একজন শিক্ষক, শিক্ষাগুরুর জন্মদিন

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:২৩

আমাদের প্রিয় শিক্ষক, আমার শিক্ষাগুরু হেলালউদ্দিন খান শামসুল আরেফিন স্যার প্রয়াত হয়েছেন কয়েক মাস আগে। অনেক দিন থেকে ভাবছিলাম স্যারকে নিয়ে কিছু লিখবো কিন্ত নানা সমস্যার কারণে সেটা হয়ে উঠেনি। গত তেইশ এপ্রিল ছিল আমাদের অনেকেরই প্রিয় শিক্ষকের জন্মদিন, এই জন্মদিনটি আমার কাছে একটু আলাদা। আব্বা এবং স্যার এক মাসের ব্যবধানে একই দিন, একই সন্ধ্যা লগ্নে চলে যান না ফেরার দেশে। এইতো মাত্র কয়েক মাস আগে। স্যার চব্বিশ ডিসেম্বর আব্বা চব্বিশ জানুয়ারি। আমি বিশ্বাস করতে পারি না উনারা দু'জন নেই। স্যারের হাসি এখনো আমার চোখে ভাসছে। অথচ উনি নেই! এর মাঝে কয়েক দিন শাহবাগ গিয়েছি, মনে মনে স্যারের বাসায় যাবার প্লানও করেছি। পরক্ষনে মনে পড়েছে নেই, তিনি নেই! 

আর আব্বা তো প্রায়ই আমার বাসায় আসছেন। সেদিন সন্ধায় ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমিয়েছিলাম, ওমনি সময় মা আব্বা দুইজন একটি আলো হাতে নিয়ে এসে আমাকে ডাকছেন। আমি ঘুমের মধ্যে তালালকে বলছি বাবা লাইট জ্বালাও তো। পরে মনে হল আমার মায়ের হাতেই তো আলো ছিল। চিরকাল শুনে এসেছি সন্ধ্যায় ঘরে আলো জ্বালাতে হয়, যেহেতু আমি জ্বালাইনি তারা এসে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে আমি দেখলাম সত্যিই তো আমার পুরো বাসা অন্ধকার!

যদিও এখন একা বসে আরেফিন স্যার সম্বন্ধে লিখছি তবে মনে হচ্ছে উনার বাসার সেই পুরনো বেতের সোফায় বসে গল্প করছি। আমি ভাবতে পারি না, এতো তাড়াতাড়ি তিনি আমাদের ছেড়ে অচিনপুরে চলে যাবেন। এখনো দেখছি কয়েকটি বই হাতে ক্লাসের দিকে যাচ্ছেন। স্যারের কাছে পড়াশুনোর ব্যাপারে কেউ সাহায্য চাইলে তাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উনার পরিবারের অনেক শিক্ষকই আছেন, অথচ কখনো তিনি গর্ব করে তাদের গল্প করেন নি। এসব শিক্ষকদের আমি স্যারের মৃত্যুর পর দেখলাম এবং জানলাম উনারা স্যারের আত্মীয়। তবে স্যার একমাত্র উনার মা-বাবার গল্পই করেছেন আমার বা হয়তো অনেকের সাথে।

ঢাকায় আমার বন্ধু বলতে স্যারই ছিলেন, নৃবিজ্ঞানে পড়ার শুরু থেকে স্যারের সাথে আমাদের যে সম্পর্কের সূচনা হয়, সেটা চিরদিনের, অবারিত ও শাশ্বত। তিনি ছিলেন আমার সুখের, আনন্দের ও ব্যথার কথা শোনার একজন ভালো, মনোযোগী শ্রোতা। আমি মফস্বল থেকে রাজধানীতে আসা এক সহজ-সরল মেয়ে ছিলাম। রোকেয়া হলের যে রুমে বসবাস করতাম সেখানে আমাকে নিয়ে অনেক ধরনের মজা করা হতো; শালীনতার সীমা ছাড়াতো তা কখনো কখনো, যা বুলিং হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। রুমে ঠিকমতো পড়তে কিংবা ঘুমাতে পারতাম না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় পুরো সময়টিতে পড়াশোনা করেছি হলের রিডিং রুমে। স্যারের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা হতো; একদিন অতিষ্ঠ হয়ে রুম পরিবর্তনের কথা বললাম। স্যার বললেন, "মাহফুজা এটা তো কোন সমাধান না; নতুন যেখানে যাবে সেখানে যে একই সমস্যা হবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? বরং তোমার উচিত হবে যেখানে আছো সেখানে টিকে থাকা"। আমি আসলে সেখানে টিকে ছিলাম; ক'দিন পরে যারা আমাকে বিরুক্ত করতো তারা দু'য়েক জন চলে গেলে স্বস্তি ফিরে পেলাম। 

তারপর অনার্সের মনোগ্রাফ করার সময় স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর হয়। স্যার ছিলেন আমার সুপারভাইজার, নিয়মিত কথা হতো, সকালে কথা বলার জন্য উনার বাসায় চলে যেতাম। রোকেয়া হলের কয়েন বক্স থেকে স্যারকে ফোন দিতাম বাসায় যাবার অনুমতি চেয়ে, কখনো তিনি না বলেননি। মাস্টার্সে আমার সুপারভাইজার ভিন্ন হলেও স্যারের কাছে থেকে নিয়মিত থিসিসের ব্যাপারে পরামর্শ নিতাম। 

আমরা যখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তখন ডিপার্টমেন্ট থেকে শুনেছিলাম স্যারের বাসায় অল্পবয়স্ক একজন গৃহকর্মী ছিল, সে আত্মহত্যা করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। আসলে মেয়েটি ছিল অত্যন্ত দুরন্ত স্বভাবের, ওর নাম ছিল বৃষ্টি। সানশেড থেকে পা ফসকে বৃষ্টি নানা জায়গায় গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল। স্যার মেয়েটিকে প্রথমে পিজি, তারপর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করান; এসব জায়গায় মেয়েটির দীর্ঘকাল ধরে চিকিৎসা চলে। অবশেষে তাকে সি.আর.পি-তে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে স্যার নিয়মিত যেতেন খোঁজখবর নিতে। একবার আমি আগ্রহী হয়ে বললাম, "স্যার আমি সি.আর.পি-তে যেতে চাই"।

একদিন উনি আমাকে এবং ছোট্ট ছেলে আনানকে নিয়ে তার সেই লাল গাড়িতে করে সি.আর.পি-তে গেলেন। সি.আর.পি-তে বৃষ্টি সবাইকে বলতো আরেফিন স্যার ওর বাবা। কয়েকজন সেদিন স্যারকে বলেছিল "ও কি  আপনার মেয়ে?" আনান শুনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল; স্যার কিন্ত রাগেননি বরং আনানকে বুঝিয়েছেন। আমি তখন মার্জোরি কিনান রোলিং এর লেখা জেরি চরিত্রের কথা মনে করছিলাম। খুব মনে হচ্ছিল জেরির কথা। বৃষ্টি দোকান থেকে অনেক কিছু কিনে খেতো এবং সবাইকে বলতো "বাবা এসে সব টাকা পরিশোধ করে দিবে"। বৃষ্টির টাকা পরিশোধের পর স্যার আমাদের সি.আর.পি-র নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। বৃষ্টি সি.আর.পি থেকে ফিরে স্যারের বাসায় উঠলো। এতকিছুর পরও স্যার ওকে স্থান দিয়েছিলেন নিজ বাসাতে। মানুষ হিসেবে স্যার কত বড় মনের ছিলেন সেটা দু'য়েক পাতায় লিখে বোঝানো সম্ভব না। 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর চাকুরী সুবাদে যতদিনই শহীদ মিনারে গিয়েছি ততদিনই স্যারকে দেখতে বাসায় গিয়েছি। কিছুদিন পর পর স্যারের সাথে হাসি- আনন্দ-বেদনা শেয়ার না করলে যেন স্থবির হয়ে পড়তো সবকিছু। তারপর যে ক'দিন বিদেশে বসবাস করেছি প্রায়ই স্যারকে ফোন দিয়েছি। উনার সাথে কথা বলা মানে একরাশ আলো, ভালবাসা, সাহস, ভরসা খুঁজে পাওয়া। 

দেশে এসে শাহবাগে/ক্যাম্পাসে যতদিন কাজে বা ঘুরতে গেছি ততোদিনই আরেফিন স্যারের বাসায় গেছি। স্যারের সাথে দেখা/গল্প করা এবং বাচ্চাদের রেস্ট নেয়ার জায়গা ছিল স্যারের বাসা। তিনি ক্যাম্পাস থেকে চলে যাবার পরও আমার হাত থেকে রেহাই পান নি, লালমাটিয়া'র নতুন বাসায়ও চলে গিয়েছি স্যারকে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে হামলা করতে। এরকম হামলায় তিনি কখনো বিরক্ত হন নি। বরং খুশি হয়েছেন আমরা স্বামী সন্তানসহ দেখা করতে যাই বলে। স্যার বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করতেন, বাচ্চাদের তিনি 'ফিউচার অফ দ্য নেশন' বলতেন। আমার ছেলে এবং মুনিয়ার মেয়ে মাত্র দশ দিনের ছোট বড়। উনি যখন নানা হলেন তখন কি যে খুশি হলেন ভাবাই যায় না।

উনার সাথে কথা হলে আমার ছেলের কথা জানতে চাইতেন এবং পুতলীর কথা বলতেন। স্যার তার ছাত্রদের স্পেস দিতে কোন কার্পণ্য করতেন না। সেই বিশেষ স্পেসের কারনে ছাত্রদের সাথে তার একটি অসাধারণ সম্পর্ক গড়ে উঠত। ছাত্রদের সাথে স্যারের এই সম্পর্ক শুধু নৃবিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয় বরং অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররাও তার কাছে যেতেন কথা বলার জন্য।

