উন্নয়নের আলোতে চকচকে সুন্দরবন!

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০১:০৫

বলছি না আজ থেকে ২৫ বছর পরের কথা, বলছি না ১৫ বছরেরও পরের কথা। বলছি ১০ বছর পরের রামপালের কথা। এই কথা বলার আগে একটি গল্প বলি, এ গল্পে শিয়ালের মল কিভাবে মজিদের মাজার হয়ে উঠে তাই লিংক করছি। একবার মেঠো গা এর পথে শিয়াল মলত্যাগ করে গিয়েছিল। তো এরপর এক পান বিক্রেতা সেই পথ ধরে যাওয়ার সময় সেই মল দেখে তা ঢেকে দেয়ার জন্য দুখানা পান সেই মলের ওপর দিয়ে গিয়েছিল, এরপর ওই পথে যাচ্ছিল এক সুপারি বিক্রেতা সে দেখল রাস্তার ওপর পান! সে ভাবলো, কোন উদ্দেশ্যে হয়ত এখানে পান রাখা হয়েছে তাই সে দুখানা সুপারি দিয়ে গেল। এরপর চুন বিক্রেতা যাওয়ার পথে চুন দিয়ে গেল.. এভাবেই যেই সে পথে যাচ্ছিল কিছু না কিছু রেখে যাচ্ছিল। ওই পথে যাচ্ছিল মজিদ, সে দেখলো সবই আছে যেহেতু সেহেতু সে তার ধান্ধা বুঝে গেল, সে তার চাদর বিছিয়ে দিয়ে গেল..এরপর বোকা মানুষ ভাবলো বাহ দারুণ কারবার তো..দিতে লাগলো এক টাকা, দু টাকা। মজিদ বসে কারবার বুঝে গেল! ব্যস এতেই হয়ে গেল পাগলা মজিদের মাজার!!! 

যাই হোক এতক্ষণে হয়তো ব্যাপারখানা বুঝে গেছেন, এবার ফিরে আসি গল্পে। চলুন দেখি গল্পে গল্পে রামপাল কি হয়। ১০ বছর পর রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র বাস্তবায়ন হবে, কি হবে এতে? রামপাল হবে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চকচকে জাহাজ বাতি জ্বালিয়ে আসবে। সেই জাহাজ ভিড়বে, কয়লা নামানো হবে। তো তা কি দিয়ে? হুম সেই কয়লা নামাতে দরকার হবে শ্রমিকের নিশ্চয়! সেই শ্রমিকদের থাকা-খাওয়া এসবের জন্য সুন্দরবন ঘিরে চকচকে আলো জ্বলবে। হবে বাড়ি-ঘর! গড়ে উঠবে বসতি, গড়ে উঠবে লোকালয়। তাদের চাহিদা পূরণে আরও কত কি থাকবে সেই সুন্দরবন ঘেরা রামপালে। বাঘেরা, হরিণেরা দেখিবে বাহ আলোতে চকচক করছে সুন্দরবন। জোনাকি পোকারা বুঝে যাবে তাদের দিন শ্যাষ। এখানে মাজার বলা না গেলেও এখানে হবে আসলে হাব অর্থ্যৎ প্রকৃতি ও জীবন ধ্বংসে পরিকল্পিত ব্যবস্থা।

তা যেভাবে বাস্তবায়ন হবে- রামপাল থেকে বছরে ৬৫ কেজি পারদ সুন্দরবনে ফেলা হবে, দিনে সাড়ে চার কোটি লিটার গরম ও দূষিত পানি সুন্দরবনের পশুর নদীতে ফেলা হবে, কিন্তু কোন ক্ষতি হবে না। কারণ মাছেরা তা খেয়ে তারাও বেড়াতে যাবে ভারতে। তারাও বুঝবে হয়ত উন্নয়নের জোয়ার লেগেছে, আলোকিত বন। রামপালের আশপাশে ১৫০টি শিল্প প্রকল্পের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে, কিন্তু এতে প্রকৃতিক পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে না। তবে কি হবে এতে? 

