সুন্দরবনে সুন্দরী নির্যাতনের ইতিকথা
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০১:৩৭
সুন্দরবনের জলরাশির সঙ্গে দুপাশের বনরাজিকে পিছনে ফেলে ভেসে চলেছি। যান্ত্রিক যন্ত্রণার বাইরে প্রকৃতির কোনও কিছু আমার কাছে একঘেয়ে লাগে না। বরং নদীর পানি, গাছের সবুজ কিংবা বনে জীবজন্তুর হাঁকডাক আমাকে বেশি টানে।
২০১৪ সালে সুন্দরবনে দুবলার চর রাসমেলায় গিয়েছিলাম পরিবেশ বান্ধব কিছু চিত্রগ্রাহক বন্ধুদের সঙ্গে। মংলা থেকে দুবলার চর যাবার নৌ পথটি আমার কাছে খুব পরিচিত। বনবিভাগের কাগজপত্র বলে, মংলা থেকে দুবলার সাগর সৈকতের দূরত্ব ১৪৫ কিমি।
যাহোক বলতে চাই সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের কথা। সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গ কি.মি. আয়তনের তুলনায় সুন্দরী গাছ একবারে নাই বললেই চলে। কেন সুন্দরী গাছের এ বেহাল দশা এমন কারণ অনুসন্ধানের সঙ্গে সুন্দরী নির্যাতনের কিছু তথ্য জানাতে চাই।
সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে সুন্দরী গাছ। বাঘ ও সুন্দরী তো এক সুতায় গাঁথা। বাঘ না থাকলে যেমন সুন্দরী থাকবে না, তেমনি বাঘ জানে সুন্দরী না থাকলে নিজেরও থাকা হবে না। ভাবনার যোগ বিয়োগে তাই মাথা ঘামাতে হয় না।
সুন্দরী গাছের রূপের সঙ্গে গুণও রয়েছে। এমন গুণের কথা জানতে পেরে বৃটিশ থেকে পাকিস্তান এরপর বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ, গোত্র কিংবা চক্র সুন্দরীকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করেছে। উপকূলের খুব কম মানুষ আছে যারা সুন্দরীকে দিয়ে শুধু খাট পালংক নয় বানিয়েছে নৌকা-বৈঠা। এমনকি ঘরের কোণের আসবাবপত্রের জন্যও সুন্দরীকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে এসেছে সুন্দরবন থেকে। দেড় যুগ আগেও সুন্দরবন থেকে হাজার হাজার সিএফটি সুন্দরী কাঠ চলে গেছে মধ্যপ্রাচ্যে রাজা বাদশাদের ঘর সাজানোর বিলাসিতায়, এমন তথ্যও অজানা নয়।
বিকেল চারটা, মংলা থেকে সকালের ভাটাতে রওনা দিয়ে একটু তাড়াতাড়ি চলে গেলাম দুবলার চরে। ঘণ্টা দুয়েক হাতে সময় আছে। তাই প্রতিটি মিনিটকে ভাগ করে নিজের মতো বিকেলের ঝিমিয়ে পড়া আলোতে সৈকতের শুটকি পল্লীতে ঘুরতে থাকলাম। সন্ধায় সূর্যাস্তের দৃশ্য সামনে রেখে হাঁটাহাটি করছি। খুব সুন্দর দৃশ্যের কথা খাতা কলমে উঠানো কষ্টসাধ্য। সৈকতে দাঁড়িয়ে দেখছি ডুবন্ত কমলা রঙের বড় একটি সূর্যের ভিতর দিয়ে সদ্য সাগর ফেরত জেলেদের হাঁটাচলা। কালো ছায়ার মানুষগুলো সাগর থেকে উঠে ডুবন্ত সূর্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দিয়ে চলে যায় শুটকি পল্লীর পথে। প্রতিবছর মংলা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, টেকনাফ এমনকি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ হাজারো মানুষ দুবলার চরে আসে। একদল জেলেরা সাগরে যায় অপর দল রোদে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে। এভাবে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ বছরে পাঁচ মাস দুবলার চরে অবস্থান করে।
সৈকতে নৌকা নোঙ্গর করা, ট্রলার থেকে মাছ নামানো, জাল গুছানো সবই ভারি কাজ। উপকূলের জেলেদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের শুরু ও শেষ ভাগের ভারী কাজ ঘাড়ের উপর দিয়ে সারতে হয়। বহুদূর থেকে ঘাড়ে করে জাল নিয়ে যেমন ট্রলারে উঠতে হয় তেমনি মণকে মণ মাছ ঝুড়িতে করে বাঁশ বেঁধে নামাতে হয়।
