প্রকৃতি রক্ষার শপথে উদীচী’র বর্ষা উৎসব উদযাপিত
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০১৬, ০০:২২
প্রকৃতি রক্ষার শপথ নিয়ে বর্ষা উৎসব উদযাপন করলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আষাঢ়ের প্রথম দিন (১৫ জুন) বুধবার সকাল ৭টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ঢাকা মহানগর সংসদ আয়োজন করে বর্ষা উৎসব-১৪২৩।
সকালে অনুষ্ঠান শুরু হয় যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। আবহমান কাল ধরে বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ঢোল, তবলা, দোতরা, বাঁশি প্রভৃতি যন্ত্রের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয় “আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই” গানটি। এরপর শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন গুণী শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। সকালের শুভ্র প্রকৃতিতে প্রিয়াঙ্কার অনবদ্য গায়কীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে অসাধারণ আবহ তৈরি হয়।
প্রিয়াঙ্কা গোপের পর মঞ্চে দলীয় পরিবেশনা নিয়ে উপস্থিত হয় উদীচী ধানমন্ডি শাখা। উৎসবে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন অগ্নিবীণা ও ফোক বাংলা’র শিল্পীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশনে ছিলেন দেশের প্রথিতযশা শিল্পী মহাদেব ঘোষ, অনিমা মুক্তি গোমেজ, বুলবুল ইসলাম, বিমান বিশ্বাস, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী, জিনাত ফেরদৌস, নৃপেন মিস্ত্রী, সাজেদা বেগম সাজু, শেলী রউফ প্রমূখ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বেলায়েত হোসেন, শিখা সেন গুপ্তা প্রমূখ। এছাড়া, নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যম ও স্পন্দন-এর মতো নৃত্যদল।
বর্ষা উৎসবে মাহমুদ সেলিমের গ্রন্থনা ও নির্দেশনা এবং বিপ্লব রায়হানের পরিচালনায় বিশেষ গীতি-আলেখ্য “বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর” পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এছাড়াও, ছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর মিরপুর, বাড্ডা, তুরাগ, কাফরুল ও নবাবগঞ্জ শাখার শিল্পীদের পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের গান, কবিতা এবং লোকগানের পরিবেশনায় মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। প্রথা অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবেশনা শেষে শিল্পী এবং দলগুলোকে উদীচীর পক্ষ থেকে গাছ উপহার দেয়া হয়। প্রকৃতি রক্ষার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বর্ষা উৎসব আয়োজনের শুরু থেকেই অতিথিদের গাছ উপহার দিয়ে আসছে উদীচী।
অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি পর্যায়ে আয়োজিত হয় বর্ষা কথন। এতে অংশ নেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী, সহ-সভাপতি শংকর সাওজাল এবং উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান ইকবাল। আর উদীচীর পক্ষ থেকে বর্ষার ঘোষণা পাঠ করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সহ-সভাপতি ও বর্ষা উৎসব-১৪২৩ প্রস্তুতি পরিষদের আহবায়ক নিবাস দে। এ সময় উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী বলেন, শুধু শহুরে মানুষই নয়, গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের কাছে বর্ষার যে চিত্র তা সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা উদীচী’র বর্ষা উৎসব আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
অন্য বক্তারা বলেন, শহরের মানুষের কাছে যে বর্ষা প্রেমময়, রোমাঞ্চকর- সেই একই বর্ষা কোন কোন সময়ে মেহনতী মানুষের কাছে অসীম দুর্ভোগ আর দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে। আবার, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বর্ষা ও বৃষ্টিপাতের যে গুরুত্ব তা-ও অনেক সময় আমরা অনুধাবন করতে পারি না। তাঁরা আরো বলেন, তৃষিত হৃদয়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে রুক্ষ শুস্ক প্রকৃতিতে সবুজের ছোঁয়া দিতে বর্ষা সমাগত। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখর ঝিরঝির বারিধারায় তাকে শান্ত করে ষড়ঋতুর অন্যতম সৌন্দর্য্যমন্ডিত ও প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরপুর বর্ষা। বাঙালির প্রাণের এই ঋতুকে স্বাগত জানাতে প্রতিবছরই উদীচী আয়োজন করে বর্ষা উৎসব।
বর্ষা উৎসবের ঘোষণা ১৪২৩
বর্ষা বাঙালির প্রিয় ঋতু। বাংলা, বাঙালি এবং বর্ষার মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ঋতু পরিক্রমায় বর্ষা এসে সজীবতায় ভরে তোলে জীবন ও প্রকৃতি। গ্রীষ্মের অগ্নি-ঝরা দাবদাহ যখন প্রকৃতিকে করে বিবর্ণ, শুষ্ক এবং জনজীবন করে তোলে অসহনীয় তখনই রিমঝিম বৃষ্টিধারা প্রকৃতিকে করে সজীব। আকাশে মেঘের ঘনঘটা কৃষককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, তার চোখের তারায় ওঠে খুশির ঝিলিক। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকসমাজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে বৃষ্টির জন্য। বর্ষার প্রবল জলধারা মাটিকে করে সিক্ত। মাঠে মাঠে শস্য বোনার উৎসব শুরু হয়।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতি এবং মানুষের সম্পর্ক তাই বন্ধুত্বের। স্বাভাবিক ঋতু পরিক্রমা নির্ভর করে স্বাভাবিক প্রতিবেশের ওপর। কিন্তু পুঁজিপতি শ্রেণির সীমাহীন মুনাফালিপ্সা, রাষ্ট্রের দুর্বল এবং মুনাফাবান্ধব পরিকল্পনা ব্যবস্থা ও সাধারণ জনগণের অসচেতনতার কারণে প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত। বনজঙ্গল উজাড় করা, বাণিজ্যিকভাবে বিদেশি গাছের বনায়ন, হাইব্রিড চাষাবাদ, পরিবেশ বিরোধী শিল্পের প্রসার, নদী দখল, অভিন্ন নদীসমূহে পাশ্ববর্তী দেশসমূহের আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে বাধ দেয়ার ফলে নদীনালা, খালবিল স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চলতে পারছে না। ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরের অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, অনাবৃষ্টি, অসময়ে অতিবৃষ্টি ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে পাহাড় ধ্বস, বন্যা-প্লাবন ইত্যাদি। পরিবেশবিদরা আশংকা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে স্বাভাবিক জলপ্রবাহের অনুপস্থিতিতে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬০ ভাগ অঞ্চল মরুভূমি হয়ে যেতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে চরম খাদ্য সংকট। যার নিদর্শন আমরা সম্প্রতি বান্দরবানের থানচিতে লক্ষ্য করলাম। এখনো থানচির মানুষ সীমাহীন খাদ্য ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি আমরা আরো লক্ষ্য করেছি যে, বজ্রপাতে সারাদেশে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়া, রাষ্ট্রের দুর্বল পরিকল্পনা কারণে বর্ষার সময়ে জলাবদ্ধতা এবং বন্যার ফলে বর্ষা নাগরিক জীবনে আশীর্বাদের পরিবর্তে দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। মানবসৃষ্ট কারণে প্রকৃতি আজ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন দানা বাঁধছে দুনিয়ার দেশে দেশে। উদীচী মনে করে সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। আর তাই বর্ষা উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা এই আন্দোলনকে আরো বলিষ্ঠ করার আহবান জানাই।
বর্ষা বাঙালির জীবনে উৎসবেরও ঋতু। নৌকা বাইচ, সাঁতার প্রতিযোগিতা, কাদামাটি খেলা এ সব মিলেই বর্ষা উৎসব; যা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ। ঋতুভিত্তিক পালা-পার্বন, খেলাধুলা এবং উৎসব আয়োজনে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি-আদিবাসীসহ সকল ভাষাভাষি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ছিল তাও আজ ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভুলুণ্ঠিত প্রায়। এ সকল উৎসব আয়োজনও আজ গ্রাস করে ফেলছে বহুজাতিক পুঁজি। উৎসব তার স্বাভাবিক প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে। অসাম্প্রদায়িক আয়োজনসমূহ সম্প্রদায়িকতার আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে। সাধারণের মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। ফলে দেশের তরুণ সমাজ ধর্মের নামে এসব জঙ্গীগোষ্ঠীর রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। জাতিকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অসাম্প্রদায়িক প্রাণের উৎসবসমূহকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে সামাজিক পুণর্জাগরণ ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ জন্মলগ্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক লোকজ উৎসবকে সারাদেশে বিস্তৃত করতে বদ্ধপরিকর। তাই বর্ষা উৎসবকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য উদীচী সকল প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী ও দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছে।