গল্প
ভ্রূণ
প্রকাশ : ১৭ মে ২০১৭, ০১:১৬
মানুষ তো মানুষ, একটা কুকুর পর্যন্ত নেই যেখানে, সেইরকম ছোট্ট একটা বাসস্টপেজে সে নেমে পড়ে। একেবারেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন নেমে পড়া যাকে বলে। সড়ক পথে আকাশে ওড়ার অনুভূতি পাইয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটা দূরপাল্লার বাস যার গন্তব্য ঢাকা, চল্লিশ মিনিটের মাথায় ব্রেক কষতে চায়নি নিশ্চই। ব্রেক কষতে হলো কারণ, লাবণ্যকে বাস থেকে নেমে পড়তে হবে। কেন নেমে পড়তে হবে সে নিজেও জানে না কিংবা হয়তো জানে। অকারণে নেমে পড়লেও এক কথা ছিল, সে যে কারণে নেমে পড়েছে সেই কারণ শুনলে কেউই তাকে প্রকৃতস্থ ভাববে বলে মনে হয় না। একথা লাবণ্য নিজেও জানে। আর ঠিক এ কারণেই এই মুহুর্তে সে নিজেকে নিজেই ধিক্কার দেয়। কিন্তু ধিক্কার দিলেই সব চুকে যায় না। রাত বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিটে লাবণ্য লালাবাজার নামের এই প্রায় গঞ্জের মত একটা বাসস্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে। বুনো জন্তুর ভয় না, ভূত-প্রেতের ভয় না, তাকে তাড়িয়ে ফিরছে এর চেয়েও ভয়ংকর কোন কিছুর ভয়। পুরুষ। নিশ্চই কোন মদ্যপের লোলুপ দৃষ্টি তাকে গিলে খাচ্ছে কোন অন্ধকার থেকে, হয়তো এখনই এসে তার উপর হামলে পড়তে চাইবে। যতই ভাবে ততই নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায় লাবণ্য। গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ের কাছে ফেলে রাখা লাগেজ পিচের রাস্তায় পড়ে গেলে এই নিঝুম নিস্তব্ধ প্রাণীশূণ্য স্থানে যে শব্দ হয়, তাতেও বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে। আর কতক্ষণ লাগবে? লোকটার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? লাবণ্য একা একটা মেয়ে এত রাতে বাস থেকে নেমে যাতে পারে, আর উনার আসার কোন নাম গন্ধ নাই। লাবণ্য নিজেকেই যেন খুঁজে ফিরছে। কোথায় সে? সম্পূর্ণ অচেনা অজানা...অচেনা অজানা?.. তা নয় তো কী? ফেসবুকের ওইটুকু হাই হ্যালো কোন পরিচয় হতে পারে নাকি?.. তো স্বল্প পরিচয় বলতে যা বোঝায় ঠিক তাও নয় এরকম একটা মানুষের অনুরোধে, আচ্ছা অনুরোধ নয়, মিনতিতে সে বাস থেকে নেমে পড়লো? তাও এত রাতে? আরে ধুর ছাই! এরকম কারণে কেউ দিনের বেলাতেও নামে নাকি? লাবণ্য আবিষ্কার করে এই মুহুর্তে নিসঃঙ্গতাকেও সে ভয় পাচ্ছে। যেন বা নিসঃঙ্গতাকে সে কেবল এই মুহুর্তেই বুঝতে পারছে। একা শপিং এ যাওয়া, কিংবা একা ঘুমানো তো এ নয়। এ যে রীতিমত পুরো বিশ্বচরাচরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া নিসঃঙ্গতা। যার ফলে লাবণ্য চিন্তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে কিংবা চিন্তা নিজে থেকেই তাকে সঙ্গ দিচ্ছে।
কেমন হবে লোকটা? আরে কেমন হবে লোকটা মানে কী? এমন বা তেমন হবে, বিকেলে যেমনটা দেখেছে। লম্বা, ময়লা কাপড়, না কামানো মুখমন্ডল। ওই ওইটুকু সময় কি কাউকে বোঝার জন্য যথেষ্ট? আর বুঝতেই বা কি চেয়েছে লাবণ্য? ফেসবুকের হাই হ্যালো সর্বোচ্চ কফি পর্যন্ত গড়াতেই পারে। বোঝাবুঝির ল্যাঠা থাকে প্রেম পরিণয়ের ব্যাপার স্যাপারে। কিন্তু এখানে তেমন পরিস্থিতি তো নয়।
সুতরাং লোকটা কেমন তাতে কিছু যায় আসে না। কেমন হবে লোকটা এই ভাবনার মধ্যেই একটা প্রত্যাশা, একটা আকুতি আছে- ইশ ভালো যেন হয়! নিজেকেই নিজের বিরক্ত লাগছে। এতটা পুরুষস্বর্বস্ব নারী তো সে কোন কালেই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে বন্ধু ছিল, নাকে দড়ি দিয়ে কাউকে না ঘোরালেও চাইলেই লাবণ্য তা পারতো। আর প্রেমও সে করেছে। প্রেম! আহ প্রেম প্রেম প্রেম! শব্দটা মনে পড়তেই নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে লাবণ্যের। নিজের ছায়া দেখেও মেজাজ বিগড়ে যেতে চায়। অথবা করুণ স্নিগ্ধতাও তাকে দ্রবীভূত করে। ফুটফুটে একটা বাচ্চার ইতস্তত ছোটাছুটি, আধো আধো বুলি কিংবা নিজের ভেতরেই ছোট্ট একটা ভ্রূণের অস্তিত্বের স্বপ্ন... উফ! পুরোটা সত্তা যেন ভেঙে পড়তে চায়। বিষাদ অথবা অসহায়ত্ব অথবা প্রচণ্ড রাগে এক চিৎকারে সমস্ত পৃথিবীটাকে নাই করে দিতে ইচ্ছে করে। এর চেয়ে যে লোকটার হঠাৎ অনুরোধে লাবণ্য বাস থেকে নেমে পড়েছে তার কথা ভাবা যাক। আধ ঘন্টা হলো লাবণ্য ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা এখনো আসেনি। লাবণ্যের কি রাগ হচ্ছে? ভয়? ঘৃণা? কিন্তু এসব অনুভূতি কেনই বা হবে? হলে কার কী যায় আসে? লোকটা যে আসবেই তার কী নিশ্চয়তা আছে? লোকটা কেন আসবে? লাবণ্য কি চাইছে লোকটা আসুক? লোকটা আসার মানে সে বোঝে তো? লোকটা হয়তো তাকে এমনি এমনিই নেমে যেতে বলেছে। লোকটা হয়তো আসবে না। বাস থেকে নেমে গেলে আর বাড়ি ফিরে যাবে না, বাসে থাকা লাবণ্য আর বাস থেকে নেমে যাওয়া লাবণ্য এক হবে না- এসব কথা লাবণ্যও কি এমনি এমনি বলেছে? লোকটা আসুক লাবণ্য চায়। লোকটা না আসুক তাও লাবণ্য চায়। লোকটার উপস্থিতি আর কালকের দিন অন্যরকম হোক লাবণ্য সেটা চায়। লোকটা না এসে কালকের দিনটা একরকম নাহয় আরেকরকম হোক এটাও লাবণ্য চায়। আসলে ঠিক এই মুহুর্তের দ্বান্দ্বিকতার পীড়ন থেকেই কি সে কেবল বাঁচতে চায়?
লোকটার সাথে, নাহ লোকটা শব্দটা একটা আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। লোকটার নাম ধরে ভাবা যাক। তন্ময়ের সাথে ফেসবুকে পরিচয় মাস দুয়েক আগে। নিজ থেকে যেচে যেচে কথা বলতো। সব পুরুষই তাই করে। মাঝে মধ্যে ইনবক্সে কবিতা দিতো। লাবণ্য কবিতা খুব একটা না বুঝলেও এটা বুঝতো সেগুলো ঠিক কবিতা নয়। আমি তুমি আকাশ বাতাস কী পেলাম কী পেলাম না এসব আর যাই হোক কবিতা না। তন্ময় সিলেটে থাকে। লাবণ্যের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ..ও আচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ নাকি? গুরুত্বপূর্ণ হোক বা না হোক লাবণ্যের জীবনের পাঁচটি বছর কেটেছে সিলেটে। তখন তন্ময়কে চিনতো না সে। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় যখন সে, তখন পরিচয় তন্ময়ের সাথে। বাড়ি ঢাকা হবার ফলে পরিচিত মহলে কেউ কেউ কিছুটা সমীহ যে করতো না তা নয়। তবে এই সমীহ কিছুটা আত্মপ্রবঞ্চনা, কিছুটা হীনমন্যতা, কিছুটা ক্ষোভ তৈরি করতো লাবণ্যের ভিতরে। যদিও সে কাউকে কিছু বুঝতে দিতো না। লাবণ্যের বাড়ি বুড়িগঙ্গার ওপারে। ঢাকার জেলার অন্তর্গত হলেও সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্গত নয়। এক নগর দুই পিতার সন্তান ঢাকাবাসীর প্রতি লাবণ্য বরাবরই ঈর্ষা অনুভব করে। ঘন্টাখানেক বৃষ্টি হলেই সাঁতার কাটতে হয় হোক, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ধুলাবালি ধোঁয়া পেট্রল ডিজেল গায়ে মেখে কিংবা কোন ভিআইপির চলার পথকে নির্বিঘ্ন করতে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকতে হয় হোক, আধুনিক রাষ্ট্রের কল্যাণে ঢাকাবাসী একই নগরে দুই দুইজন বৈধ পিতার সন্তান হবার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী তো নাকি? লাবণ্যরা যে একেবারে এতিম তা নয়, নানান কিসিম ও স্তরের জনপ্রতিনিধিরা আছেন। কিন্তু পিতা আর জনপ্রতিনিধির মর্যাদা ও ভাবসাবগত পার্থক্য বুঝতে তো আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডির দরকার পড়ে না। সে যাই হোক, মূলত তন্ময়ের অতিউৎসাহ ও লাবণ্যের কিঞ্চিৎ গোপন কৌতুহলের কারণেই সিলেটে বা ঢাকায় একদিন একসাথে আড্ডা ও কফি হবে এই কথা হয় তাদের। এবার সিলেটে নিজের সব কাগজপত্র তুলতে এসে লাবণ্য তাই দেখা করেও ফেলে তন্ময়ের সাথে। তারপর বাসে ওঠার আগ পর্যন্ত সে লাবণ্যের সাথেই ছিল। বাসে ওঠার পর থেকেই তন্ময় আবেগী সব ক্ষুদেবার্তা পাঠাতে থাকে। অথচ সামনাসামনি তাকে একেবারেই এমন মনে হয়নি। ডানা থাকলে এক্ষুণি তোমার কাছে ছুটে যেতাম, বাসের জানালার পাশে উড়ে উড়ে তোমাকে দেখতাম মুগ্ধ নয়নে... এরকম চূড়ান্ত সস্তা ও হাস্যকর সব কথাবার্তা তন্ময় বলতে থাকে। লাবণ্যেরও যেন কী হয়। আচ্ছা বাজিয়ে দেখি তো ছেলেটাকে। এমন কথা বলতে হবে যাতে উৎপাত বন্ধ করে। পিছিয়ে যায়। কিন্তু যেই বলা হলো বাস থেকে নামলে আর কক্ষনো ফিরে যাবো না, সাথে সাথে তন্ময় রাজি হয়ে গেল। বললো বিশ মিনিটের মধ্যে সে লালাবাজার পৌঁছে যাবে। অন্যকে জব্দ করতে গেলে কি নিজেকেই জব্দ হতে হয়? অন্য কিছু বলে হয়তো এ যাত্রায় আপদ কাটানো যেতো, কিন্তু জীবনের সাথে লাবণ্যেরও অঘোষিত একটা যুদ্ধ চলছে যেন। নইলে এতটুকু মেয়ে সে, তাকে কেন এরই মধ্যে এত বেশি হারাতে হবে? হারানো? যে অস্তিত্ব দানাই বাঁধতে পারলো না, তাকে কি হারানো বলা চলে?
অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মাঝামাঝি অবস্থিত মানুষ সাযুজ্য খুঁজতে চায়। বাস্তবে না পেলে নাই, অন্তত গল্প উপন্যাস থেকে হলেও অনুপ্রেরণা কিংবা নিজের কাছেই অপরিচিত লাগতে থাকা স্বীয় কাজের বৈধতা খুঁজতে থাকে। এই মুহুর্তে লাবণ্যের যেমন মনে পড়ে ডক্টর শিরিন আহমেদের কথা। ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। গবেষণার কাজে কমলগঞ্জের পাহাড়ে গিয়ে তিনি দু-রাত ঘুমোন এক অপরিচিত লোকের সাথে। সাযুজ্য তো দূরে থাক, ভেবেই লাবণ্যের গা শিওরে ওঠে। তার জীবনে পাহাড়ের রাত না আসুক, বৃষ্টির রাত এসেছিল এক সে আসুক, কিন্তু তাই বলে অধ্যাপক শিরিনের মত এতটা র্যাডিকাল সে হতে পারবে না। কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, কী এসে যায় কিছু ঘটলে- শিরিন আহমেদের মত নির্বিকার ভাবে না হলেও, অন্তত মন্ত্রের মতন এই লাইনটা করোটিতে চালতে থাকে লাবণ্য।
তন্ত্রমন্ত্রের গুণে অথবা স্বাভাবিক যে কারণেই হোক একটা সিএনজি অটো থেকে তড়িঘড়ি করে নামে তন্ময়। ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা দশ মিনিটের অপেক্ষা, তাও এমন একটা নির্জন এলাকায়। রাগ করবে কী, লাবণ্য কেঁদে ফেলে। মুশকিল হলো প্রেমিক বা সঙ্গী বা বৈবাহিক সূত্রে কর্তৃপক্ষ স্বামীর কারণে এই বিলম্ব ও অপেক্ষায় একইসাথে যে সাসপেন্স এবং সেই সাসপেন্স গড়িয়ে যে রোমান্স আছে, এই সম্পূর্ণ নতুন লোকটির ক্ষেত্রে তা নেই। চোখের পানি নোনা বলে কি সার্থক হতে চাইবে না? আর কান্নার মানে এই লোকটা তার কাছে প্রত্যাশিত, গুরুত্বপূর্ণ; লাবণ্যের অবচেতন সম্ভবত সেটাও মেনে নিতে চাইছে না।
ফলে প্রায় নিরর্থক কান্না বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তন্ময় এরই মধ্যে নিশ্চই দেরি হবার পেছনে হাজারো যুক্তি দেখিয়ে ফেলেছে। সেসব লাবণ্যের কানে ঢোকেনি বলাই বাহুল্য। সে যন্ত্রের মত অটোতে উঠে বসে। মাঝখানে ট্রাভেল ব্যাগ। লাবণ্যকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। দেরিটা পুষিয়ে নিতেই হোক অথবা প্রথম পরিচয়ের পুরুষসুলভ বিনয় থেকেই হোক তন্ময় লাগেজটা ধরে এবং অটোর পিছনে রাখে। অটো স্টার্ট নেয়।
গন্তব্য মির্জাজাঙ্গাল। টুম্পা আপুর বাসা। লাবণ্য গম্ভীর কন্ঠে কেবল এটুকুই বলতে পারে।
টুম্পা আপু হচ্ছে সেই মানুষ যাকে কিছু বলতে হয় না। তার বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে কাল দেখা হবে এই কথা বলে তন্ময় চলে যায়। অটোতে লাবণ্যকে নিজের মত থাকতে দিয়েছে। যাক এটুকু বোধ আছে তাহলে। লাগেজ আর ট্রাভেল ব্যাগ রেখেই লাবণ্য টুম্পা আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। এবার যেহেতু নিরর্থক হবার সুযোগ নেই, নোনা জল গলগল করে বেরিয়ে আসে।
এত রাতে কেন ফিরে এলি বা যে ছেলেটা নামিয়ে দিলো সে কে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে না টুম্পা আপু। করবেও না। কেবল বলেন, "বালা করছোস রে বইন ফিরত আইচ্ছোস। তুই যাওয়ারগির বাদ তাকিউ মন কুব খারাফ আছিল।"
এই টুম্পা আপুকেও কি কম সংগ্রাম করতে হয়? আঁটোসাঁটো শরীরের বেগানা একটা মেয়েছেলে একা শহরের বুকে দিব্যি থাকবে, ঘুরবে, ফিরবে, থিয়েটার করবে আর সমাজের মোল্লাদের লালা ঝরবে না তাই কি হয়? তার উপরে আবার হিন্দু মেয়েছেলে। পাড়া দিয়ে যখন সে হেঁটে যায়, তাকে প্রায়ই শুনতে হয় দেখতে হয় অশ্লীল বাক্য, অঙ্গভঙ্গি। অনেকটা অসারের তর্জন গর্জনের মত। মোল্লা-মুরুব্বিদের শরীর যখন আর চলে না, তখন তাদের এই বাকসর্বস্ব যৌনতা যে কি ভয়ংকর তা যে শুনেছে কেবল সেই জানে। যদি আগুন হতো এইসব বাক্য তবে ভস্ম হয়ে যেতো সমস্ত পৃথিবী। কেবল যে বাক্যবাণে জর্জরিত করেই খালাস, দখল নিতে চায় নাই তা নয় মোটেও, তবে যখন দেখেছে এই মালাউন মালটার খুঁটির জোর খারাপ না, তখন নিরুপায় হয়েই অশ্লীল কথাবার্তা কিংবা সর্বোচ্চ দুই ঊরুর মাঝে হাত দেয়ায় নিজেদের কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ রেখেছে। সাধারণ মানুষ মোল্লাদের কথায় উঠলে বসলেও, মোল্লাদের রাজনীতির কথায় উঠতে বসতে হয়। আর আজকালকার সংস্কৃতি নাকি রাজনীতির ছায়াতলেই থাকে। তো এই মালু মেয়েছেলেটা নাকি কোন এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের ভাইয়ের দলে নাটক ফাটক করে। যেহেতু এক ভাই রাজনীতি ওরফে লুটপাটের মহাযজ্ঞের ক্ষুদ্র সারথি, তাই প্রায়শ্চিত্তই হোক আর পারিবারিক ভাবমূর্তির প্রলেপ দেয়ার জন্যই হোক আরেক ভাই সংস্কৃতি চর্চা করে। বাম রাজনীতির বাজারে অস্বাভাবিক ধস না নামলে হয়তো সেটাই করতো। একই ঘরে ডান বাম দুই-ই থাকলে, লেফট রাইট লেফট রাইট যেমন হয়, আবার লোকে পারিবারিক উদারপন্থার তারিফও করে।
তবে এইরকম প্রোটেকশন অবশ্য টুম্পা আপু নিতে চায় না, নিজের সংগ্রামটা নিজেকেই করতে চায়। কারণ টুম্পা আপু জানে লম্পট সবখানেই আছে। ধর্মে যেমন আছে, রাজনীতি সংস্কৃতিতেও আছে। সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে সুবিধা নিতে চাওয়ার লোকের অভাব নাই এখানে। কী যে দুর্বিষহ এই সংগ্রাম! মাঝে মাঝে টুম্পা আপুর মনে হয় আর কতদিন সে নিজেকে চারপাশের ভয়াল এইসব থাবা থেকে রক্ষা করে চলবে?
গতরাতে বাসে ওঠার সময় তন্ময় নামের এই লোকটা পাশে ছিল, আজ রাতে আবার যখন বাসে উঠতে যায় লাবণ্য তখনো এই তন্ময় তার পাশে দাঁড়িয়ে। এইবার আইনত সে তার স্বামী। কি করে কি হলো তা জানে না লাবণ্য। পুরো একটা দিন তার কেটেছে ঘোরের মধ্যে। নাকি ঘোরের অজুহাত? লাবণ্য চাইছিল এমন কিছুই? সকাল বেলা বের হয়ে এখানে ওখানে ঘুরে শেষমেষ কাজী অফিস। তন্ময়ের দুজন বন্ধুর উপস্থিতিতে মুসলিম রীতিতে তন্ময় লাবণ্যের বিয়ে হয়ে গেল। তারপর সারাদিন একসাথে ঘুরে রাতে আবার ঢাকার বাস। এই একটা রাতেরই তো পার্থক্য। আর বাড়ি ফিরে যাবো না বলেই যদি বাস থেকে নামলো লাবণ্য, তবে কেন আবার ফিরে যাওয়া? তাহলে মাঝখানের এই একটা রাতের কী অর্থ দাঁড়ালো?
অন্ধকার রাতের বুক চিড়ে বাস ততক্ষণে বেশ খানিকটা এগিয়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা ভাসছে সিলেট ঢাকা হাইওয়েতে। বৃষ্টি! হ্যাঁ একটা বৃষ্টির রাত, একটা বৃষ্টির রাত এসেছিল লাবণ্যের জীবনে। সিলেটে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে বৃষ্টি নিয়ে রোমান্টিকতা আদিখ্যেতা কিছুই ছিল না লাবণ্যের। কারোরই থাকার কথা না। লোকে বলে সিলেটে নাকি একটাই ঋতু। বর্ষাকাল। বছরে দুই রকম বর্ষা থাকে। গ্রীষ্মকালীন বর্ষা আর শীতকালীন বর্ষা। তারপরেও এতসব আটপৌরে বর্ষার মধ্যে একটা অন্যরকম বর্ষার রাত এসেছিল লাবণ্যের জীবনে। যে বর্ষার রাতে লাবণ্য জীবনের গাঢ় স্বাদ অনুভব করেছে, যে রাত লাবণ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে জীবন্মৃত। জীবিত হয়েও মৃত। যে রাত নতুন একটা ভ্রূণ, একটা ছোট্ট ভ্রূণ যা কিনা বড় একটা প্রাণে, একটা সম্পূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারতো, সেই ভ্রূণ লাবণ্যের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিল। লাবণ্য চিৎকার করে সেই ভ্রূণকে ডাকতে চায়। ভ্রূণটাকে নিজের মধ্যে পুষতে চেয়েছিল লাবণ্য। চেয়েছিল? তার মানে পারে নাই? কেন পারে নাই?
২০১৩ সালের কথা। দেশ, না; বলা ভালো রাষ্ট্র একটা বড় রকমের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল আগে থেকেই। যাক সে কথা, এই সময়ে রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলো। প্রথম রায়টাই জনগণের প্রত্যাশাসুলভ হয়নি। সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। শাহবাগ থেকে শুরু। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রের সর্বত্র। চৌহাট্টা পরিণত হয় একখন্ড স্বপ্নপুরীতে। অন্তত প্রথম দুইদিন। মঞ্চ মাইক মিডিয়া মুরুব্বি মুখপাত্রের দখলে যাওয়ার আগে, এই শাহবাগ স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। একটা ফিজিকাল স্পেস অনবদ্যভাবে একটা কনসেপ্ট, একটা চেতনায় পরিণত হয়েছিল। শাহবাগই চৌহাট্টা, চৌহাট্টাই শাহবাগ। দীর্ঘকাল পরে সমগ্র রাষ্ট্রে একটা প্রি-ফিগারেটিভ পলিটিক্স এর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। প্রাক রূপায়নের রাজনীতি। অভ্রের মত রাজনীতি করা তরুণরা তো বটেই, অরাজনৈতিক তরুণরাও নেমে এসেছিল রাস্তায়। লেখালেখি, যুক্তিতর্ক চলছে তুমুলভাবে। একদিন অভ্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয়। সেখানে লাবণ্য, অভ্রের সহপাঠী ও বন্ধু, মজা করে কমেন্ট করে বসে, "আশীর্বাদ করি বৎস, আরো ভালো লিখো"।
"তোর কাছে আশীর্বাদ কে চায়? আমি তো চাই তুই আমার সাথে আশি হাজার বছর বেঁচে থাক"।
খুবই সাধারণ একটা কথা। কিন্তু লাবণ্য বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। মেয়েরা বোধহয় ধাক্কা খেতেই জন্মায়। কী উত্তর দিবে ভেবে না পেয়ে লাবণ্য অনেকক্ষণ পরে ফিরতি মন্তব্য করে, "আচ্ছা, থাকলাম যা, তবে কাল তুই শহীদ মিনারে অবশ্যই আসবি। মিজান ভাই, পিংকু ভাইয়ের সামনে তোকে এই কথা আবার বলতে হবে। যদি রিপিট করতে না পারিস সবার সামনে দাঁড় করিয়ে ঠাস ঠাস করে চড়াবো"। এই মন্তব্য পড়ে অভ্র হাসে। সে কাপুরুষ নয়। রাজনীতি করে। ইদানিং সারাদেশে তার মত তরুণদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বলা হচ্ছে, আর সে যাবে না? অভ্র যায়। মিজান ভাই, পিংকু ভাই কেন, মঞ্চের ঐ মাইকেই তো সে লাবণ্যকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারে। হাজার হাজার মানুষ শুনবে, জানবে। আমার প্রেম, প্রিয়া, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির মতই সত্য।
লাবণ্য নতুন করে আবিষ্কার করে অভ্রকে। দুই বছরের বেশি হয় সে তাকে চেনে। কখনো এতটা আলাদা মনে হয়নি। ক্লাসে খুব নিয়মিত বা অনিয়মিত না। কি সব বাম রাজনীতি করে। হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল টিছিল করে। বক্তব্য বিবৃতি দেয়। এসবে লাবণ্যের কোন আগ্রহই নেই। ফিরেও তাকায়নি সেইভাবে কোনদিন। দুনিয়ার মজদুরকে এক হতে বললেও নিজেরাই যে এক হতে পারে না এই নিয়ে বরং ঠাট্টা করেছে বিস্তর। আর অভ্রেরও কেটে যাচ্ছিলো একরকম। নিরাপদ, নির্বিঘ্নে। মাঝেসাঝে এই ইস্যু সেই ইস্যুতে একটু নাড়াচাড়া দেয়া। এছাড়া মোটামুটি নিরুত্তাপই বলতে হয়। এরই মধ্যে এদেশের বুকে ২০১৩ এলো নেমে। মনে পড়ে আন্দোলনের কয়েক দিনেই কী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল অভ্র। একদিন মঞ্চে একটা কবিতা পড়েছিল বেশ গম্ভীর গলায়। গমগম করছিল পুরো চৌহাট্টা :
আমি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ
তোমরা সংসদ ছেড়ে চলে যাও
...............................................
................................................
তোমাদের হেগেল রবীন্দ্রনাথ দাও
আমার বর্ণপরিচয় লাগবে।
তোমাদের অস্ত্রগুলো দাও
আমার কোদাল,শাবল লাগবে।
তোমাদের মন্ত্রণালয়গুলো দাও
আমার গোয়াল লাগবে।
লাবণ্য মুগ্ধ হয়ে শোনে। পুরনো মানুষের মধ্যে এত নতুনত্ব থাকতে পারে? এরপর একেকটা দিন যেন লাবণ্যকে আরো অভ্রমুখী করে তোলে। ছেলেটা কী ম্যাজিক ট্যাজিক জানে? একদিন সম্মেলন উপলক্ষে চাঁদা তুলতে পার্টির সাথে শ্রীমঙ্গল যায় অভ্র। লাবণ্যও যায় সাথে। ট্রেনে কত কথা! সমাজ, রাজনীতি নিয়ে কোনদিনই লাবণ্য মাথা ঘামায়নি। এখন এই অভ্র, ঘাড়ে চেপে বসা সিন্দাবাদের এই ভূত, তাকে রাজনীতি সমাজ রাষ্ট্র নিয়ে অনর্গল জ্ঞান দিতে থাকে। সেসব কী আর লাবণ্য বুঝতে চায়? তবুও সে অভ্রের কথা, অভ্রের আঙ্গুল নাড়ানো, ভ্রু এর নাচন সব খেয়াল করে। অভ্রের জন্য মায়ায় তার চোখে জল আসে। পুরো দেশটাকে বদলাতে চায় অভ্র। বিপ্লব করতে চায়। লাবণ্যের বিপ্লব অভ্র ছাড়া আর কী হতে পারে?
এ ভ্রমণ আর কিছুই নয় শুধু তোমার কাছে যাওয়া
আমি তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভেতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন তুই শুদ্ধ হ, শুদ্ধ হবো কালিমা রাখবো না!
এই কবিতাটা কি যে সুন্দর করে আবৃত্তি করে অভ্র! লাবণ্য নিজেও কি কম সুন্দর গান করে নাকি? আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে কিংবা বেণীমাধব তার মত এত দরদ দিয়ে কে-ই বা গাইতে পারে?
ততদিনে আন্দোলনটা স্তিমিত হয়ে গেছে। অনেকে বলে রাষ্ট্রের পকেটস্থ হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো এও বলে যে, এটা শুরু থেকেই রাষ্ট্রের পকেটে ছিল। কালে কালে সে ধারণা যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি তা হলফ করে বলা যায়না। তবুও শাহবাগ চৌহাট্টার স্বাধীনতাই শাহবাগ চৌহাট্টার পথ। সেই স্বাধীনতাই, মুক্তিমুখীনতাই হয়তো আবার কখনো বাংলাদেশের মানুষকে পথ দেখাবে।
খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। বিকালে বেরিয়ে টুকটাক শপিং শেষ করে যখন হলে ফিরবে লাবণ্য তখনই শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি, সাথে ঝড়। টানা দুইঘন্টা বৃষ্টি হলো। ততক্ষণে রাত ১১ টা বাজে। সেরেছে! লাবণ্য হলে ঢুকবে কী করে? রাত ৯ টার মধ্যে হলে না ঢুকলে আর ঢোকার সুযোগ নেই। প্রভোস্ট যথেষ্ট কড়া। একদিন এক মেয়েকে এমন কথা বললেন যে মেয়েটা কেঁদেকেটে অস্থির। বলেন কিনা, তোমাদের মত মেয়েরা টিউশনের নাম করে কোথায় যাও কী করো তা আমার জানা আছে। এখন হলে গেলে দারোয়ান ঢুকতে দিবে না। প্রভোস্টকে ফোন দিবে। প্রভোস্ট নির্ঘাত বাসায় ফোন দিবে। লাবণ্য বিকালের পর বাইরে থাকতে পারে এটা তার মা কিছুতেই চিন্তা করতে পারেন না। টেনশন, টেনশন! কী করা যায়? এইসব জটিল মুহুর্তে লাবণ্য ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে-ই বললো, "এক কাজ করি না কেন? তুই না বললি তোর রুমমেট বাড়িতে গেছে। চল তোর ওখানেই যাই। নিশ্চিন্তে রাতটা পার করে কাল হলে ফিরবো"।
অভ্র আপত্তি করে না। লাবণ্য ভাবে অভ্র থাকতে তার এত চিন্তা কিসের? একটা রাতেরই তো ব্যাপার। আর ঘুম হলে তো ঘুম, ঘুম না হলে অভ্রের সাথে সারারাত চুটিয়ে গল্প করা যাবে। অভ্র কখনো তাকে অনাহুত স্পর্শ পর্যন্ত করেনি, বরং রিকশা অটোতে লাবণ্যই অভ্রকে মিনিমাম একটু ছুঁয়ে না রাখলে স্বস্তি পায় না, সেই অভ্রের মেসে যেতে তাকে ভাবতে হবে কেন? যেতে যেতেও ঝুম বৃষ্টি। দুজনেই ভিজে কাক। কোনরকমে মেসে পৌঁছানো গেল। ভিজে চুপসে যাওয়া অবস্থা। অভ্র তার একটা পাঞ্জাবি দেয় লাবণ্যকে। কাপড় চেঞ্জ না করলে ঠান্ডা জ্বর এসে যাবে। চেঞ্জ করে তারা দুজনে খেতে বসে। রেস্টুরেন্ট থেকে আনা সর্ষে ইলিশ, মুরগির রোস্ট আর গরম ভাত। খুব আহামরি কোন রান্না না। তবুও সেটাও কি যে স্বাদের লাগে! দুজন দুজনকে খাইয়ে দেয়। লাবণ্যের মনে হয় গল্প উপন্যাসের প্রেমিকারাও কি তার চেয়ে বেশি সুখী?
বৃষ্টির রাত। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। লাবণ্যের মনে হয় এই বৃষ্টি পড়তে থাকুক, এই বৃষ্টি না থামুক। অভ্র তাকে একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়:
কে কোথায় শোবে এই নিয়ে
মনুষ্যসমাজে বহু ঝামেলা রয়েছে।
দুটি ছেলে একসঙ্গে শুলে-একরকম মানে
দুটি মেয়ে একসঙ্গে শুলে- একরকম মানে
একটি মেয়ে একটি ছেলে একসঙ্গে শুলে-একরকম মানে
দুটি ছেলে দুটি মেয়ে অর্থাৎ চারজন একসঙ্গে শুলে
আমরা বলি- গেল,সব গেল।
বর্ষার রাতে মা ও বাবার মাঝখানে ছেলে ঘুমিয়ে আছে
বর্ষার রাতে মা ও বাবার মাঝখানে মেয়ে ঘুমিয়ে আছে
বর্ষার রাত, আহা এমন রাত জীবনে ক'টাই বা আমরা পেলাম!
দুই ভাই একসঙ্গে শুতে পারে, কিন্তু কতদিন?
চল্লিশ বছর বয়সেও দুটি ধেড়ে চিরকুমার একসঙ্গে শুতে থাকলে
খুব কি ভালো দেখায়?
তার মানে তিরিশ বছর হয়ে গেলে
মানুষের শোয়ার একটা সমস্যা দেখা দেয়!
দুঃখী মায়ের সঙ্গে শুয়ে থাকা যায় না
দুঃখী বোনের সঙ্গে শুয়ে থাকা যায় না
দুঃখী বাবার সঙ্গে শুয়ে থাকা যায় না
বউ থাকলে বউয়ের সঙ্গে শুয়ে থাকা যায়
কিন্তু বউ থাকলে তো আর সারারাত একা শুয়ে থাকা যায় না!
সেটা একটা জঘন্য ব্যাপার।
সুতরাং হে মানুষ তুমি তো আর পাখি নও
শোয়া নিয়ে তোমাকে ভাবতেই হবে
এক: কোথায় শোবে?
দুই: কার সঙ্গে শোবে?
তিন: কীভাবে শোবে?
তবে একটা কথা, একজোড়া মানুষ যদি কোথাও শুতে চায়
কার বাপের ক্ষমতা তাকে আটকায়?
.........................
হ্যাঁ, ঠিকই তো। দুজন মানুষ পরস্পরের সাথে শুতে চাইলে কার বাপের ক্ষমতা তাদের আটকায়? এমন বৃষ্টির রাতই বা ক'টা আসে মানুষের জীবনে? লাবণ্য তার অভ্রের কাছাকাছি যাবে, অভ্রকে প্রাণভরে স্পর্শ করবে এতে দোষের কী? অভ্রের বাবা মা পর্যন্ত অভ্রকে মানুষ করার দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিয়েছে। মা খেয়াল রেখো তো ঠিকমত ক্লাসে যায় কিনা,খায় কিনা, নখ কাটে কিনা, কাপড় ধোয় কিনা আরো কত কী! সেই অভ্রকে এত কাছে পেয়ে সে কিনা দ্বিধার মধ্যে থাকবে? এতো হতেই পারে না।
এই একটা রাত, এই বৃষ্টির রাত এমন রাত, যে রাত আসেনি এর আগে কখনো লাবণ্যের জীবনে। এই রাত, এই বৃষ্টির রাত আর কখনো আসবে না লাবণ্যের জীবনে। যে ভ্রূণটা লাবণ্য ধারণ করেছিল, তার সূত্রপাত এই রাতে। যে ভ্রূণটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল, যে ভ্রূণটা পৃথিবীর মুখ দেখেনি। যাকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর জন্য লাবণ্য প্রয়োজনে পুরো পৃথিবীর সাথেই যুদ্ধ করতে পারতো, সেই ভ্রূণটা আপনা আপনিই ঝরে গেল? ভ্রূণটা জানেনা ভ্রূণ নামেই সে মূর্ত এক অস্তিত্ব হয়ে আছে লাবণ্যের জীবনে। লাবণ্য তাকে দেখতে পায়, তার ঈষৎ হাসি শুনতে পায়। ডাক্তার বলেছিল এগুলো নাকি মিসক্যারেজের ট্রমা থেকে উৎসারিত ভিজুয়াল আর অডিটরি হেলুসিনেশন। শুনে লাবণ্য হেসেছিল। সবকিছু কি আর শাস্ত্র মোতাবেক ব্যাখ্যা করা চলে ডাক্তার সাহেব? যে ভ্রূণ তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই ভ্রূণ যদি তার মনের পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ায় কোন শাস্ত্রের ক্ষমতা আছে তাকে অস্বীকার করে?
কিন্তু অভ্র কেন এমন হয়ে গেল সেই রাতের পর থেকেই? আগের মত কথা বলে না, কবিতা শোনায় না। কোথায় যেন একটা ছন্দপতন। একটা সুর কেটে গেছে। তখনও তো লাবণ্য ভ্রূণের অস্তিত্ব টের পায়নি। আর টের পেলেই বা কী? সে তো আর স্বীকৃতির কাঙ্গাল না। তাহলে? জিজ্ঞেস করলেই কেমন যেন রেগে যেতো অভ্র। কী হলো তার অভ্রের? এরই মধ্যে অভ্রের এক বড় ভাই একদিন বললেন অভ্রকে নাকি কোন মেয়ের সাথে দেখেছেন। শুনে এমন রাগ হয় লাবণ্যের। না হয় ছিল কোন মেয়ের সাথে, তাতেই কী প্রমাণ হয়? আশ্চর্য সব মানুষ! জল ঘোলা করতে পারলেই এদের শান্তি। কিন্তু সেদিন কেন আরেকটা মেয়ে তাকে ফোন করে দেখা করতে চায়? লাবণ্য মেয়েটার সাথে দেখা করে, তার কথা শুনে যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এসব কী বলছে মেয়েটা? অভ্র নাকি তাকে ভালোবাসে! মেয়েটা লাবণ্যের কথা জানতো বলে দেখা করতে এসেছে। এভাবে আরো একটা, তারপর আরো একটা, তারপর আরো একটা মেয়ের কথা জানা যায়। লাবণ্যের নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রাতের পর রাতে সে নির্ঘুম পার করে। তার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে। ক্লাস পরীক্ষা সব শিকায় ওঠে। তার অভ্র আসলেই এতগুলো মেয়েকে ভালোবাসার কথা বলেছে? যাকে লাবণ্য নিজেরই আরেকটা অংশ মনে করতো সেই অভ্র? অভ্র সব গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু লাবণ্যের সাথে দেখাও করে না। এমনও হয়েছে লাবণ্য একপাতা টেনিল খেয়ে ফেলেছে একদিনে। দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে লাবণ্যকে বিধ্বস্ত দেখায়। লাবণ্যের ওজন কমে যায়। একদিন তার বান্ধবীরা জোর করে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সেদিনই প্রথম সেই ভ্রূণের কথা জানা যায়। এত কষ্টের মধ্যেও লাবণ্য স্বস্তি পায়। কিন্তু বান্ধবীরা ছি ছি করে দূরে সরে যায়। গেলে যাক। এই সংগ্রামটা লাবণ্যের একা। সে একাই লড়বে। কাউকে লাগবে না তার।
দরোজা খুলতেই মা দাঁড়িয়ে। মার দিকে তাকাতে পারে না লাবণ্য। মনে হয় মা তার ভিতরের জমে থাকা সমস্ত গোপন অনুভূতি টের পাচ্ছেন। মার দিকে তাকাতে পারে না লাবণ্য। এই মা শুধুমাত্র তার জন্য তার বাপ নামের পুরুষটার সাথে আপোষ করেনি। মা আর গর্ভধারণ করতে পারবে না বলে তার বাপ বংশ রক্ষার তাগিদে, একটা ছেলের জন্য ঘরে আরেকটা মেয়েমানুষ এনেছিল। মা মুখ বুজে মেনে নেয়নি। মুখ বুজে মেনে নিলে সংসারটা করে যেতে পারতো কোনরকমে। কিন্তু লাবণ্যকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবে এই পণ করে মা ঘর ছেড়ে লাবণ্যকে নিয়ে নতুন ঘর বেঁধেছিল। লাবণ্যকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছে। পূর্ণ যৌবনা একজন নারী একা থাকার কি যে সংগ্রাম! এই সুবিধা সেই সুবিধা দেয়ার নাম করে কত লোক যে কাছে ভিড়তে চেয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। ঘরে যার বউ আছে সেই লোকও বছর দশেক অন্য লোকের ঘর করে আসা নারীর প্রতি এতটা আকর্ষণ বোধ করে কেন? বড় হয়ে লাবণ্য এসব ভাবে আর মাকে ঋষি মনে হয় তার। চাইলেই কি মা পারতো না এর ওর কাছে ধর্ণা দিতে? সময় ছিল, সুযোগ ছিল, পর্যাপ্ত আহবান ছিল তবুও মা এসব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষের খাই খাই স্বভাব বাড়ে, নারীর বাড়ে অভিজ্ঞতা। যে মা তার জন্য এত কষ্ট স্বীকার করেছে, নিজের শরীরের আকুতিকে মোটেও আমলে নেয়নি, তাকে কী প্রতিদান দিতে পেরেছে লাবণ্য? শেষমেষ সে কিনা গোপনে বিয়ে করে ফেললো? তাও চেনা নাই, জানা নাই এমন একটা ছেলেকে? মা তো মা-ই, নিজের মুখোমুখিই হতে পারে না লাবণ্য। গত রাতে বাসে পুরোটা সময় অভ্র আর তার পরম আদরের ভ্রূণের কথা ভেবেছে লাবণ্য। অভ্র একটা খুনী। সে যদি অন্তত তার পাশে থাকতো সেই পুরোটা সময় তাহলে তার ভ্রূণটা অস্তিত্ব হয়ে উঠতো। দিনের পর দিন যোগাযোগহীন থেকেছে অভ্র। এই মানসিক যন্ত্রণা, চাপে যদি গর্ভপাত হয় লাবণ্যের, রক্তে ভেসে যায় যদি তার হলের ঘর দুয়ার, সেই দোষ কার তবে? অভ্র কেন খুনী হবে না? অভ্র খুনী, সে ভ্রূণটাকে মেরে ফেলেছে।
আরেকটা নতুন মানুষ। সম্পর্কের ভ্রূণ। লাবণ্যরা কি কুড়ে কুড়ে মরতেই জন্মায়? ঝোঁক আর ঘোরের বশে, একটা খসখসে সিগনেচার আর কিছু দোয়া দরুদের বদৌলতে যে লোকটা এখন থেকে লাবণ্যের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকার পাবে, সেই লোকটা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না লাবণ্য। যখন জানবে তন্ময় নামের এই লোকটা একসময় অন্য পুরুষের সাথে ঘোরার কারণে তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে জুতো পেটা করেছিল, যখন জানতে পারবে লোকটা মাদকাসক্ত, পয়সার বিনিময়ে মেয়েদের অন্য লোকের কাছে তুলে দেয় বলে জনশ্রুতি আছে, তখন পুনর্বার তার অস্তিত্ব ভেঙ্গে পড়বে। কিংবা কে জানে! লোকটা হয়তো পাল্টে যেতেও পারে।
চিরতরে সুপ্ত একটা ভ্রূণ হৃদয়ে লালন করে যে যন্ত্রণা সইতে হয় লাবণ্যকে, তার মধ্যে আরেকটা সুখী অথবা অসুখী সম্পর্কের সম্ভাবনা ভ্রূণ অবস্থায় লাবণ্যের সম্মুখে হাজির। লাবণ্য বিড়বিড় করে, কী এসে যায় যদি কিছু ঘটে, কী এসে যায় কিছু ঘটলে......
জীবন কখন এতটা নির্লিপ্তি, নির্বিকারত্ব এনে দেয়?