গ্রামগঞ্জে সন্ধ্যায় গরু গোয়ালঘরে ঢুকানোর আগে গৃহকর্তার রাতে রান্নার জ্বালানী কুড়িয়ে আনার দৃশ্যপট অনেকের জানা। তেমনি সাগর ফেরত জেলেরাও জ্বালানী হিসেবে নিয়ে এসেছে সাগরে ভাসা গাছ। শতাধিক মানুষ কেউ একা আবার কখনও দুজনের ভাগাভাগিতে ঘাড়ে করে ভারী গাছগুলো ট্রলার থেকে নামিয়ে আনছে। স্বাভাবিক এই দৃশ্যগুলো অস্বাভাবিক মনে হতো না, যদি না কেউ চিৎকার করে বলে উঠতো ‘এ গাছ হারালে আর পাবি নানে’। মনে খটকা লাগে কী এমন গাছ বা কি এমন কাজ গাছগুলোর? অন্ধকার হলেও বুঝতে পারছি ট্রলারগুলোতে প্রায় একই ধরনের গাছ, প্রায় একই ধরণের মাপজোখ। তবে গাছটিকে চিনতে পারছি না। ছাল বাকলহীন কোনটা কালচে, কোনটা লালচে। একটু এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করি কাঠের নাম কী? উত্তর পেলাম না। আবারো প্রশ্ন কিন্তু উত্তরহীনতায় সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে।
কয়েকজনের কাছে সেই একই প্রশ্ন করার পর এবার একজন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ওগুলো সব সুন্দরী গাছ। সাগরে মাছ ধরতি গ্যালে জালের মধ্যি এ্যাংকর দিতি হয়।
প্রশ্ন আরও বেড়ে যায় কিন্তু উত্তরদাতা কথা না বাড়িয়ে নিজের পথে চলতে শুরু করলো। কিন্তু আমার মন আনচান করে। অন্ধকার তখন সারা সৈকতে। দুবলার চরে রাজা ও বুলবুল সাহেব নামে দুজন ব্যক্তি রয়েছেন। খানিক দুরে মেজর জিয়াউদ্দিনের ছোট ভাই কামাল সাহেবেরও আড়ত। তারা সবাই দুবলার চরের বড় সাহেব। সুন্দরবনের শুটকি পল্লী ঘিরে এমন সাহেবের সংখ্যা জনা পাঁচেক। রাতের খাবার শেষে রাজা ও বুলবুল সাহেবের সঙ্গে দুবলার চরে শুটকি নিয়ে আলোচনা করছি।
দুবলার চর ও আশেপাশে সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে কমপক্ষে আট হাজার। পাঁচমাসের জন্য এসব ট্রলার নিয়ে কেউ পনেরো দিন কেউবা সপ্তাহ খানেক আবার অনেকে একদিনেও ফিরে আসে সাগরের মাছ নিয়ে। সেকারণে সমস্ত ট্রলার একসাথে দেখা মেলে না। সব ট্রলার যদি এক হতো তাহলে দুবলার সৈকতের মতো আরও একটি সৈকত দরকার হতো। এরপরও আনুমানিক প্রায় পাচঁশ ট্রলার দুবলাসহ আশেপাশের চরে চোখে পড়েছে।
পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দরীর পিছনেই লেগে থাকলাম। দুবলার চর সহ আলোর কোল, মেহের আলী, মাঝের কেল্লা, নারকেলবাড়িয়া, শেলারচরের যে নৌকাগুলো রয়েছে প্রায় প্রতিটি ট্রলারে আছে একটি করে সুন্দরী গাছ। বেশ মোটা মাঝারি আকারের। প্রতিটি নৌকাতে কেন সুন্দরী গাছ থাকতে হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে আবারো শুটকি পল্লীতে। সবার সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলাম। জানলাম, দুবলার চরে চারমাসের জন্য শুটকি পল্লীতে নির্মাণে, বাসা বাঁধতে হাজার হাজার গাছ দরকার। ঘরের খুঁটি বানাতে যেমন সুন্দরী গাছ প্রয়োজন তেমনি মাছ ধরতেও এর দরকার। সমুদ্রে মাছের জাল ডুবানোর কাজে ব্যবহার হয় সুন্দরী গাছ। ত্রিশ থেকে ষাট ফুট গভীরতায় জাল ডুবিয়ে রাখতে সুন্দরী এ্যাংকর হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবনের সুন্দরী সহজে পানির নিচে ডুবে যায়। নোনা পানি সহনীয় সুন্দরী পানির নিচে টিকে থাকে বছরের পর বছর।
