এসো পা বাড়াই (১২তম পর্ব)

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:৪৮

"মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত, কিন্তু কেন? ফেসবুক এর চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ (Sheryl Sandberg) এর বই 'Lean In'- এ তিনি দেখিয়েছেন এ সমস্যার মূলে কি, কিভাবে নারীরা নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে, তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে। তার নিজের জীবন এবং পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও সারা পৃথিবীর নানা পরিসংখ্যান আর গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে তিনি এই বইকে সমৃদ্ধ করেছেন সমস্ত মানব জাতির জন্য। আমার আন্তরিক ইচ্ছা বাংলাদেশের মানুষও এই বই পড়ে উপকৃত হোক। সেই ইচ্ছা থেকেই অনুবাদের এই প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই ২০টিরও অধিক ভাষায় এই বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে। এই বইয়ের নামে একটি আন্তর্জাতিক চক্রও গড়ে উঠেছে (http://leanin.org/) যেখানে সারা পৃথিবী থেকে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতে পারে। মূল বইয়ে রেফারেন্স গুলোর বিস্তারিত দেয়া আছে।"

LEAN IN                                                                 এসো পা বাড়াই
WOMEN, WORK AND THE WILL TO LEAD         নারী, কাজ এবং নেতৃত্বের ইচ্ছা
WRITER: SHERYL SANDBERG                           অনুবাদ: আফরিন জাহান হাসি

অনেকেই আমার সাথে বিতর্ক করে যে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকা সমস্যা নয়। তারা জোর দিয়ে বলে, নারীরা পুরুষের চেয়ে কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, বরং ভিন্ন এবং আরো অর্থপূর্ণ লক্ষ্যে নারীরা বেশী উদ্বুদ্ধ। আমি এই যুক্তিকে বাদ দেয়া বা এর বিপক্ষে তর্ক করছি না। কর্মজীবনে ঊর্ধ্বগমনের চেয়েও জীবনে আরো অনেক বেশি কিছু করার আছে, এর মধ্যে সন্তানকে ভালোভাবে বড় করে তোলা, ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা খোঁজা, সমাজে অবদান রাখা এবং অন্যদের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করা অন্যতম। অনেক মানুষ আছে যারা গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাদের কাজ নিয়ে, কিন্তু নিজেই সেই সংগঠনটি চালানোর জন্য উচ্চাভিলাষী নয়, উচ্চাভিলাষী হওয়াই উচিত তাও কিন্তু নয়। গভীরভাবে প্রভাব ফেলার জন্য নেতৃত্বদান-ই একমাত্র উপায় নয়।

আমি এও স্বীকার করি, নারী এবং পুরুষের মধ্যে জৈবিক পার্থক্য রয়েছে। আমি আমার দুটি সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়েছি এবং মাঝে মাঝে প্রচন্ড হতাশ হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, এই কাজের জন্য কোন কিছু দিয়েই আমার বরের শরীর সজ্জিত নয়। লিঙ্গ পার্থক্যের মধ্যে কি কোন সহজাত বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে যা নারীদের করেছে প্রতিপালনে যত্নবান আর পুরুষদেরকে করেছে দৃঢ়চেতা? খুব সম্ভবত। বর্তমান বিশ্বে, আমাদের যখন আর খাবারের প্রয়োজন মেটাতে বন্য শিকারের উপর নির্ভর করতে হয় না তখনও আমাদের নেতৃত্বের ইচ্ছা বহুলাংশেই সাংস্কৃতিক কারণেই সৃষ্ট এবং পুষ্ট। কেউ কতটুকু অর্জন করতে পারে বা করা উচিত, ব্যক্তিগত দর্শনের এই দিকটার বড় অংশই গঠিত হয় সামাজিক প্রত্যাশার চাপে।

জন্মের পর মুহূর্তেই ছেলে এবং মেয়ে শিশুদের সাথে ভিন্ন আচরণ করা হয়। ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুর সাথে বাবা-মায়ের বেশী কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়। মায়েরা ছেলেদের হামাগুড়ি দেয়ার সামর্থ্যকে বেশি প্রশংসা করে, মেয়েদের হামাগুড়ি দেয়ার সামর্থ্যকে অবমূল্যায়ন করে। এটা আসলে সেই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন যা বলে, মেয়েদেরকে ছেলেদের চেয়ে বেশী সাহায্য করতে হয় সবসময়। মায়েরা প্রায়ই অধিক সময় ব্যয় করে মেয়ে শিশুদেরকে আদর করতে, জড়িয়ে ধরে রাখতে যেখানে ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে বেশি সময় দেয় তারা কিভাবে একা একা খেলছে তাই বসে বসে দেখতে।
(এই প্রতিটা বক্তব্যই গবেষণার ফলাফল, মূল বইয়ে এরকম অসংখ্য গবেষণার রেফারেন্স দেয়া আছে)

অন্যান্য সাংস্কৃতিক বার্তা গুলো আরো ভয়ানক। জিম্বোরী (Gymboree) একবার কিছু জামা (onesie) বিক্রি করেছিল, যেখানে ছেলেদের গুলোতে “বাবার মত বুদ্ধিমান" (Smart like Daddy) এবং মেয়েদের গুলোতে “মায়েদের মত সুন্দরী" (Pretty like Mommy) লেখা প্রদর্শিত হচ্ছিল। একই বছর জে সি পেনি (J.C.Penney) একটা টি-শার্ট বাজারজাত করেছিল টিন এজ মেয়েদের জন্য যেখানে বড়াই করে লেখা ছিল “আমি এত সুন্দর যে আমার হোমওয়ার্ক করা সাজে না তাই আমার ভাইকে তা করে দিতে হয়" (I'm too pretty to do homework so my brother has to do it for me)। এগুলো ১৯৫১ সালের ঘটনা নয়, এগুলো ২০১১ সালেই ঘটেছে।

মেয়েদের প্রতি এই বার্তাগুলো দেয়ার আরো খারাপ দিক হচ্ছে, এগুলো এইসব অগভীর বৈশিষ্ট্যগুলোকে উৎসাহিত করা ছাড়িয়েও, নেতৃত্বের উদ্যমকে স্পষ্টভাবে নিরুৎসাহিত করার দিকে ধাবিত করে। যখন কোন মেয়ে নেতৃত্ব দিতে চেষ্টা করে, প্রায়ই তাকে কর্তৃত্বপরায়ন (bossy) বলে আখ্যা দেয়া হয়। ছেলেদের কদাচিৎ bossy বলা হয় কারণ একটা ছেলে বসের ভূমিকা নেয়াটা কোন বিস্ময়কর বা অন্যায় কিছু নয়। যারা এই নামে অভিহিত তাদের একজন হিসেবে, যেহেতু আমার শৈশবের অনেকটা সময় আমাকে এভাবে বলা হতো, আমি জানি এটা কোন প্রশংসা নয়।

(চলবে...)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত