ছোট গল্প
প্যান্ডেমিক
প্রকাশ : ০১ মে ২০২০, ১৮:০৫
[এই গল্পের সব ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোন মিল খুঁজে পেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র।]
এক
শোবার ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছেন নাজিমুদ্দিন সাহেব- সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হক, তবে দেশের মানুষ তাকে নাজিমুদ্দিন নামেই চেনে। ঘড়িতে এখন রাত ৩টা ১৩ মিনিট। নাজিমুদ্দিন সাহেব হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী, এতো রাতে তিনি জেগে থাকেন না কখনোই। রাত ১০টার মধ্যে খাবার শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকেন। এরপর টিভি ছেড়ে কিছুক্ষণ এই চ্যানেল ঐ চ্যানেল ঘুরাঘুরি করে ঘুমিয়ে পড়েন। এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় না কখনোই। দেশের চরম ক্রান্তিকালেও রাতে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমুতে পেরেছেন তিনি, সমস্যা হয়নি। কিন্তু ইদানিং আর ঘুমাতে পারছেন না। আগে একান্তই ঘুমটুম না আসলে খবরটবর বা টকশো দেখতেন তিনি, বিরোধীদলের নেতাদের নাকানিচুবানি দেখতে ভালো লাগতো তার। ইদানিং আর ওসব দেখেন না, সেই তো সবখানে সেই একই খবর- কী বিরোধীদল কী সরকারি, কেউই তো রেহাই পাচ্ছে না!
নাজিমুদ্দিন সাহেব ঘরের চারপাশে চোখ বুলান- অভিজাত সব আসবাবে পরিপূর্ণ, কোনকিছুরই কমতি রাখেননি তিনি। ২০ ফিট বাই ৩০ ফিট এর বিশাল শোবার ঘর, সাথে ১২ ফিট বাই ১০ ফিটের অ্যাটাচড্ বাথরুম। দক্ষিণ দিকে একটা ব্যালকনিও রেখেছেন। দেয়ালগুলো হালকা সবুজ রঙের, এটাকে কি পেস্ট কালার বলে? কী জানি! দরজা জানালায় সোনালি কারুকাজ করা ঘিয়ে রঙের ভারী পর্দা। মনে আছে, সরকারি সফরে মন্ত্রণালয় থেকে চায়না গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে, সেবারই গুয়াংজু থেকে নিজে পছন্দ করে কিনেছিলেন এগুলো। ঘরের আগের পর্দাগুলো তখনও নতুন, কিন্তু শখের একটা ব্যাপার আছে না? পর্দা কেনার টাকাটা অবশ্য সরকারি তহবিল থেকে খরচ হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে খুব দোষের কিছু মনে করেন না তিনি, সরকারের টাকা যদি সরকারি দলের মানুষের কাজেই না লাগে তবে আর কি! নাজিমুদ্দিন সাহেব সিলিং এর দিকে তাকালেন। সাড়ে ১৩ ফিট উঁচু সিলিং থেকে হান্টার ফ্যানটা ঝুলছে- চেস্টনাট কালারের ৫ ব্লেডের ফ্যান, সরাসরি লন্ডন থেকে আনিয়েছিলেন। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে- দারুণ বাতাস, এসিও ২০ এ চলছে ঠিকঠাক। তবু এই অক্টোবরের রাতে কুলকুল করে ঘামছেন তিনি। এই মরণকামড়ে মরার আগে কি আক্রান্ত ব্যক্তি এভাবে ঘামতে থাকে? জানা নেই নাজিমুদ্দিন সাহেবের। এখন পর্যন্ত যারা এভাবে মারা গিয়েছেন তাদের মৃত্যুপূর্ব মুহুর্ত কেউ জানতে পারেনি। ভয়ে কেউ কাছেই ঘেঁষেনি, জানবে কিভাবে!