চলুন জেনে নিই, রামপাল প্রসঙ্গে একজন নাবিক বন্ধু লিখেছেন, “আমি যে জাহাজটিতে আছি সেটির দৈর্ঘ্য ১৯০ মিটার, ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪৭ হাজার মেট্রিক টন। প্রতি মাসেই থাইল্যান্ড থেকে ধারণ ক্ষমতার সমপরিমাণ সিমেন্ট ক্লিঙ্কার নিয়ে বাংলাদেশে আসি। কর্ণফুলী নদী দিয়ে চট্রগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার বা তার চেয়ে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না বলে আমাদেরকে সমুদ্রের ভিতরে নোঙ্গরে থেকে পুরো কার্গো ডিসচার্জ করতে হয়। লাইটার জাহাজ (ছোট জাহাজ) এসে কার্গো ডিসচার্জ করে নিয়ে যায়। ৪৭ হাজার টনের জাহাজটিকে খালি করতে প্রায় ৪০টি লাইটার জাহাজের দরকার হয় যে লাইটার জাহাজগুলো কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা, পশুর ইত্যাদি নদীতে চলাচল করে। রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে এই লাইটার গুলোই বড় জাহাজ থেকে কয়লা নামিয়ে সুন্দরবনের ভিতর দিয়েই রামপালে যাবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি বছর কয়লা লাগবে ৪৭ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমি যে জাহাজটিতে আছি এরকম ১০০টি জাহাজ প্রতিবছর কয়লা নিয়ে পশুর নদীর আকরাম পয়েন্ট/ হিরণ পয়েন্ট এ গিয়ে নোঙ্গর করবে। সেখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪০০০(৪০X১০০) লাইটার জাহাজ কয়লা নামিয়ে রামপালে নিয়ে ডিসচার্জ দিবে। বুঝা যাচ্ছে যে, ৪৭ লক্ষ টন কয়লা প্রতি বছর ২ বার করে ডিসচার্জ হবে। একবার আকরাম পয়েন্টে, আরেকবার রামপালে।”

সবশেষে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র হলে যে ‘মজার কাণ্ড’ হবে- পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিন সেই উষ্ণজলে জলকেলি করবে। নানা প্রজাতির দুর্লভ জলজ উদ্ভিদ কুসুম গরম জলে নাইবে। পারদ দিয়ে প্রাণীরা টার্মিনেটর টু সিনেমার ভিলেন সাজবে। প্রকৃতি জুড়ে নির্মল ঘ্রান। সব আগের মতোই থাকবে, শুধু বিদ্যুত হবে। সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্প হলে সুন্দরবন বরং প্রটেকটেড হবে। যারা সুন্দরবনে বিচরণ করেন, মধু সংগ্রহ করেন, ডাকাতি করেন, কর্মসংস্থান হবে সেই ৪০ লাখ মানুষের। এই মানুষগুলোর জন্য বাড়িঘর করা হবে। আর এতে অর্থনৈতিক জোন হবে রামপাল। এতে নতুন নতুন শিল্প কারখানা তৈরি হবে। হবে রেল লাইন, এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। করা হবে বিমান বন্দর। মংলা ইপিজেড এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা হবে। তাইলে শুধুমাত্র বিদ্যুতকেন্দ্রই হচ্ছে না এর সাথে গড়ে উঠবে রামপাল শিল্প এলাকা। এতে চলাচল করবে বাড়তি নৌযান, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও তেলসহ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো দূষণ আরও কত কি!!! তাইলে বলেন কেমনে বাঁচবে বাংলার বাঘ, হরিণ, কুমির, সুন্দরী তথা সুন্দরবন? 

#আমি_আমিনুল_ইসলাম_মিঠু_সুন্দরবন_ধ্বংস_করে_রামপাল_বিদ্যুতকেন্দ্র_চাই_না

লেখক: প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশ সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত