ছোটগল্প: শিরোনামহীন
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০১৭, ০১:১৪
বোকা কাকটি জানে না যে বৃষ্টিটা তার জন্য নয়। তবুও তার বৃষ্টির জলে স্নান হয়ে যায়। তেমনি বোকা মেয়েটিও জানে না বৃষ্টিটা তার জন্য নয়। তবুও... তবুও বৃষ্টির জলে তারও স্নান হয়ে যায়। রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়ি। সারি সারি দোকানপাট। এই বৃষ্টিস্নাত সকালে দোকানিরা একটু আলসেমির চাদর জড়িয়ে সারি সারি বাড়িতে নরম বিছানায় গা গড়িয়ে নিচ্ছে হয়তবা তখনো। আর সানা আজিম তখন বন্ধ দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে। সে হেঁটে চলেছে। কখনো খেয়ালে। কখনো বেখেয়ালে। আজ তার ভিতরেও নানা মেঘের আনাগোনা। কবিতায় বলে- ঝর্ণা নাকি ঝর্ণা নয়, পাহাড়ের কান্না। বৃষ্টি নাকি বৃষ্টি নয়, আকাশের কান্না। তবে কি তার ভিতরকার মেঘের ঝর ঝর ঝরে পড়া বৃষ্টি কি বৃষ্টি নয়, শুধুই কান্না? তার মর্মতলের বরফ গলা নদী কি নদী নয়, শুধুই কান্নার ঢেউ?
রাস্তায় কিছু কিছু লোক সমাগম শুরু হয়ে গেছে। লাল-কাল-সবুজ-নীল ছাতার নিচে মুখ ও মুখোশেরা ঢাকা পড়ে আছে। ব্যতিক্রম কেবল সানা আজিম। হ্যা, সানা আজিম বৃষ্টিময় উন্মুক্ত আকাশের নিচে মুক্ত মানুষের মত হেঁটে চলেছে। ছাতাবিহীন। সদ্য দোকান খুলে বসা দোকানী আর ছাতায় ঢাকা কৌতূহলী মুখগুলো তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। সবাই অবাক হয়ে দেখছে। সানা বুঝছে সবার দৃষ্টি তার হাতে ধরা ছাতাটির দিকেই। সে পরোয়া করে না কাউকে। পরোয়া করবে না কাউকে। সবাই তাকে পাগল ভাবছে? ভাবুক। পাগল নয় কে? বড় বড় লম্বা চুলো দার্শনিকরা তাহলে কেন বলে এ পৃথিবীটা পাগলেরই কারখানা? সে কিছুই ভাবছে না। কিছুই দেখছে না। সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কেবল তার সামনে- সামনে হেঁটে যাওয়া এক নারীকে ছাড়া। খালি মাথা। খালি পা। কোলে কালো পলিথিনে মোড়ানো এক শিশু।
তমমীর কথা মনে পড়ে গেল। তার তমমী। তার হারিয়ে যাওয়া তমমী। হ্যালো কিটি ছাতা, বারবি ডল খেলনা, মিফি পুতুল, স্নোপি জুতা, মিকি মাউস জামা, চিপ এন্ড ডেল রেইনকোট আর এক রাশ ভালোবাসা। সবইতো তমমীর জন্য। তবুও তমমী হারিয়ে যায়। সে যেন আজ রবিঠাকুরের বামির মত ঐ দূর আকাশ থেকে যেন বলছে ”হারিয়ে গেছি আমি”। হেঁটে চলেছে সে। হেঁটে চলেছে তার সামনে- সামনে বৃষ্টিভেজা আরেক নারী। এবার সে সত্যি সত্যিই অবাক হল। যে লোকগুলো এতক্ষণ তাকে আদ্যোপান্ত লক্ষ্য করে চলেছে, মুখ টিপে টিপে হেসেছে, তাদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া গেল না যারা অন্য সেই একজনকেও ঘুরে ঘুরে দেখছে। কারণ সে জানে, একজন অনন্যোপায় বৃষ্টিভেজা নারীকে কেউ লক্ষ্য করবে, এমন কাউকে পাওয়া যায় না। দারিদ্র্য এখন সবার কাছে গা সওয়া ব্যপার। এ দেশের রাস্তায় রাস্তায় দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত অর্ধনগ্ন অনাহারী মানুষের মিছিল। অপুষ্টিতে ভোগা নগ্ন পায়ে হেঁটে চলা হাজারো শিশুর মিছিল। সব কিছুই এখন গা সওয়া ব্যাপার। কেবল সানা আজিমের বৃষ্টিতে ভিজে চলাটাই গা সওয়া হতে পারল না এই ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগেও। সে হাত বাড়িয়ে ছাতাটা কালো পলিথিনে জড়ানো শিশু কোলে নারীটির দিকে বাড়িয়ে দিতে গেল। পারল না দিতে। চিন্তায় মগ্ন সানাকে ফেলে সে যে চলে গেছে বহু দূর!
হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুটা সময়। আর সানা আজিম মাড়িয়ে এসেছে বেশ কিছুটা কাদা মাখা পথ। আজ তার পথের ক্লান্তি নেই। হাঁটায় গ্লানি নেই। আজ সে জীবনের যত দু;খ, বেদনা, গ্লানি ক্ষোভ-হতাশা-দুরাশা পথে পথে ছড়িয়ে দিতে চায়। মুক্ত হতে চায় নৈঃশব্দ্যর নিভৃত কান্নার আগল থেকে। আজ তার যত গ্লানি যত ক্ষোভ ওই ইঁদুর-ধুসর রঙা মেঘে ঢাকা আকাশটার উপর। আকাশটা আজ বড় বেশি ছিচ কাঁদুনে। অথচ আজ সে ঝর ঝর ঝর অঝোর ঝরে কান্নার আকাশের সৌন্দর্যে সে একাকার হতে চেয়েছে। আজ সে বৃষ্টির কান্নার সাথে একাত্ম হয়ে লুকোতে চেয়েছে তার একান্ত গোপন কান্নার অশ্রুবিন্দুগুলো। সে কান্না লুকোতে চেয়েছে পৃথিবীর কাছ থেকে। কান্না লুকোতে চেয়েছে নিজের কাছ থেকে। কান্না লুকোতে চেয়েছে সবার কাছে, আবিরের কাছে (তার কান্নার দাম সে পাবে কি? পেয়েছে কি কখনো কারো কাছে?)। সে কান্না দিয়ে কান্না লুকোনোর এ ভয়ানক লুকোচুরি খেলায় পেরে উঠছে না। পারছে না। কারণ আবেগ বিবর্জিত আকাশটা আজ অঝোর ধারায় কাঁদতেই ভুলে গেছে।
হঠাৎ সে তার অ্যাডরেনাল গ্লান্ডে এপিনেফ্রিন হরমোনের উপস্থিতি টের পায়। বিদ্যুত খেলে যায় মস্তিস্কের প্রতিটি শিরায় শিরায়। আর তাতেই হাতে ধরা ছাতাটা নিমেষেই চূর্ণ বিচূর্ণ। তাতে তার ক্ষোভ বাড়ল ছাড়া কমলো না। একটা অপরাধবোধ যুক্ত হলো তার বোধের সাথে। সে তো অক্ষত অখণ্ড ছাতাটাই রাস্তায় ফেলে দিতে পারত। তাতে অন্তত কোন না কোন অভাগার কাজে লাগত। নাথুরাম গডসে বাপুজীকে কখনো সরি বলেছিলো কিনা জানে না। তবে সে মনে মনে বলতে লাগল সরি। সে হাঁটতে হাঁটতে বলল সরি।
একবার বাপুজী ট্রেনে উঠার সময় তার পা থেকে এক পাটি জুতা খুলে পড়ে গেল। তিনি অন্য পাটিটাও ফেলে দিলেন। বললেন একপাটি জুতা দিয়ে কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না। সুতরাং পড়ে যাওয়া জুতার সাথে অন্য জুতাটাও ফেলে গেলেন। যাতে জুতাটার সদ্ব্যবহার হয়। সানা আজিম আবার বলল মনে মনে, সরি, চাইলেই কেউ বাপুজী হতে পারে না, চাইলেই কেউ লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প হতে পারে না। কিন্ত এই ঝিরঝির বৃষ্টিভেজা সকালে ম্যান উইথ দ্য আমব্রেলার অভাব হলো না। এক মজদুর শ্রেণীর যুবক এসে তার মাথায় একটা অর্ধভঙ্গুর ছাতা ধরে বলল, কোথায় যাবেন? একটা সিএনজি ডেকে দিই? সিএনজি চালক অনেকটা সহানুভূতির সুরে বলতে লাগল ছাতা ছাড়া এমন সময়ে কেউ বাইরে বের হয়? অচেনা অজানা মানুষদের টুকরো টুকরো সহানুভূতির আভরণগুলো পেছনে ফেলে সে এগিয়ে চলেছে দূর থেকে দূর পানে।
আমার হিমগৃহ হিমের কুন্তল ছড়িয়ে নিঃঝুম
চোখের ঢালু কোলে শীর্ণ জলরেখা চিবুকে নেমে আসে-
যে-ব্যথা ঢেকে রাখো গোপনে, মাথা পেতে সে-বুকে নিঃঝুম
তোমার কালো নদী চিবুকে ক্ষত ঢেলে সে-বুকে নেমে আসে।
সুদূর হিমগৃহ, আমার আমরণ তোমাকে ঢেকে থাক।