খাজনা পরিশোধ করতে হবে।
তিনি আরো জানান, ভূমিহীনরা অধিকাংশ সরকারের ওই সকল শর্ত ভঙ্গ করেছেন। মাত্র ৫/৬ জন ছাড়া অধিকাংশ ভূমিহীন তাদের জমি প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক প্রভাবশালী কৌশলে ভূমিহীনদের নিকট থেকে বন্দোবস্ত নেওয়া জমি দখল করে নিয়েছেন। যার দুটোই প্রধান দুই শর্ত ভঙ্গ করে। এদিকে ভূমিহীনদের নিকট থেকে কিনে নেয়া বা দখল করে নেয়া জমিগুলোতে প্রভাবশালীরা বেশিরভাগই পুকুর কেটেছেন।
বর্তমানে তিনটি মৌজায় শতাধিক পুকুর কাটা হয়েছে। এখনও পুকুর কাটার কাজ চলছে। এক থেকে ছয় একর আয়তনের পুকুরও কাটা হয়েছে এই নদীতে। বর্তমানে নদীটি তার চেহারা হারিয়ে ফেলেছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পুকুর আর পুকুর। নদীর মধ্যে বাড়িও নির্মান করেছেন কেউ কেউ।
দখলকারীদের একজন বলেন, তাদের পরিবারের দখলে রয়েছে ৪ একর জমি। যার মধ্যে তারা ৬ টি পুকুর কেটেছেন।
অপরজন জানান, তারা ভুমিহীনদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে সেখানে পুকুর কেটেছেন। জমির শ্রেণী পরিবর্তন বা রেকর্ড দেওয়া সবই করছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তারা এগুলো না করলে জমি কেনাবেচা হতো না।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) যাদব সরকার জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে নদীর জমি শ্রেণী পরিবর্তন বা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।