ঘরের স্লাইডারটা খুলে দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন নাজিমুদ্দিন। দখিনা বারান্দা তার, পাশের জমিটুকু খালি তাই বাতাস আসে প্রচুর। ঐ জমিতে একটা বস্তি ছিল আগে। ঐ ফকিন্নিদের তাড়াতে নেফাল গ্রুপের সাথে মিলে অবশ্য একটু কষ্ট করতে হয়েছে। ছেলেপুলেদের কিছু টাকা দিয়ে পুরো বস্তিটা আগুন জ্বালিয়ে ছাই করতে হয়েছে তাকে, বিনিময়ে দখিন খোলা এই দারুন ৩২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটা। পোড়া ঘরগুলোর সামনে বসে ফকিন্নিগুলো কিছুদিন কান্নাকাটি করেছে। মিডিয়াও তাদের কান্নাকাটির ছবি আর আবেগী গল্প দিয়ে মুখরোচক স্টোরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কয়েকদিন হইচইও হয়েছে। তারপর কদিন পরে ক্রিকেট ম্যাচ জেতার খবরে ঐ ইস্যু সবাই ভুলে গেছে। ভাগ্যিস শামীম সেঞ্চুরিটা করেছিল! নাজিমুদ্দিন সাহেব অবশ্য এই বস্তি পোড়ানো নিয়ে খুব একটা অনুতপ্ত না। বৃহৎ উন্নয়নের স্বার্থে এসব ছোটখাটো স্যাক্রিফাইস ঐ ছোটলোকদের করতেই হয়, এটাই স্বাভাবিক। আর শহরের সবখানে যদি ঐ ফকিন্নিরাই থাকবে তবে ওনার মতো ভদ্রলোকেরা যাবে কই? তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে তো ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়াই হয়েছে পরিবার প্রতি। সেটা কি কম নাকি! ফকিন্নিগুলা আবার বিচার চায়!
সাত তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশি রঙা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দূরে তাকান নাজিমুদ্দিন সাহেব। কয়েক বছর আগেও এখানে ঝোপঝাড় ছিল, এখন যদ্দূর চোখ যায় উঁচু উঁচু কংক্রিটের দালান। এসবই উন্নয়ন এর ফসল। কিন্তু এতো উন্নয়ন দিয়েও এই বিপর্যয়টা ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। নাজিমুদ্দিন সাহেব আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকান, ৩টা ৩৫, শহরটা ঘুমুচ্ছে। দু-তিনটে ঘরে কেবল আলো দেখা যায়। আজকাল ঘরে ঘরে আতঙ্ক! মাত্র ৩ মাসে যে দেশটা এমন পাল্টে যাবে কে ভেবেছিল!
দুই
ঘটনাটা প্রথম যখন শুরু হয় কেউ ঠিকঠাক কিছু বুঝেই উঠতে পারেনি। জুলাই মাসের শেষ দিন। আগের দিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, তবু সকাল সকাল কড়া রোদ। শুক্রবার দিন একটু বেলা অব্দিই ঘুমাতে চেয়েছিলেন বদরুজ্জামান সাহেব। কিন্তু স্ত্রী শান্তার ডাকাডাকিতে উঠতেই হলো।
- বলি আর কত ঘুমুবে শুনি? দশটা তো বাজতে চললো
- আহ! শুক্রবার দিনটাই তো ঘুমাই…
- আর শুক্রবার! লকডাউনে এই কটা মাস তো ঘুমালেই কেবল, এখন এক সপ্তাহ অফিস করেই টায়ার্ড!
- আরে বাবা অফিস তো করেছি নাকি? তোমার মতো শুধু ঘরে তো বসে থাকিনি!
- আমি কি ঘরে এমনি বসে থাকি? সারাদিনই তো খেটে মরছি। আর এই দিনের পর দিন ঘরে থাকাটাও যে সহজ না সেটা তো এতোদিনে বুঝে গিয়েছো নাকি?
বদরুজ্জামান আর কথা বাড়ান না। সত্যি! কী এক ভাইরাস আসলো আর সবাইকে গৃহবন্দী করে দিলো, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস! শুধু ঘরে বসে থাকাটাই যে এতো কষ্টকর আগে বুঝেননি তিনি। স্ত্রী শান্তার জন্য হঠাৎ কিছুটা মায়াই লাগে তার। পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স সে, রেজাল্ট ভালোই ছিল। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরিও করতো। বিয়ের পর বদরুজ্জামানই চাকরিটা ছাড়িয়ে দিয়েছেন। বদরুজ্জামান নিজে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বেতন আর উপরি দুইটাই অনেক ভালো তার। সেখানে তার স্ত্রীকে কেন কষ্ট করে ঐ দুই টাকার চাকরি করতে হবে? তাছাড়া অমন বাড়ির বাইরে বাইরে থাকলে মেয়েদের কখন মাথা বিগড়ে যায় ঠিক নেই। সংসারে শান্তি রাখতে হলে মেয়েদের একটু কম বুঝতে হয়, একটু মানিয়ে চলতে হয়। চাকরিটা ছাড়ার ব্যাপারে শান্তা প্রথমে একটু আপত্তি তুলেছিল বটে, 'এতো পড়াশোনা করে ঘরে বসে থাকবো?' তবে বদরুজ্জামান ভালো মানুষ। তিনি শান্তাকে বুঝিয়েছেন, তিনি যা বলছেন তা তো শান্তাকে ভালোবেসে তার ভালোর জন্যই বলছেন। শান্তার বাবা মাও তাকে বুঝিয়েছে, মেয়েদের অমন একটু আধটু মানিয়ে চলতেই হয়। শান্তা মানিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া বদরুজ্জামান তো শান্তাকে অনাদরে রাখেননি। তার খাওয়া পরার কোন অভাব রাখেননি।
এই যে গত কয়েক মাস ধরে দেশ তো দেশ, গোটা পৃথিবীটাই যেন উলটপালট হয়ে গেলো এক অদেখা ভাইরাসের কারণে। অফিস আদালত দোকানপাট সব বন্ধ, ফাঁকা রাস্তা, চায়ের দোকানে ভিড় নেই, গলির মোড়ে আড্ডা নেই, সবাইকে বলা হলো ঘরে থাকতে, সব পরিষ্কার রাখতে। লোকে তখন যে যেভাবে পারে হুড়োহুড়ি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনছে। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য বারেবারে বলা হচ্ছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস না কিনতে, যেন সকলেই কিনতে পারে, সংকট তৈরি না হয়। তবু ঘরভর্তি করে বাজার করেছেন তিনি। চাল, ডাল, তেল, লবণ, সাবান, টিস্যু, হ্যান্ডওয়াশ, মাস্ক, গ্লাভস কী কিনেননি তিনি! সবই কিনেছেন, যতখানি প্রয়োজন তার চেয়েও অনেক বেশিই কিনেছেন। এতো বাজার-সদাই দেখে শান্তাও প্রথমে অবাক হয়েছিল। কোথায় রাখবে এসব? তাছাড়া টিভিতে, ফেসবুকে হরহামেশাই দেখছে সে এসব অতিরিক্ত জিনিস স্টক করার কারণে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে হুহু করে। গরীব মানুষ এর ধরাছোঁয়ার বাইরে! শান্তা বলেছিল, 'কিছু জিনিস গরীব প্রতিবেশীদের দিয়ে দেই?' শান্তার বোকামিতে অবাক হয়েছিলেন বদরুজ্জামান। বললেই হলো? সকলের কথা ভাবতে গেলে আজকাল নিজের পেট চলে? রান্নাঘর, স্টোররুম ভর্তি করার পর বিছানার তোশকের নিচে, আলমারি, কাপবোর্ড সবই এসব জিনিসপত্র দিয়ে সয়লাব করে ফেলেছিলেন বদরুজ্জামান। এর মাঝে বিল্ডিং এর কিছু ছেলেপুলে এসেছিল একদিন বদরুজ্জামান এর কাছে। তারা নাকি বিল্ডিং এর সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলছে, এই লকডাউনের কারণে দিনমজুর যারা কষ্টে আছে তাদের ত্রাণ দেবে। বিরক্ত হয়েছিলেন বদরুজ্জামান। আরে গরীব মানুষ তো এমনিতেই মরবে, তাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন মানে আছে? ছেলেগুলোকে ধমক দিয়ে বিদায় করে শান্তাকে বলেছিলেন মোরগ-পোলাও