আরেফিন স্যারের বাসা থেকে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে; এবং একথা নিঃসন্দেহ বলতে পারি, এদের অনেকের সাথে আমার যেরকম সম্পর্ক সেটা নিজের পরিবারের অনেকের সাথেই নেই। যেমন 'ফারজানা নাজ শম্পা' আপা কানাডা প্রবাসী, উনি আমার পরিবারের একজন সদস্য না হয়েও অনেক কাছের মানুষ, আপনজন। ফারজানা আপার মায়ের সাথে স্যারের ভাল সম্পর্ক ছিল। আমার খুব ভাল করে মনে পড়ে, প্রথম সন্তান জন্মের আগে আপার বাসায় গিয়েছিলাম, আপার মা আমার পায়ের নিচে নিজ থেকে একটি টুল দিয়ে দিলেন। আমি আসলে একটি টুলই খুঁজছিলাম কিন্ত বলতে সংকোচবোধ করছিলাম। আরেফিন স্যার এবং তার সাথে ছড়ানো ছিটানো বাতিঘরগুলি হচ্ছে এরকম নির্মল, নির্ভেজাল! বাংলাদেশে খুব কম শিক্ষককে আমি জীবনে জড়িয়ে ধরে ভাল-মন্দে আবেগে আপ্লুত হতে পেরেছি, আমার জীবন থেকে সেই একমাত্র আলিঙ্গন করার মতো সেই মানুষটি চলে গেলেন!! এভাবে চলে গেলেন? চলে যাবার আগে যদি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারতাম! চিরদিন সেই বাসনাই হয়ত রয়ে যাবে! 

স্যারের বাসায় একটি মিলাদ হয়েছিল সেখাননে আমি বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকের সাথে জীবনে প্রথম, অনেকের সাথে অনেক বছর পর আমার দেখা হয়েছিল। মিলাদের এক পর্যায়ে পুরুষরা স্যার সম্পর্কে স্পিচ দিয়েছিল, নারীদেরকে স্পিচের সুযোগ দেয়া হয়নি সেদিন। আমি স্পিচ কে দিতে পারলো, কে দিতে পারলো না, সেই নালিশ জানাতে লিখতে বসিনি। মনে পড়ছে আমার শিক্ষাগুরুর চিন্তা, বিভিন্ন বিষয়কে ভিন্নভাবে দেখার স্বকীয়তা, উপলব্ধি নিয়ে। আমার বিশ্বাস তিনি সেদিন ওপার থেকে হেসেছেন এবং বলছেন, "দেখো মাহফুজা, বিভিন্ন সামাজিকতা, প্রথা, আচার নারীদের স্পেসকে কিভাবে সংকুচিত করে। হা হা হা....." 

দ্বিতীয়ত আরও ভাবছিললাম, আমরা অনেকে একজায়গায় একত্রিত হয়েছিলাম স্যারের জন্য দেয়া মিলাদ উপলক্ষে, এই উপলক্ষ আমাদের সবাইকে একটি ভিন্ন রকম স্পেস দিয়েছে। মোকাদ্দেম স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল, আমি তার কুশল জানতে চেয়েছিলাম। এসময়ে সানিকা (আমার তিন বছর বয়সী কন্যা) বললো, "এটা কি তোমার আরেফিন স্যার"? আমি ওকে বললাম, "আরেফিন নাই আর আসবে না আমাদের এখানে, এটা আমার মোকাদ্দেম স্যার"। সানিকা মোকাদ্দেম স্যারকে চিনলো। বহু বছর পর বিকে জাহাঙ্গীর স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। স্যারের বোনের ছেলেকে পিছন থেকে বললাম, "কে আপনি? আপনার চুলগুলো আমার স্যারের মত!" তিনি বললেন আমি ওনার বোনের ছেলে, এরকম অনেক কিছু জানলাম। ডিপার্টমেন্ট এর এক জুনিয়ার (এগারো ব্যাচের) বলেছিল "'আপনার সাথে আরো আগে দেখা হলে ভালো হতো আপু"। 

কি অসাধারণ প্রাপ্তিযোগ ছিল সেদিনের সেই সন্ধ্যালোকে! আমার মনে হয় আরেফিন স্যার মনে মনে ওপার থেকে হাসছিলেন এবং বলছিলেন, "দেখ মাহফুজা, আমি তোমাদের একত্রিত হবার জন্য স্পেস করে দিয়েছি"। 

স্যার আপনি হাটে, মেলায়, রিচুয়ালেও নৃবিজ্ঞান শিখিয়েছেন! ভাল, গুছিয়ে লিখতে পারলাম না স্যার! আচানক এভাবে চলে গিয়ে যদি ভাল থাকতে পারেন আপনি তাই থাকুন। তবে অনেক ঋণী করে রেখে গেলেন স্যার।

শুভ জন্মদিন স্যার, যেখানে থাকুন ভাল থাকুন। অনেক অনেক ভালবাসা স্যার! 

লেখক: স্টোরিটেলার, অ্যাক্টিভিস্ট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত