হত্যা ও আশা হতাশার উপাখ্যান
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:১৩
(এক)
-চলো কিছু খাই
-কি বলো ঋক? মাত্রই তো খেলাম
-আরে কই? এক ঘন্টা হয়ে গেছে। তাছাড়া মুভি শুরু হতে আরো আধা ঘন্টা বাকি। চলো খেয়ে নেই।
-মোটেও না। এখন আর ভারী কিছু খেতে হবে না। চলো ওখানে বসে বড়জোড় দু’জন দুইটা আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করি। তাতেই সময় কেটে যাবে।
অপা জোর করেই ঋককে বসিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসে। দুজন বসে আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করার কথা। কিন্তু ঋক একদম চুপ।
-কি ব্যাপার বলো তো? তোমার কি আমার সাথে ভাল্লাগছে না?
-না তা না
-তাহলে কি? কি ভাবছো?
-আসলে ক’দিন ধরে মাথা থেকে অভিজিতদা’র ব্যাপারটা কিছুতেই যাচ্ছে না। জানি না কেন, সবসময় শুধু অভিজিৎদাই মাথার ভেতর ঘুরছে। অজয় স্যারের কথা মনে পড়ছে।
-হুম… (নীরবতা)
অপা আর ঋক এর মাঝে মুহুর্তেই নীরবতার মতো মন খারাপ নেমে আসে। আইসক্রিম খেতে খেতে তাদের গল্প করার কথা ছিল, তারা সেটা ভুলেই গেলো।
(দুই)
আস্তে করে উঠে অপার মুখের দিকে তাকালো ঋক। এসময় অপার মুখে একটা তৃপ্তির ছাপ পড়ে যা দেখতে তার ভালো লাগে। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ অপার চোখেমুখে সেই তৃপ্তির ছোঁয়া নেই কেন? কি ভাবছে অপা?
-কি হলো? তোমার হয়নি বুঝি?
-না হয়েছে তো
-ভালো লাগেনি আজ?
-ধুর কি যে বলো! আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি
বাথরুম থেকে ফিরে অপা কম্বলটা টেনে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। যদিও মাঘের শেষ, তবু শেষ রাতে একটু একটু ঠান্ডা লাগে। ঋক কি বলবে বুঝতে পারছিল না। সবসময়ই এই মুহুর্তটায় তারা অনেকক্ষণ জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। কিন্তু আজ অপার মন কোথায়?
-অপা?
-বলো
-কি হলো তোমার? আদর করার পর তুমি এমন পর পর হয়ে যাও কেন?
-কিছু না ঘুমাও
-কিছু তো হয়েছে। কি জানি ভাবছো। তোমার কি খারাপ লেগেছে কিছু?
-আসলে…
অপা বলবে কি না এক মুহুর্ত ভাবলো মনে হয়। তারপর আবার বললো, দুম করে মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো বন্যাদির লেখাটা খেলে গেলো। বন্যাদি লিখেছে গতবছর তারা একদিন আগেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করেছিল। কারণ পরদিন তারা দেশে আসার জন্য রওনা হলো। তখনো তিনি জানতেন না তার হাতে মাত্র আর অল্প ক’দিন সময় আছে। কি অদ্ভুত তাই না? মানুষটা আর নেই! মেরেই ফেললো?
ঋক আর কোন কথা খুঁজে পায় না। আসলেই! মানুষটা আর নেই! আরেকজন অভিজিৎ কি হবে কখনো এই দেশে? ঋক আর অপার জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকার কথা ছিল। অথচ তারা একে অপরের চোখের দিকে হতবিহ্বলভাবে তাকিয়ে অভিজিৎ রায় আর বন্যা আহমেদ এর কথা ভাবতে লাগলো।
(তিন)
অপা ইনসমনিয়ায় ভুগছে বহুদিন। কিন্তু অপার সাথে সাথে রাত জাগাটা এখন ঋকেরও অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। প্রায় সব রাতেই শেষের দিকে ঘুমুতে গেলেও কাল রাতটা দুজনেই একেবারে নির্ঘুম পার করে দিয়েছে। ভোরের আলো ফোটার মুহুর্তে ধোঁয়ার মতো প্রেম উড়িয়ে দিতে দিতে তারা জানালা দিয়ে একটা নতুন সকাল দেখতে লাগলো। হঠাত করেই তাদের মনে পড়ে গেলো আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি।
মানুষগুলো তখনো পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছিল। ‘আচ্ছা এদের ঘুম কখনো ভাঙবে না?’ অদ্ভুত এই প্রশ্ন জাগলো অপার মনে। নিজের এই অদ্ভুত চিন্তায় সে নিজেই হেসে উঠলো। সে জানে সবাই ঘুমুলেও কেউ না কেউ ঠিক জেগে থাকে।
‘এক বছর হয়ে গেলো?’ অপা ভাবলো মনে মনে। ঋকও তাই ভাবলো হয়তো, কিংবা ঐরকমই অন্যকিছু। এভাবেই প্রতিদিনের দিনলিপিতে, কারণে অকারণে খাপে বেখাপে অনন্ত, অভিজিতেরা চলে আসে অপা আর ঋকের জীবনে।
বেরোতে হবে ঋককে। অপা জানে ঋক কোথায় যাচ্ছে। চলে যাবার আগে গভীর আলিঙ্গনের পর তারা একবার একে অপরের দিকে তাকায়। সে চোখে কি ছিল? প্রেম? ভালোবাসা? বিদ্রোহ? কিংবা হয়তো সবই।
ঋকের স্লোগান শোনা যায় রাজপথে। অপা কীবোর্ড চাপতে থাকে আরো দ্রুত। চলছে লড়াই চলুক না! অভিজিৎ রায় তো নেই! কিন্তু অভিজিৎ রায় তো আছে!
(যেকোন ধর্মীয়, জাতিগত, অর্থনৈতিক শোষণ ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে জেগে উঠা বিশ্বের প্রতিটি কলম ও কণ্ঠের প্রতি উৎসর্গীকৃত)
প্রথম প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