কে এই রহস্যময় বনলতা সেন?
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৪৯
বাংলা সাহিত্যে আলোচিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বিশেষভাবে পরিচিত। বহু সাহিত্য প্রেমির হৃদয় ছোঁয়া এই কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ এই কবিতায় যে রহস্য তৈরি করেছেন সেই রহস্য এখনো ধোয়াশা। কেননা প্রতিটি কবিই তার প্রতিটি সৃষ্টিকে কাউকে না কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখেন। এই কবিতায় কবি কোন বনলতা সেনের কথা বলেছেন? বনলতা সেন নারী নাকি পুরুষ? এসকল প্রশ্নই মানুষের মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বনলতা সেন নারী নাকি পুরুষ?
এই প্রশ্নটি বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। কবি যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছেন সে কি নারী নাকি পুরুষ। কবিতায় কবি লিখেছেন – “অন্ধকার বিদিশার নিশার মত চুল” ও “শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মত মুখ” এবং “পাখীর নীড়ের মত চোখ”। বিদিশার দিশার মত চুল নারী বা পুরুষ যে কারো থাকতে পারে। এখানে যদি দীঘল কেশ এর কথা বলা হতো তাহলে তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যেত নারীর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া যে মুখ ও চোখের কথা বলা হয়েছে সেটিও নারী বা পুরুষ যে কারো হতে পারে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যে কবিতায় নারী বা পুরুষের কোনো পোশাকের কথা বলা হয় নি। এছাড়া কোনরকম প্রসাধনী/অলংকার ব্যবহারের বর্ণনা নেই। বাঙালী নারী প্রসাধন-প্রিয়,বিশেষ করে সুন্দরী নারীরা এ ব্যাপারে আরো সচেতন। বনলতা সেন পুরুষ বলেই কি এসব কবির নজরে আসেনি ?
কে এই বনলতা সেন?
এরপরই যে প্রশ্নটি আসে সেটি হলো, কে এই বনলতা সেন? বনলতা সেন নামের কোনো মেয়ের সঙ্গে কি জীবনানন্দ দাশের আদৌ পরিচয় ছিল? গোপালচন্দ্র রায় একবার কবিকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, ‘দাদা, আপনি যে লিখেছেন নাটোরের বনলতা সেন, এই বনলতা সেনটা কে? এই নামে সত্যি আপনার পরিচিত কেউ ছিল নাকি?’ উত্তরে কবি শুধুমাত্র একগাল মুচকি হাসি দিয়েছিলেন। কবি কখনো নিজের অজান্তেও এই বিষয়ে কারো কাছে কিছু বলেননি। কবি নীরব থাকলেও যুগ যুগ ধরে গবেষকরা এই বনলতা সেনকে খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য। বাস্তবে এমন কোনো বনলতা সেনের অস্তিত্ব তারা বের করতে পারেননি।
পুরো কবিতায় মাত্র তিনবার
জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতায় মাত্র তিনবার ‘বনলতা সেন’ নামটি এসেছে। অথচ পুরো কবিতার অন্য আর কোনো কিছু নিয়ে মানুষের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সবাই পড়ে আছেন শুধুমাত্র এই বনলতা সেনকে নিয়ে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা এখানে যে নারী নারী গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলা সাহিত্যে নাটোরের বিখ্যাত হয়ে ওঠা
এই কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের বাড়ি উল্লেখ করেছেন নাটোর জেলাকে। এরপর থেকে বাংলা সাহিত্যে নাটোর জেলা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। এই নাটোর নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। যেমন - কবি কি কখনো নাটোরে পদার্পণ করেছিলেন? জীবনানন্দ দাশের অন্য কোনো লেখায় নাটোরের উল্লেখ পাওয়া যায় নি। তাই এই বিষয়টিও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে আরও অনেক কাহিনী
কবি জীবনানন্দ দাশ বাস্তবের কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে নাকি কল্পনার কাউকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছেন তা এখনো কোনো গবেষক কূলকিনারা করতে পারেন নি। তবে নাটোরের মানুষের কাছে ‘বনলতা সেন’ একজন রক্ত মাংসের মানুষ। নাটোরে স্থানীয়ভাবে ‘বনলতা সেন’ কে নিয়ে বেশকিছু কাহিনী গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই। কেননা ইতিহাসে এসব কাহিনীর কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই।
নাটোরে প্রচলিত একটি কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে একসময় ট্রেনে করে দার্জিলিং যেতে হলে নাটোরের উপর দিয়ে যেতে হতো। একদিন জীবনানন্দ দাশ ট্রেনে করে দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। ট্রেনটি যখন নাটোর স্টেশনে পৌঁছায় তখন অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে ট্রেনে ওঠে। মেয়েটির সাথে ভুবন সেন নামে একজন বৃদ্ধও ছিল। কবি যে কামরায় ছিলেন সেই কামরাতেই তারা উঠেন। কামরায় শুধুমাত্র এই তিনজনই ছিলেন। ভুবন সেন ছিলেন নাটোরের বনেদি সুকুল পরিবারের তারাপদ সুকুলের ম্যানেজার। অপরূপ সুন্দরী সেই মেয়েটি ছিল ভুবন সেনের বিধবা বোন ‘বনলতা সেন’। একসময় ভুবন সেন ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় বনলতা সেনের সাথে কবির আলাপচারিতা জমে ওঠে। এভাবে অনেকটা সময় তারা এভাবেই গল্প করে কাটিয়েছেন। এক সময় ‘বনলতা সেন’ ট্রেন থেকে নেমে যায়। কবি আবার একা হয়ে যান। ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি লাইন এখানে বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। তা হলো - ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।
অপর যে কাহিনীটি রয়েছে সেটিতেও ভুবন সেনের কথা বলা হয়েছে। এখানে ‘বনলতা সেন’ ভুবন সেনের বিধবা বোন ও ঘটনাস্থল ট্রেনের বদলে ভুবন সেনের বাড়ির কথা বলা হয়েছে এবং নাটোরের বনেদি পরিবার সুকুল বাবুর কথাও বলা হয়েছে। কবি একদিন নাটোর বেড়াতে যান। নাটোর গিয়ে তিনি সুকুল বাবুর বাড়িতে ওঠেন। একদিন দুপুরে ভুবন সেন কবিকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। কবিকে আপ্যায়ন করার দায়িত্ব দেয়া হয় ভুবন সেনের বিধবা বোন ‘বনলতা সেন’ কে।
দ্বিতীয় কাহিনীর কেন্দ্রেও আছেন ভুবন সেনের বিধবা বোন বনলতা। তবে ঘটনাস্থল এবার ট্রেন নয়, ভুবন সেনের বাড়ি। নাটোরে বেড়াতে গেছেন জীবনানন্দ। অতিথি হয়েছেন নাটোরের বনেদি পরিবার সুকুলবাবুর বাড়িতে। এক দুপুরে সুুকুল এস্টেটের ম্যানেজার ভুবন সেনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। ভুবন সেনের বিধবা বোন বনলতা সেনের ওপর পড়েছে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব। খাবারের বিছানায় বসে আছেন কবি। হঠাৎ অবগুন্ঠিত এক বিধবা বালিকা। শ্বেত শুভ্র বসনের চেয়েও অপরূপ এক সৌন্দর্যমন্ডিত মুখ। চমকে উঠলেন কবি। এত অল্প বয়সে বিধবা বসন কবির মনকে আলোড়িত করে। হয়তো সে সময় দু-একটি কথাও হয় কবির সঙ্গে বনলতার। তারপর একসময় নাটোর ছেড়ে যান কবি। সঙ্গে নিয়ে যান এক অপরূপ মুখের ছবি। সেই ছবিই হয়তো কবিকে পথ দেখিয়েছে অন্ধকারে, চারদিকে সমুদ্র সফেনের ভেতরও খুঁজে পেয়েছেন শান্তির পরশ।
সর্বশেষ ও তৃতীয় একটি কাহিনী নাটোরে প্রচলিত রয়েছে। তবে এবার ঘটনাস্থল নাটোরের রাজবাড়ি। কোনো এক সময় নাটোরের কোনো এক রাজার আমন্ত্রণে রাজবাড়িতে বেড়াতে আসেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কবির দেখাশোনা করার জন্য রাজা কয়েকজন সুন্দরীকে দায়িত্ব দেন। এদের মধ্যে একজন সুন্দরীর প্রতি কবির আলাদা মমতা জেগে ওঠে। কবি সেই সুন্দরীকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা জানালে সেই সুন্দরী তাতে মত দেয় না। শেষে কবির পীড়াপীড়িতে কবিকে অন্য কোনো নামে কবিতা লেখার অনুরোধ করেন। তাই তো সেই সুন্দরীর প্রকৃত নাম লুকিয়ে ‘বনলতা সেন’ নামটি উল্লেখ করেন।
গল্প-কাহিনী যত যাই থাক। কোনোটিরই বাস্তবিক কোনো ভিত্তি ও ইতিহাস সূত্র বহন করে না। বাঘা বাঘা সব গবেষকরাও বছরের পর বছর গবেষণা করে এই ‘বনলতা সেন’ রহস্য উদঘাটন করতে পারেন নি। বিশ্বের আর দশটা রহস্যের মতো এটিও একটি অজানা রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।