ভূমিপুত্রের স্বপ্ন (ভিডিও)
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০১৬, ২৩:৪২
গাবতলিতে বাস থেকে নামে হাঁসদার। একটা কালো শীর্ণ শরীর জলশূণ্য হয়ে পড়েছে। চোখ দুটো লাল কোটরাগত। কতকগুলো লালচে গোঁফের রেখা আর চিতে পড়া পাঞ্জাবির খোলা বোতামের মাঝ থেকে উঁচিয়ে থাকা বুকের হাড়। হাঁসদার, বরেন্দ্র অঞ্চলের কাঁকনহাটের এক বিশীর্ণ সাঁওতাল যুবক। গালভাঙা হতদরিদ্র এই মানুষের অবয়বে এক ধরনের প্রৌঢ়ত্বের ম্লান চিহ্ন আঁটা। কৈশোর না পেরুতেই অনাবৃষ্টি আর ক্ষরার হাঁমুখে লাল ধুলো ওড়া দরিদ্র জনপদে তার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রপিতামহের তীর-ধনুক মাটির দেয়ালে টাঙানো। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। দাদিমার কাছে গল্প শুনেছিল তার পূর্বপুরুষের গহীন অরণ্যে পশু শিকারের কথা।
বন উজাড় হয়ে ধু ধু জলহীন যে জনপদ সেখানে সবুজ গাছপালা দিদিমার মুখের এক কিংবদন্তির গল্প হয়েই আছে। তারপরও তীর-ধনুক এক যোদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে তাদের জীবনে। জোতদাররা হাঁসদারদের কতোবার উচ্ছেদ করতে চেয়েছে তাদের বাস্তুভিটা থেকে! পূর্বপুরুষের তীর-ধনুক নিয়ে তারা প্রতিরোধ গড়েছে। কয়েকজন আদিবাসী মানুষ রাত জেগে লাল মাটির উঁচু নিচু ঢিবির মধ্যে বাঘের মতো জ্বলজ্বলে চোখে পাহারা দিয়েছে আদিবাসী গ্রাম।
হাঁসদার কষ্টেসৃষ্টে এসএসসি পাস করেছে। বাপ বলেছিল, শহরে গিয়ে চাকরি খুঁজে নিতে। কিন্তু হাঁসদার তা পারেনি। স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের জীবন নিয়ে ভাবেনি। গ্রামে ছোটখাটো একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। সাঁওতালি ভাষায় সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয়। সাঁওতালি ভাষায় প্রথম যেদিন হাঁসদার তার নিজের লেখা শশাঙ্ক শাসনামলের সবুজ বরেন্দ্র জনপদের গল্প বলছিল- চোখ বন্ধ করে বলেছিল বৃষ্টির গল্প- ছোট ছোট বাচ্চারা আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলো যেন কানের পাশে শুনতে পাচ্ছিল ব্যাঙের ডাক। রাজশাহী থেকে, ঢাকা থেকে সাহেবসুবোরা একদিন এই আদিবাসী স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তাদের কথা শুনে হাঁসদারের মনে হলো একদম আপনার মানুষ।
সাঁওতাল কিশোর-কিশোরীরা সার বেঁধে হাতে হাত রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে গাইলো সাঁওতালি গান। ঢাকা থেকে আসা একজন লেখিকা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। 'কি সুন্দর তোমাদের নাচ'। এক সমাজকর্মী আপা ইংরেজিতে এক ফরেনার ভদ্রলোককে কি সব বোঝাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক ক্যামেরায় হাঁসদারের ছবি তুললেন। সঙ্গে তার ছাত্র-ছাত্রীর। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের মতো হলো। একজন সাদাচুল পন্ডিত বর্ণনা করলেন, নাচোল বিদ্রোহের কথা। হাঁসদার হতচকিত চোখে মুগ্ধতায় তার দিকে চেয়ে ছিল।
'আমগেরই কথা আমগের চাইত সুন্দর করি বললেক'। ছোট ছোট শিশুদের সামনে চিৎকার করে হাঁসদার বলে, 'আর আমগের দু:খ থাকবিক লা'। হাঁসদার যেন অনুভব করে কয়েকজন ঈশ্বর লাল বিস্তীর্ণ ধুলোমাখা হরিদ্র জনপদের পিচঢালা রাস্তায় পাজেরো চালিয়ে এই অনগ্রসর পল্লীতে ঢুকে পড়েছে। মানুষের মুক্তির জন্য তারা তীর্থযাত্রায় শ্যামিল। আমলা, বুদ্ধিজীবি, এনজিওকর্মী, দাতা-সংস্থার লোক কতগুলো তিন-ঠেঙে টুল, ধুসর খেজুর পাটি আর দড়ির খাটিয়ায় বসে। ওপরে তিরিক্ষি সূর্য, বাতাসে জলীয়বাষ্প নেই- খরায় ফেটে চৌচির লাল মাটির লোহেল বুক।
হাঁসদার হন্তদন্ত হয়ে ছোটাছুটি করে। বউ রনকাকে তাড়া দেয়। কোত্থেকে একটা লালঝুটি, বিবর্ণ ধুলোমাখা পালক জলতৃষ্ণায় ধুঁকছে এমন মোরগ এনে জবাই করা হলো। লাল চালের ভাত ফুটছে। টিনের কতোগুলো প্লেট জোগাড়ে শশব্যস্ত বিজয় চন্দ্র। বউ মায়াবতী মাটির একটা কলস নিয়ে বের হয় পানি সংগ্রহের অভিযানে। সাঁওতাল পল্লীতে এমন উৎসব বহুদিন হয়নি। পূর্ণিমা রাতে ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজিয়ে জীবন উৎসব বন্ধ হয়ে গেছে দীর্ঘদিন। সেসব শুধু দাদিমার মুখে শোনা গল্প। হিংস্র শূকরকে শরবিদ্ধ করে আগুনে ঝলসানো কিংবা রং খেলার উৎসব- সারা রাত ঢোলকের শব্দে জেগে থাকতো গ্রাম। সালঙ্কারা সাঁওতাল বধূরা হাত ধরে ঝুমুর তালে নাচতো। হঠাৎ লুকিয়ে দেখতো স্বামী কিংবা প্রেমিক পুরুষকে।
রান্নার চুলোর পাশে রনকার চোখ যখন ধোঁয়ায় লাল- হাঁসদার স্বপ্ন দেখায়, 'আবার সিসব দিন ফিরি আসবিক'। শিশুরা গোল গোল হয়ে খেলা করে। কেউ গিয়ে দৌড়ে একটা কাদা পানির পুকুরে ঝাঁপ দেয়। কাদা পানির মধ্যে মোষের মতো শরীর ডুবিয়ে রাখে।
সাহেবরা ফিরে যাওয়ার পর এক বছর চলে গেছে। টাকা-পয়সার অভাবে স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শামসুল জোতদারের লেঠেলরা রোজ রাতে সাঁওতাল পল্লীতে হানা দেয়। গ্রামের বউ-ঝিরা আশঙ্কায় জেগে থাকে। যেকোন সময় সম্ভ্রমের ওপরে আঘাত আসতে পারে। হাঁসদার রাজশাহী গিয়ে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। ডিসি মহোদয় মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় হাঁসদারকে পুলিশ সার্কিট হাউসের গেট থেকে ফিরিয়ে দেয়। একজন লেখকের বাসায় গিয়ে হাঁসদার কান্নায় ভেঙে পড়ে। লেখক হাঁসদারের কাঁধে হাত রেখে বলেন, 'তোমাকে নায়ক করে উপন্যাস লিখছি। তুমি ইতিহাসে থেকে গেলে'। এক বার্ধক্যময় প্রশান্ত নির্মিলিত হাসি- তার সঙ্গে মিশে থাকা শিল্পতৃষ্ণা।
- চা খাবে হাঁসদার?
