প্লাস্টিক বর্জ্য: সম্পদ ও সম্ভাবনা
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:৫২
প্লাস্টিক আজকের দুনিয়ার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আধুনিক জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠ হয়ে আজ তা জড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে। দিনের পর দিন ক্রমহারে বেড়ে চলছে বৈচিত্রে ভরপুর প্লাস্টিকের ব্যবহার। বহুল ব্যবহৃত এই প্লাস্টিকের উদ্ভব ঘটে ব্রিটেনে। ১৮৪৫ সালে। আলেকজান্ডার পার্কস নামের এক বিজ্ঞানী নাইট্রো-সেলুলোজ, প্লাস্টিসাইজার ও অন্য দ্রাবক পদার্থের মিশ্রণে প্রথম তৈরি করেছিলেন এই প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক উদ্ভাবনের পর থেকে অনেক প্রয়োজনীয় দামী ও দুর্লভ দ্রব্য সাধারণের কাছে বেশ সস্তা ও সুলভ হয়ে উঠছে। যেমন: এমন একটা সময় ছিল- যখন মানুষ হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনি ব্যবহার করত। হাতির দাঁত বেশ দুর্লভ। স্বাভাবিকভাবেই তাই চিরুনিও সাধারণদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। অথচ প্লাস্টিক উদ্ভাবনের পর এখন তা সবার নাগালের মাঝে চলে এসেছে।
প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ সর্বত্র। রেডিমেট গার্মেন্টস -এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ (যেমন: প্যাকেজিং উপাদান, হ্যাঙ্গার, ব্যাগ ইত্যাদি); গৃহস্থালির কাজ ( যেমন: টেবিল ক্লথ; বালতি, জগ, কন্টেইনার, গ্লাস-প্লেট ইত্যাদি); আসবাব পত্র (যেমন: চেয়ার, টোল-টেবিল, শো-পিস, কিচেন তাক ইত্যাদি); সকল প্রকার ফুড-নন ফুড প্যাকেজিং; স্বাস্থ্যসেবা (যেমন: টুথ ব্রাশ, সোপ কেস, ব্লাড ব্যাগ, স্যালাইন সেট, ওষুধের মোড়ক ইত্যাদি); বিল্ডিং সামগ্রী নির্মাণ (যেমন: প্লাস্টিক পাইপ, দরজা, টয়লেট ফ্ল্যাশ ইত্যাদি); কৃষিকাজ সামগ্রী (যেমন: সেচের পাইপ, প্লাস্টিক ফিল্ম ইত্যাদি); ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী (যেমন: ইলেকট্রিক ক্যাবল-তার, ইলেকট্রিক সুইচ-বোর্ড,বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ ইত্যাদি) এবং শিল্প সামগ্রী'র বিভিন্নমুখী কাজ প্লাস্টিক ছাড়া আজ কল্পনাও করা যায় না।
প্লাস্টিকের ভালো দিকগুলো হল: কাঁচামাল দামে সস্তা, তুলনামুলক কম ব্যয়ে প্রস্তুত করা যায়; ওজনে হালকা হওয়ায় ব্যবহার করতে বেশ নিরাপদ ও সুবিধা হয়; তড়িৎ, ক্যামিকাল ও পানি বিরোধী হওয়ায় এতে খাবার বা উপাদান সামগ্রী সহজে অনেকদিন নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকে।
প্লাস্টিকের খারাপ দিকগুলো হল: প্লাস্টিক কয়েক শত বছর পচেও বিনষ্ট হয় না; প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম ইউজ বেশি; প্লাস্টিক অনবায়নযোগ্য, প্লাস্টিক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি'র অন্যতম প্রধান কারণ,এটি মাটির উর্বরতা বিনষ্ট করে এবং জলজ ও সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন পূর্বক পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটায়।
তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিকের কাঁচামালের (পলিমার) জন্য সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর এবং এটি অবশ্যই একটি ভালো দিক। নতুন করে পলিমার উৎপাদন বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ ভাবনা করতে হয় না। এদেশে তিন হাজারের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মধ্যে শতকরা প্রায় আটানব্বই ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। দেশের মোট জিডিপির এক শতাংশের অবদান এই প্লাস্টিক শিল্পের। যার অভ্যন্তরীণ বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এই খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাঁচ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান।
এদেশে প্লাস্টিকের মাথাপিছু ব্যবহার মাত্র পাঁচ কেজি'র মত যেখানে বিশ্বে গড় প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ কেজির মত। পরিসংখ্যান মতে যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আট কেজি; চীনে একত্রিশ কেজি, ব্রাজিলে বাইশ কেজি আর আমেরিকায় একাত্তর কেজি পর্যন্ত। একই পরিসংখ্যান থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য'র পরিমাণ নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐ সব দেশের মত আমাদের দেশের প্লাস্টিক বর্জ্য'র সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠায় পরিবেশগত মারাত্মক প্রভাব নিয়ে তা জনজীবনে বিরাজ করছে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এদেশে প্লাস্টিক শিল্পের অপার বিস্তার লাভ হচ্ছে কিন্তু সেটা প্লাস্টিক বর্জ্যের কোন হেস্তনেস্ত না করেই বলা যায়। প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশিরভাগ সুপরিকল্পিত ও সায়েন্টিফিক উপায়ে রিসাইকেলিং করা সম্ভব। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহারে তা করাও হচ্ছে।
দেশের প্রচলিত ধারায় প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইকেলিং পয়েন্ট বা রিসাইকেলিং -এর জন্য রপ্তানি পয়েন্ট পর্যন্ত নিয়ে যাবার মূল দায়িত্বটি টোকাই সমাজ সহ সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষগুলো করে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন ডাস্টবিন, নালা, নর্দমা ঘেঁটে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে। কারণ, এই প্লাস্টিক বর্জ্য'র বাজার দর কেজি ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত। টোকাই সমাজের এই সংখ্যাটাও প্রায় চার লক্ষাধিক। প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি বিশাল অংশ (যেমন: PET প্লাস্টিক) উন্নত রি-সাইকেলিং- এর জন্য চীন, থাইল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি দেশে রপ্তানি হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ময়লা- আবর্জনা'র সরাসরি কন্টাক্ট তাদের চরম স্বাস্থ্যহানি করে। সমাজের এই বিশাল অংশের স্বাস্থ্যহানিতা বা তার পরোক্ষ প্রভাব সমাজের সচেতন মানুষের কাছেও চরম উপেক্ষিত।
প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনা করে ২০০২ সালে এর উৎপাদন বন্ধ সংক্রান্ত আইন পাশের আজ এক যুগ পেরিয়ে গেছে। আইন আছে। প্রয়োগ নেই। দেদারছে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্যের এই বিশালতা ভূপৃষ্ঠে ক্রমাগত ল্যান্ডফিল তার দখলে নিয়ে নিচ্ছে। সামুদ্রিক অনেক প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হুমকির সম্মুখীন সংখ্যাটাও প্রকট।
লেখক: ফিল্ড ভেটেরিনারিয়ান, সুনামি এনিম্যাল পিপল এলায়েন্স, শ্রীলংকা