‘কাউকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন না’
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০১৭, ১৬:৩০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে তুলে ধরে উন্নত ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের আহবান জানিয়েছেন। তিনি এজন্য প্রয়োজনীয় সব রকম সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তারা আরো উন্নতমানের এমন সিনেমা করবেন, যা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সবকিছু যেন ধারণ করতে পারে এবং পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের এই শিল্পটা যাতে আরো মর্যাদা অর্জন করতে পারে। বিশেষভাবে এসব দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ জুলাই (সোমবার) বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৫ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান একেএম রহমতউল্লাহ। তথ্য সচিব মর্তুজা আহমদ স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ.প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং চলচ্চিত্র শিল্পে সম্পৃক্ত সব ধরনের কলা-কুশলীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ২৫টি ক্যাটাগরিতে ৩১ জন শিল্পী, কলা-কুশলীকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৫ প্রদান করা হয়।
চিত্র নায়িকা শাবানা এবং সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌসি রহমান আজীবন সম্মাননা পুরকার লাভ করেন। পরে নিজস্ব অনুভূতিও ব্যক্ত করেন চিত্র নায়িকা শাবানা।
পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক অধায়ের পর দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাস জীবনে বাধ্য থাকা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করে বলেন, এই ফিরে আসার মধ্যদিয়ে চেষ্টা করেছি যে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, হত্যা ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে দেশের ইতিহাস বিকৃত করা, আমাদের কৃষ্টিকে ধ্বংস করার একটি অশুভ তৎপরতা যেটা আমরা দেখেছিলাম আমি তার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ শুরু করি। বাংলাদেশে যেন একটি গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসে সে প্রচেষ্টাও চালাই। দুর্ভাগ্য যে, পঁচাত্তরের পরে যারা ক্ষমতায় এসেছিলো তারা আমাদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, সেই সময়ও আমরা দেখেছি আমাদের দেশের কিছু তরুণ শিল্পী, কলা-কুশলী, চিত্র নির্মাতারা এই সীমিত সুৃযোগের মধ্যেও অনেক নান্দনিক চলচ্চিত্র এদেশের মানুষকে উপহার দিয়েছেন। কাজেই সেই দিক থেকে আমি মনে করি আমাদের দেশের মানুষের যথেষ্ট মেধা রয়েছে। একটু সুযোগ পেলে তারা অনেক ভালো সিনেমা নির্মাণ করতে পারে।
১৯৮৬ সালে এফডিসি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার কথা স্মরণ করে সেসময়ে বিরোধী দলে থাকাবস্থাতেও এফডিসির সামনের সড়কটি চাপ প্রয়োগে তৎকালীন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে দিয়ে তৈরীর প্রেক্ষাপটও স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় চলচ্চিত্রের কলা-কুশলীদের দুঃসময়ে সহায়তার জন্য বিদ্যমান ট্রাষ্ট ফান্ডটিকে আরো উন্নত করারও ঘোষণা দেন।
এদেশে সরকার পরিবর্তন হলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কি দশা হয় তা নিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই ট্রাষ্ট ফান্ড কে একটি স্থায়ী রূপ দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। যাতে সরকার পরিবর্তন হলেও এটা বন্ধ না হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সহ পূর্ববর্তী সামরিক সরকারগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘তখন সিনেমা হলগুলোতে মানুষ যেত না। তখন একটি অপসংস্কৃতি মানুষের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যেতো।’
তিনি বলেন, সিনেমা হলে তার সরকার দর্শক ফিরিয়ে আনতে চায়, আর সে জন্য স্বল্প খরচে মান সম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সুযোগ করে দিতে সরকার সেসব ক্ষেত্রে ট্যাক্স হলিডে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আধুনিক সিনেপ্লেক্স যারা নির্মাণ করবেন তারা কিন্তু ট্যাক্স হলিডে পেতে পারেন। সিনেমা হলের আধুনিকায়নেও অনেক সুযোগ আমরা দিচ্ছি এবং এজন্য প্রয়োজন হলে আর্থিক সহায়তাও দেব।’
পুরস্কার বিজয়ী এবং জুরিবোর্ডের সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই এই শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয় তখন আমি আশা করবো এখানে কেউ প্রভাব খাটাবার চেষ্টা করবেন না। সত্যিকার শিল্পীর যেন মূল্যায়ণ হয়। সত্যিকার কলা-কুশলীদের যেন মূল্যায়ণ হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন। যাদের ক্ষমতা রয়েছে তাদের সেই ক্ষমতাটার যেন অব্যবহার না হয় সেইদিকে কেউ যেন চাপ সৃষ্টি না করেন। আর এ পুরস্কারটা মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবছর দেয়া হয়। যেটা একটা রাষ্ট্রীয় সম্মান। এই সম্মানটা যতবেশি আমরা দিতে পারবো আমি মনে করি প্রত্যেকের ভেতরেই ততটা বেশি করে অনুপ্রেরণা আসবে সুন্দরভাবে নিজের জ্ঞান ও মেধা বিকাশের।
