ঝিনাইদহে যেন নদী দখল উৎসব
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:৫০
ঝিনাইদহে খননের অভাবে অধিকাংশ নদী পরিণত হয়েছে মরা খালে। ফলে নদী তীরে জেগে ওঠা চরে হচ্ছে চাষাবাদ। অন্যদিকে নদী দখল উৎসবে মেতে উঠেছেন নদী তীরের বসবাসকারী প্রভাবশালীরা। নদী দখল মুক্ত করতে কিংবা খনন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দেখা মেলে না জেলা প্রশাসন বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন পদক্ষেপ।
এমনকি বিশেষজ্ঞদের মতে ঝিনাইদহের নবগঙ্গা নদীতে পাওয়া যেত পর্যাপ্ত ঝিনুক। সেই সূত্র ধরেই জেলার নামকরণ প্রথমে ঝিনুকদহ পরবর্তিতে ঝিনাইদহ। নবগঙ্গা, চিত্রা, কুমার, বেগবতি, গড়াই, ইছামতি সহ ঝিনাইদহ জেলার উপর দিয়ে ১২ টি নদী প্রবাহিত। এ নদীগুলো ছিল প্রচন্ড প্রমত্তা। নদীতে পাওয়া যেত পর্যাপ্ত মিঠা পানির মাছ, চলাচল করতো বড় বড় নৌকা, পাড়ে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা বাণিজ্য, নদীর পানি দিয়ে করা হত চাষাবাদ।
কিন্তু এ চিত্র এখন একেবারেই উল্টো। কুমার নদের শৈলকুপা অংশের জিন্না আলম ডিগ্রী কলেজ এলাকা, বারই পাড়া এলাকা, কবিরপুর, বিজুলিয়া, ফাদিলপুর অংশ সহ বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। শুধু কুমার নদ নয়, জেলার সব নদীগুলোরই একই অবস্থা। এসব জেগে ওঠা চরে চলছে সরষে, কলাই, মশুড়ী, পেয়াজ সহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। খননের অভাবে জেগে ওঠা চরে চরানো হচ্ছে গবাদি পশু। নদীতে কমেছে মিঠা পানির মাছ।
অন্যদিকে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে নদী দখল। মানুষ দেদারছে মেতে উঠেছে নদী দখল উৎসবে। নবগঙ্গা নদীর ধোপাঘাটা ব্রীজ, হাটগোপালপুর বাজার, চাকলাপাড়া, মডার্ন এলাকা, কুমার নদের জিন্না আলম ডিগ্রী কলেজ এলাকা, কবিরপুর, শৈলকুপা নতুন ব্রীজ, চিত্রা নদীর নিমতলা এলাকা, পুরাতন বাজার এলাকা সহ বিভিন্ন স্থানে তীর দখল করে নির্মান করা হচ্ছে ঘর-বাড়ি, দোকান পানকাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালি তোলা হচ্ছে। নদী তীর থেকে যে যার মত করে কেটে নিচ্ছে মাটি। ড্রেনের ময়লা পানি গিয়ে মিশছে নদীতে এসব কারণে একদিকে যেমন কমছে নদীর প্রশস্ততা, মাছ সহ জলজ প্রাণী, তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ।
জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ নিয়ে কথা হয় শৈলকুপার কবিরপুর এলাকার ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষী সাত্তার মন্ডলের সাথে। তিনি জানান, প্রায় ২৫ বছরের মত নদী তীরে চর জেগে উঠেছে। সেই থেকেই তিনি এই চরে ফসল চাষ করছেন। ফলনও হচ্ছে ভাল। শুধু বর্ষার সময় অল্প কিছুদিন পানি থাকে। অন্যান্য সময় পানি থাকে না এমনকি শুকনা মৌসুমে নদী একেবারেই শুকিয়ে যায়।
শৈলকুপার বিজুলিয়া গ্রামের আনন্দ কুমার বিশ্বাস জানান, প্রায় ৪০ বছরের বেশী সময় ধরে কুমার নদে জাল ফেলে ও বরশি দিয়ে মাছ শিকার করেন। আগে যেখানে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ কেজি মাছ পাওয়া যেত এখন তা কমে দায়িছে ১ কেজিতে। আবার কখনও তাও পাওয়া যায় না।
ঝিনাইদহ সরকারী কেসি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক রহমত আলী জানান, বাংলাদেশের আনাচে কানাচে জালের মত নদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বলা হয় নদী মার্তৃক দেশ। কিন্তু আজ সেটি স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ও মানুষ্য সৃষ্ট কারনে নদী গুলো আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। এতে করে এক সময় প্রচুর পানির সংকট সৃষ্টি হবে।
এছাড়া নদীতে বিভিন্ন জলজ প্রানী বসবাস করে যারা পরিবেশের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। নদী ভরাট হয়ে যাওয়া ও নানা ভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারনে দিন দিন কমে যাচ্ছে এসব প্রাণী। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এক সময় পরিবেশ চরম হুমকির মুখে পড়বে।
তাই বিশেষজ্ঞ ও সর্বস্তরের মানুষের দাবি নদীগুলো যেন অতি দ্রুত খনন ও দখল মুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহমানতা ফিরিয়ে আনা হয়।
তবে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ জানান, নদী খনন করার মত পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই। যদি অর্থ বরাদ্দ আসে তাহলে নদী খনন করা হবে। তবে নদী দখল মুক্ত করার দায়িত্ব আমাদের নয়, এটির দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার জানান, নদী দখল মুক্ত করা শুধু মাত্র জেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টাই হবে না। এর জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরকার, দরকার মানুষকে সচেতনতা। তবে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। সরকারের কঠোর নির্দেশনা যে নদী দখলকারী যে হোক না কেন তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আমরা সেই নির্দেশনা ভিত্তিক এগোচ্ছি।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, নদী খননের বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী বদ্ধ পরিকর। আমাদের কাছে চিঠিও এসেছে এ ব্যাপারে। যে, নদীগুলো খনন করে তার স্বাভাবিক নাব্যতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমি সকলকে সাথে নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে নদী গুলো খনন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।