পন্ডিতেরা কথায় কথায় চা খান। কিন্তু কি করে বোঝাবে হাঁসদার তার ভাতের ক্ষিদে।
গাবতলী থেকে ঠিকানা বের করে ধানমন্ডিতে হাঁসদার লেখিকার বাসায় পৌঁছে। লেখিকা ব্যস্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হাঁসদারের দিকে তাকিয়েও চিনতে পারেন না। দারোয়ান জানায় উনি দাওয়াতে যাচ্ছেন। রাতে ফিরবেন। হাঁসদার গুলশানে যায়। এনজিও নির্বাহী আপার বাসায়। বারান্দায় একটা গাছের গুঁড়ির ওপর হাঁসদারকে বসতে দেয়। বাড়ির কাজের মেয়েটা হাঁসদারকে স্যান্ডউইচ খেতে দেয়। একটা পাহাড়ি মেয়ে। হাঁসদারের দিকে সে মায়ার চোখে তাকায়।
ম্যাডাম বলেন, 'তোমাদের জন্য ফান্ড যোগাড় করতে চেষ্টা করছি। ডেনমার্কে একটা কনফারেন্স আছে। ওখান থেকে ফিরেই ডেনিস এমব্যাসির সঙ্গে কথা হবে। তোমরা একটা প্রজেক্ট পেয়ে যাবে এ বছরের শেষ নাগাদ'।
হাঁসদার কি করে বোঝাবে আগামী সাতদিনে ওলাওঠায় কমপক্ষে সাতজন মানুষ মারা যাবে। কলের পানি এতো নিচে নেমে গেছে যে, কল চাপলে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ আসে- যেন কোনো তৃষ্ণার্ত মানুষের আর্তনাদ। চট দিয়ে মুড়ে রাখা পরিত্যক্ত টিউবওয়েল দেখে জ্যোৎস্না রাতে মনে হয় নরমুন্ডু। বাচ্চাদের বই পুস্তক, স্লেট পেন্সিল নেই। স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায় যায়। হয়তো গিয়ে শুনবে মায়াবতী ঘর ছেড়েছে। মহাজনের বাসায় বাসন ধোয়ার কাজ নিয়েছে। রনকার বুক শুকিয়ে গেছে। শিশুটা ধুলোর উঠোনে কেঁদে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাঁসদার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, শুকনো স্যান্ডউইচ তার গলা দিয়ে নামে না।
হাঁসদার উদভ্রান্তের মতো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার শক্তি নেই তার। পকেটে পয়সাও নেই তার ফিরে যাবার। আর কোন মুখ নিয়ে ফিরবে সে! অবাক হয়ে দেখে একটা লোক ভাঙা ইটের টুকরো ঘষে ঘষে রাস্তায় কি সব লিখছে।
হাঁসদার একটা চায়ের স্টল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢক ঢক করে খায়। কতোদিন পর পুরো এক গ্লাস পানি খেলো। বুকের মধ্যে খালবিল অন্ননালী শীতল করে দিয়ে পানি নেমে যায়। চোখ বন্ধ করে, মনে হয় সে যেন স্কুল ঘরের মধ্যে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনছে। সাঁওতাল শিশুরা বৃষ্টির মধ্যে হৈ-হুল্লোড়, দাপাদাপি করছে। রনকা হা করে বৃষ্টির জল গলায় নিচ্ছে। তার কালো টিকালো মুখ বৃষ্টিতে ধুয়ে চকচক করছে। চোখের মণি ধুয়ে সাদা ধবধবে। আশেপাশের ডোবায় ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। চারপাশে জীবন জেগেছে। পালক ধুয়ে লাল ঝুঁটিঅলা মোরগ দৌড়াদৌড়ি করছে। সাঁওতাল পল্লীতে আজ জীবনের উৎসব!
ভূমিপুত্রের স্বপ্ন ছোটগল্পটি আবৃত্তি করেছেন প্রগতিশীল ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফারজানা কবির খান স্নিগ্ধা