এ দেশে সিনেমা আন্দোলনের অতীত স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সহ আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলো। যুক্তফন্টের সরকার গঠন হলো। তখনি কিন্তু এই বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববঙ্গে) চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই কিন্তু উৎসাহিত করেছিলেন বাঙালিদের বাংলায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের। তাই মুখ ও মুখোশ সিনেমাটি সেই ’৫৪ সালে প্রথম নির্মিত হয়। কারণ তখন পাকিস্তানীরা মনে করতো বাঙালিরা আবার কি চলচ্চিত্র বানাবে, বাঙালিরা কিছুই করতে পারবেনা এটাই ছিল তাদের মানসিকতা। মূলত, আমাদের ছেলেবেলা থেকেই দেখা এবং চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গেই যারা জড়িত এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সম্পৃক্তদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি সংশ্লিষ্টতা ছিল এবং তিনি তাঁদের উৎসাহিত করতেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের তখন এমন অবস্থা এই ভূখন্ডে তখন কিছুই ছিলনা আমাদের পূর্ববঙ্গেও টাকাতেই সেখানকার মুরুভূমি থেকে নতুন শহর গড়ে উঠছিলো। আর এখানে সিনেমা তৈরী করে সেটা নিয়ে যাওয়া হত লাহোরে। যেখানে পূর্ববঙ্গের টাকাতেই তারা সিনেমা শিল্প গড়ে তুলেছিলো। কাজেই এখানে যদি কোন সিনেমা তৈরী হয়েছে তার নেগেটিভগুলো লাহোরে পাঠাতে হয়েছে সেটা সবধরনের প্রক্রিয়াকরণ শেষে যখন আবার ফেরত আনা হয়েছে সেটার সেন্সরশীপ করা হত এবং কাষ্টমস ক্লিয়ারেন্স নেয়া হত।
জাতির পিতা চেয়েছিলেন বাংলাদেশবে একটি ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন। যে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। আমার বিশ্বাস, চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ এ নীতিমালার আওতায় উপকৃত হবেন। এছাড়া, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বিএফডিসি’র কমপ্লেক্স নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ কমপ্লেক্স চলচ্চিত্র শিল্পী, কলাকুশলী ও কারিগরি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞগণের কাঙ্খিত চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।
বিএফডিসি’র অবকাঠামো ও ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কাজও এগিয়ে চলছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএফডিসি স্কয়ার নির্মাণ কাজ চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে শুরু হচ্ছে। এর ফলে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের দীর্ঘদিনের চাহিদা পূরণ হবে। ৫৮ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বিএফডিসি’র আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পথে। এ প্রকল্পের আওতায় আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণের উপযোগী বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সাভারের কবিরপুরে ১৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি’ নির্মাণ (১ম পর্যায়) প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম সিটি গড়ে উঠবে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শ্যুটিং স্পট তৈরি করা হবে। এখানে আধুনিক ও বিশ্বমানের ‘বঙ্গবন্ধু ফিল্ম আর্কাইভ’ গড়ে তোলা হচ্ছে। আমরা চলচ্চিত্র শিল্পে মেধাবী ও সুদক্ষ কর্মী সৃষ্টির জন্য ফিল্ম ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নে চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছি।
সরকার প্রধান বলেন, ইতোমধ্যে ৬৪টি জেলা ও ৪ উপজেলায় আধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পে প্রতিটি কমপ্লেক্স মাল্টিপারপাস সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা চলচ্চিত্র বিপণনে সহায়তা করবে। এছাড়া, চলচ্চিত্রে সেন্সর ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সার্টিফিকেট ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অনলাইনে চলচ্চিত্র মুক্তির ব্যবস্থা চালু হলে চলচ্চিত্র দর্শক ও গবেষকদের আকাঙ্খা পূরণ হবে। চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে চলমান অন্যান্য কাজসমূহ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য আমি তথ্য মন্ত্রণালয়কে আহ্বান জানাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি আশা করি- চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীসহ সংশ্লিষ্ট সকলে নিজেদের মেধা, শ্রম ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
তিনি বলেন, আপনাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০২১ সালের আগেই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হব ইনশাআল্লাহ।
প্রধানমন্ত্রী পরে চলচ্চিত্র কলা-কুশলীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।