এবার জানতে পারি শুটকি পল্লী ঘিরে প্রতি বছর কী পরিমাণ সুন্দরী গাছ কাটা হয়। দক্ষিণে সাগর আর উত্তর দিকে সুন্দরবন মাঝে জেগে উঠা চরটির নাম দুবলা। নদী খালে ভর্তি সুন্দরবনের রয়েছে লইট্যাখালি, ভেদাখালি, মানিকখালি, ছোট-বড় আমবাড়িয়া, কবরখালি, টিয়ারচর, কালামিয়া, নারকেলবাড়িয়া, নীলবাড়িয়া, শেলারচর, ছাপড়াখালি এমন আরও অনেক নামের বন, যা দুবলার চরের শুটকি পল্লীর কাছাকাছি। নানা কথায় বেরিয়ে আসে এসব বন থেকে প্রতি বছর কার্তিক থেকে ফাল্গুন অর্থ্যাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সুন্দরী গাছ কাটা হয় কমপক্ষে আট হাজার। প্রতিটি গাছের বয়স কমপক্ষে দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ষাট বছরের এক বৃদ্ধ জানান, সাগরে জালের এ্যাংকর হিসেবে সুন্দরী ছাড়া তিনি কিছুতেই ভরসা রাখতে পারেন না।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি আরও বললেন, প্রতি বছর যেখানে সুন্দরী গাছ কাটা হয় সেখানে আর নতুন করে সুন্দরী গাছ দেখা যায় না। কারণ বড় গাছ কাটলে বীজ আসে না। বীজের গাছ থাকলেই তো জোয়ার ভাটাতে বনের এধার ওধারে সুন্দরীর বীজ ছড়িয়ে যায়।
আভিজ্ঞ সে ব্যক্তি আরও জানালেন, বড় সুন্দরী বা মা গাছ এক জায়গায় আছে পাঁচটা আমি যদি পাঁচটা কেটে ফেলি তাহলে গাছ হবে কিভাবে? অনেক আগের কথা বাদ দেন গত দশ বছরে আট হাজার করে গাছ কেটে ফেললে কমপক্ষে চৌষট্টি হাজার সুন্দরী গাছ কেটে ফেললাম, তাইলে মনা, বীজ দেবেনে কেডা?
বনের বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই বনের ভিতরে সুন্দরী গাছের কী বেহাল দশা। আমি তার কথা শুনছি, মাঝে মাঝে বুকটা চিন চিন করছে হয়তো সুন্দরীর জন্য।
সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ কেটে ট্রলারে উঠানোর অনুমতি কে দিলো? বনবিভাগ কোথায়? নজরদারির দায়িত্বে কে রয়েছেন এমন নানা প্রশ্ন এখন নড়েচড়ে বসেছে। দুবলার চরের সন্নিকটে মেহের আলী নামক জায়গায় বনবিভাগের অফিস। মোহাম্মদ শাহ আলম ছিলেন সে অফিসের ইনচার্জ। দুবলারচরে এদিক সেদিক পথ চলতে তাকে খুঁজে পেলাম।
পাঠক মাঝে অনেক কথা ফেলে দিলাম কারণ লিখার বহর বড় হচ্ছে।
অবশেষে সব জানতে পারলাম প্রতি ট্রলারে ব্যবহৃত সুন্দরী গাছ (এ্যাংকর) প্রতি তিন হাজার টাকা নিয়েছেন সেই বনকর্তা, ভাগাভাগিও হয় উপর মহল পর্যন্ত।
পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব ক্যামেরাবন্দি হলো, আমার প্রশ্ন বন অফিসারের উত্তর ও উপস্থিত সাধারণ মানুষের কথা। বন অফিসার চলে যাবার ঘণ্টাখানেক পর হিসেব মেলাতে বসলাম। পাঁচ মাসের জন্য ট্রলারে ব্যবহৃত সুন্দরী প্রতি তিন হাজার টাকা হলে আট হাজার গাছে দুই কোটি চল্লিশ লাখ টাকা। হিসেব যখন মিললো তখন দুপুর গড়িয়ে যায়।
সব স্বীকারোক্তি দলিল হয়ে থাকলো সুন্দরবনের সুন্দরী নির্যাতনের ইতিকথায়।
বিঃ দ্রঃ ২০১৪ সালে এই ঘটনা বনবিভাগকে জানানোর পর বনবিভাগ কিছু সাধুবাদ পাবার মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গেল বছর অর্থ্যাৎ ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পুরো শুটকি পল্লীতে বাঁশের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ বছর আরও জানতে পারলাম পাঁচ মাসে অস্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য বাঁশের ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঘরের চাল হিসেবে গোলপাতার ব্যবহারও নিষিদ্ধ হয়েছে। এ বছরে সবাই গোলপাতার বদলে ঘরের চালা হিসেবে ত্রিপল ব্যবহার করেছে। তবে টিনের চাল ব্যবহার নিষেধ রয়েছে কারণ ঝড়প্রবণ এলাকাতে জানমালের ক্ষতি হতে পারে।
এতো সবকিছুর পরও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি ট্রলারে এ্যাংকর হিসেবে সুন্দরী গাছের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে কিনা। তবে জানা মতে এ বছরও ব্যবহৃত হচ্ছে সুন্দরী গাছের এ্যাংকর।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিভাগ, একাত্তর টেলিভিশন