রান্না করতে। এটা সে ভালো রান্না করে। এই লকডাউনে অবশ্য বাড়ি থাকার কারণে শান্তাকে দিয়ে একটু বেশিই রান্না করিয়েছেন বদরুজ্জামান। খাবার ব্যাপারে বেশ শৌখিন কিনা তিনি! ভাইরাসের ভয়ে গৃহকর্মীকে ছুটি দেয়া হয়েছে, ৬ বছরের ছেলেকে সামলে এতো সব রান্নাবান্না করতে হিমশিম খেয়ে অনেক সময় বিরক্ত হয়েছে শান্তা, দুয়েকবার অবশ্য বলেছে তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু ওসব তো মেয়েদের কাজ, বদরুজ্জামান কি বুঝবেন! শান্তাকে তিনি ভালোবাসেন, তবু শান্তার এসব কথায় ক্ষেপে গিয়ে কখনো দিয়েছেন কয়েক ঘা বসিয়ে। বাসায় বসে বসে এমনিতেই মনমেজাজ খিটখিটে, তার মধ্যে বউয়ের এই ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে! শান্তা অবশ্য বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে বুঝেছে যে ভালোবাসে সে মাঝেমধ্যে অমন একটু হাতও তুলে।
হাতমুখ ধুয়ে নাশতা সেরে বাজার করতে বের হন বদরুজ্জামান। ঘরে তখনো ফ্রিজ ভর্তি মাছমাংস, তরিতরকারি। কিন্তু লকডাউন শেষ হবার পর আজ প্রথম শুক্রবার। একটু ভালোমন্দ না খেলে হয়? ছেলেটা তার চিংড়ি খেতে বড় ভালোবাসে, তাই বাজার থেকে বড় বড় কটা গলদা চিংড়ি কিনে রিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন বদরুজ্জামান। কড়া রোদে ঘেমে জবজবে হয়েও শান্তার হাতে রান্না করা চিংড়ির মালাইকারি খেতে কেমন লাগবে সেটাই বেশ আয়েশ করে ভাবছিলেন তিনি। তখনও কি বদরুজ্জামান জানতেন কি অপেক্ষা করছে সামনে তার জন্য! ঘটনাটি ঘটার পর বদরুজ্জামান এর সেই বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে আশেপাশে যারাই ছিল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল। কেউ কেউ অবশ্য অতি উৎসাহী হয়ে মোবাইলে ভিডিও করতেও শুরু করে। এমন অদ্ভুত ঘটনা তো এর আগে দেখেনি কেউ! ঠিক বাড়ির গেটের সামনে এসে যখন নামতে যাবেন বদরুজ্জামান তখনি ঘটে ঘটনাটা। হঠাৎ কোন সাড়াশব্দ নেই অথচ সবাই অবাক হয়ে দেখলো সুস্থসবল বদরুজ্জামান মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার শরীরটাকে দেখাচ্ছে একটা থলথলে জেলিফিশ এর মতো। শরীরের মাঝ বরাবর কোন হাড় আছে বলে মনে হচ্ছে না। নীল সুতোর মতো একটা কিছুর সাহায্যে ঘাড় থেকে শুরু করে হিপ পর্যন্ত কোনরকমে আটকে আছে পুরো শরীরটা। তার শরীরটাকে মনে হচ্ছে একটা পানিভর্তি বেলুনের মতো, আর সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে তার ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, পাকস্থলী ইত্যাদি। আর তার ঠিক পাশেই ছড়িয়ে পড়েছিল সদ্য কেনা গলদা চিংড়িগুলো। নেহাতই বাড়ির সামনে এসে ঘটনাটি ঘটে তাই পরিবারের কাছে খবর চলে যায় দ্রুত। শহরের অন্যতম সেরা হাসপাতালেই বদরুজ্জামানকে নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তা। প্রচুর অর্থও খরচ করেছিলেন, কিন্তু কিছুই বাঁচাতে পারেনি বদরুজ্জামানকে। মেরুদণ্ড পুরোটাই গলে গিয়েছিল তার। এমন অদ্ভুত রোগ এর আগে দেখা তো দূর এমন কথা শুনেনওনি ডাক্তাররা। দেশে-বিদেশে খোঁজ নিয়েও তাই শেষ পর্যন্ত কার্যকর কোন চিকিৎসাই সম্ভব হয়নি বদরুজ্জামান এর। ২৪ ঘন্টা পর হাসপাতালের আইসিইউতেই মৃত্যু হয় তার।
বদরুজ্জামানের ঘটনাটা কয়েকটি পত্রিকায় এসেছিল ছোট করে, 'রাজধানীতে রহস্যজনক মৃত্যু' শিরোনামে। কিন্তু আরো অনেক খুন ধর্ষণের খবরের ভিড়ে এই খবরটি বিশেষ কোন আলোড়ন তুলেনি মানুষের মধ্যে। সদ্য কেনা গলদা চিংড়ির পাশে জেলিফিশের মতো কাতরানো বদরুজ্জামানের ভিডিওটাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেরিয়েছে কিছুদিন। তবে বিশেষ কিছু পাত্তা পায়নি সেটা। আসলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি আদতে এমন কিছু ঘটতে পারে। তরুণদের অনেকেই এটাকে হোক্স বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন, ট্রল পেজগুলোতে মিমও বানিয়েছিলেন অনেকে। ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা করেন যারা তারা অনেকে আবার বদরুজ্জামানের সাথে তার স্ত্রী শান্তার ছবি খুঁজে বের করে বলেছিলেন স্ত্রীকে পর্দা না করানোর অপরাধেই তার উপর এই শাস্তি। কেউ বলেছেন বিরোধীদলের নতুন কোন ষড়যন্ত্র, কেউ বলেছেন লকডাউন পরবর্তী দেশের বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতেই সরকারের এই প্রয়াস। কিন্তু ঐ পর্যন্তই- যেমনটা হয় আরো অনেক ইস্যুকে কেন্দ্র করেই। বদরুজ্জামানের এই খবরটা হয়তো এভাবেই হারিয়ে যেতো যদি পরবর্তী ঘটনাটা না ঘটতো।
তিন
নেফাল গ্রুপের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান তখন সবেমাত্র কানাডা থেকে সপরিবারে দেশে ফিরেছেন। বিমানবন্দরের ফর্মালিটিজ শেষ করে লাগেজ লাউঞ্জ থেকে লাগেজ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা কালো বিএমডব্লিউ গাড়িটাতে উঠে বসেন সপরিবারে। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন এসিটা বাড়িয়ে দিতে। এতোদিন পর দেশে ফিরে হঠাতই যেন ভীষণ গরম লাগছে তার। গত তিন মাস টানা কানাডায় ছিলেন তিনি। টরেন্টোতে তার নিজস্ব একটা বাড়ি আছে বটে, তবে সেটা ছুটি কাটানোর জন্য। এতোটা লম্বা সময় সেখানে থাকেন না তিনি। দেশে তার হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, এসব ফেলে এতো লম্বা সময় দেশের বাইরে থাকা যায় না। তবে এবার অন্য কোন উপায় ছিল না। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার যা অবস্থা! তাতে এমন গ্লোবাল প্যান্ডেমিকের সময় দেশে থেকে রিস্ক নিতে চাননি তিনি। সেজন্যই দেশের অবস্থা খারাপ হবার আগেই সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। তবে সেখান থেকে নিয়মিতই দেশে কাজের খোঁজখবর রাখতে হয়েছে তাকে। সরকারের ঊর্ধ্বতনদের নিয়মিত চাপে রেখেছেন লকডাউনের মধ্যেও গার্মেন্টস খুলে দেয়ার জন্য। দেশে মোট ২৭টি গার্মেন্টস তার। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা সেখানে। এই প্যান্ডেমিকে গার্মেন্টস কর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার কথা ভাবতে থাকলে তো আর ব্যবসা হবে না। খুব বেশি চাপ দিতে হয়নি অবশ্য সরকারকে। সরকার নিজেও জানে, টিকে থাকতে হলে শফিক সাহেবের মতো বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের কাছেই তাদেরকে আসতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কাজে এসে ঐ ছোটলোকদের ভাইরাস সংক্রমন হবে কিনা তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে শফিক সাহেবদের মতো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ। অচিরেই খুলেছে সব গার্মেন্টস।
অবশ্য এ নিয়ে একটু ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে শফিক সাহেবকে। লকডাউনের কারণে গণপরিবহন সব বন্ধ ছিল। তাই গার্মেন্টস খোলার নোটিশ জারি হবার পর কর্মীরা সবাই পায়ে হেঁটেই রওনা দিয়েছিল বিভিন্ন শহর থেকে। সেসব ছবি ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। শ্রমিক সংগঠন আর সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু গ্রুপ কিছুদিন উচ্চবাচ্য করেছে বেশ এসব নিয়ে। শফিক সাহেবের মতো ব্যবসায়ীদের অনেক সমালোচনাও হয়েছে। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেও কেন তারা শ্রমিকদের সামান্য কটা বেতন দিতে পারেন না সে নিয়ে নানান জনের নানান প্রশ্ন। অথচ উত্তরটা সকলেরই জানা। শফিক সাহেবের হাসি পায়! এটা বিজনেস পলিসি ভায়া। শ্রমিকদের সব বেতন যদি সময়মতো দিয়েই দিবেন, তাদের সব দাবি যদি মেনেই নিবেন তবে আর হাজার কোটি টাকার মালিকটা হবেন কিভাবে? এই যে রাজধানীতে ৫ একর জায়গার উপর তার বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি, এই যে নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি, বিদেশে ভ্যাকেশন, স্ত্রীর ডায়মন্ড জুয়েলারি, ছেলেমেয়েদের বাহারি শখ, তিনি এসবের পেছনে খরচ করবেন নাকি ওসব ফকিন্নিদের বেতন দেবেন! ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া এসব জনগণ শ্রমিক পাললে বুঝতে পারতেন বিজনেসটা এতো সহজ নয়!
গাড়ি থেকে নেমে সোজা বেডরুমে যান শফিকুর রহমান। কাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢুকেন শাওয়ার নিতে। মানুষের পুরো ঘরও হয়তো এতো বড় হয় না যতটা বড় তার বাথরুম। শফিক সাহেবের মুডের হিসেবে নানান রকম আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেখানে তিনি। বাথরুমে ঢুকেই রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে দেন শফিক সাহেব। সাথে সাথে আলো বদলে বাথরুমটা হালকা নীলচে রূপালি আলোয় ভরে যায়। হঠাত করে দেখলে মনে হবে যেন জোছনার আলোয় আলোকিত ঘরটা। শাওয়ার ছাড়ার আগ মুহুর্তে হালকা ভলিউমে মিউজিক ছাড়েন শফিক সাহেব, তার প্রিয় জ্যাজ। জ্যাজ এর সুরে আর জোছনার মতো নরম আলোতে ভাসতে ভাসতে জেট ল্যাগ কাটাতে শাওয়ারের নিচে আরামে গা এলিয়ে দেন শফিক সাহেব।
ঘটনাটা ঠিক কখন ঘটেছে জানে না কেউ। এমনিতেই সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে বাথরুমে একটু দীর্ঘসময় নেন শফিক সাহেব। তার উপর দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর স্বভাবতই একটু বেশি সময় লাগতে পারে বলে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায়নি প্রথমে। কিন্তু ঘন্টাখানেক কেটে যাবার পরেও বাথরুম থেকে শফিক সাহেব বের হচ্ছেন না বলে স্ত্রী মাহফুজাকে কিছুটা বিচলিত দেখায়। বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দুয়েকবার ‘শফিক শফিক’ বলে ডাক দেন তিনি। কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় না কেবল জ্যাজ এর অস্পষ্ট কিছু সুর ছাড়া। মাহফুজা আবার ঘরে এসে তার প্রিয় ডিভানে বসে রেড ওয়াইনে চুমুক দেন। যেকোনো ফ্লাইটের পর রেড ওয়াইন তার চাইই চাই, এটাই তার জেট ল্যাগ কাটানোর মহৌষধ। রেড ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে হয়তো একটু চোখ বুজে এসেছিল মাহফুজার। তন্দ্রা ভাঙে ফিরোজের ডাকে। ফিরোজ এ বাসার গৃহকর্মীদের একজন। তার দায়িত্ব মূলত খাবারদাবার এর তদারকি করা। দীর্ঘসময় কেটে গেলেও গৃহকর্তা ও কর্ত্রী রাতের খাবার খেতে আসছেন না বলে ফিরোজ এসেছিল খোঁজ নিতে। মাহফুজা ‘আসছি’ বলে ফিরোজকে ফেরত পাঠিয়ে দেখেন শফিক সাহেব এখনো বাথরুম থেকে বের হননি। মাহফুজা ঘড়িতে সময় দেখলেন রাত ১১টা ১০, তারা যখন ফিরেছিলেন তখন রাত সাড়ে ৯টা। মাহফুজা আরেকবার বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে ডাকলেন ‘শফিক! শফিক!’ এবারো কোন আওয়াজ এলো না। মাহফুজাকে এবার সত্যি চিন্তিত দেখালো।
দরজার লকগুলো সব জার্মান তাই ভাঙতে সময় লেগেছিল বৈকি। শেষ পর্যন্ত যখন বাথরুমের দরজাটা ভাঙা হয় তখন রাত প্রায় পৌনে একটা। দরজা ভাঙার পর শফিকুর রহমানকে প্রথম দেখেছিলেন বাসার সিকিউরিটি ইনচার্জ মাজেদ। এরপরেই ঢুকেন মাহফুজা। প্রথমে বুঝতেই পারেননি যা দেখছেন তা সত্যি নাকি রেড ওয়াইন ও জেট ল্যাগের ফলাফল! না, ঠিকই দেখছেন তিনি। শাওয়ার রুমের গ্লাসের গায়ে লেগে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন শফিকুর রহমান। তার মুখটা একইরকম থাকলেও বদলে গেছে শরীরটা। থলথলে একটা জেলিফিশের মতো শরীর নিয়ে পড়ে আছেন শফিকুর রহমান। ঠিক যেভাবে আজ থেকে ১৭ দিন আগে বাড়ির সামনে পড়েছিলেন বদরুজ্জামান। বদরুজ্জামানকে তবু হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। শফিক সাহেব সেই সুযোগটাও দেননি। রেড ওয়াইনের ঘোর না কাটানো মাহফুজা যখন তার স্বামীর থলথলে দেহটা দেখে বেসিনে সব উগড়ে দিচ্ছিলেন শফিক সাহেব তখন শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলেন। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার জাদুকরি কণ্ঠ তখনো গেয়ে যাচ্ছে, 'কিলিং মি সফটলি উইথ হার সঙ্গস…'
চার
শফিক সাহেব দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই বদরুজ্জামানের ঘটনার মতো তার ঘটনাটা ধামাচাপা পড়ে যায়নি। পুরো দেশ তোলপাড় হয়ে যায় এই এক খবরে। নতুন করে ভাইরাল হয় গলদা চিংড়ির পাশে বদরুজ্জামানের সেই কাতরানোর ভিডিওটাও। বদরুজ্জামান ও শফিক সাহেবের ঘটনাটার মাঝে ১৭ দিনের পার্থক্য থাকলেও পরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে খুব দ্রুত। শুরুর দিকে অনেকেই বুঝতে পারেননি কি ঘটছে, কেন ঘটছে। কেউ বলেছেন এটা নতুন কোন ভাইরাস, কেউ বলেছেন প্রতিবেশী দেশের কোন অদৃশ্য আক্রমণ, কেউ বলেছেন সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ, কেউ বলেছেন সরকারের ব্যর্থতা, কেউ বলেছেন দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চক্রান্ত। কিন্তু যতো দিন গিয়েছে দেখা গেছে একে এরকম গৎবাঁধা কোন ছকেই ফেলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে গত দুই মাস ১১ দিনে সারাদেশে একইভাবে মৃত্যুবরণ করেছে ২৩৭ জন। মৃতের তালিকায় চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, ধর্মনেতা, অভিনেতা কে নেই! প্রথম কয়েকটি মৃত্যুতে তবু মৃতের পরিবারের লোকেরা পাশে ছিল। যতো দিন গিয়েছে মানুষ ভয়ে আর ধারেকাছেই ঘেঁষেনি। এর আগে যখন এক ভাইরাসকে কেন্দ্র করে গ্লোবাল প্যান্ডেমিক ছড়িয়ে পড়লো তখনো সরকার চিন্তিত হয়েছে। সবকিছু সামাল দিতে পারেনি যদিও কিন্তু সারা পৃথিবীতেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, অনেক উন্নত দেশও একে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে দেশের জনগণকে কিছু বুঝ দেয়া সম্ভব হয়েছে। নিজেদের গাফিলতি আর ভুলগুলোকে ঢাকতে কোটি কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়ে কিছুটা রেহাই পাওয়া গেছে।
কিন্তু এবার? এবার যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবার সব চেষ্টাই যেন বৃথা যাচ্ছে। এদিকে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতির কথা শুনে সারা পৃথিবীর সব গণমাধ্যমের চোখ এখন এই দেশের উপর। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সেই ভাইরাস, যাতে মৃত্যু হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের, সেসব খবর ফেলে সবার এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই ছোট্ট একটি দেশের এই অদ্ভুত ঘটনা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই ইন্টারপোল সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনো বেশ দক্ষতার সাথেই সেই চাপকে মোকাবেলা করে যাচ্ছেন কিন্তু আর কতদিন পারবেন তিনি জানেন না। অথচ কি কারণে যে এমন ঘটছে সেটাও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। প্রতিদিন দেশ বিদেশের মিডিয়াতে তার সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। অথচ কিছুতেই এই সমস্যার কূলকিনারা করতে পারছেন না তিনি। জীবন ও ক্ষমতা দুটোরই প্রায় শেষ সীমানায় পৌঁছে যে এমন এক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তাকে কখনো ভাবেননি তিনি। নিজের অফিসের ডেস্কে বসে বিমর্ষভাবে এসবই ভাবছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
- স্যার, মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাকিয়ে দেখলেন তার একান্ত সচিব শহীদুল ইসলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মনে পড়লো স্বাস্থ্যমন্ত্রী সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। লোকটা যদিও নিজে চিকিৎসক নয়। কিন্তু বর্তমান দুর্যোগটা স্বাস্থ্যগত বিধায় তাকেই ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি।
- হুম পাঠিয়ে দিন, বিমর্ষ কণ্ঠেই জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হক ভেতরে ঢুকেই সালাম দিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী সালামের জবাব দিলেন না। আগের মতোই বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, ‘বসুন’। নাজিমুদ্দিন সাহেব বসলেন। তিনি জানেন প্রধানমন্ত্রী তাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মতো তিনি নিজেও এই সমস্যাটা নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলে কি হবে! তিনি তো আর চিকিৎসক না। চিকিৎসক না হয়েও মিডিয়াতে, দেশবাসীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বড় বড় ফাঁপড় মারা যায়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সামনে তো আর সেসব বলা যায় না। তাই এক ধরণের আতঙ্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন নাজিমুদ্দিন সাহেব।
- নাজিমুদ্দিন সাহেব, আপনাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি আপনি জানেন?
- জ্বী স্যার, মানে স্যার আপনি যেটুকু বলেছেন স্যার সেটুকুই জানি
- হুম
প্রধানমন্ত্রী চুপ করে যান। নাজিমুদ্দিন সাহেব বুঝতে পারেন না এই নীরবতার মানে কি! প্রধানমন্ত্রী কি তার মুখ থেকেই কিছু শুনতে চাইছেন? কিন্তু এমন সংকটময় মুহুর্তে নিজ দায়িত্বে কিছু বলা মানে বিপদ ডেকে আনা। নাজিমুদ্দিন সাহেব তাই চুপ থাকেন।
- নাজিমুদ্দিন সাহেব, আমরা তো অনেক চেষ্টাই করলাম কিন্তু এই সমস্যার তো সমাধান সম্ভব হচ্ছে না
- জ্বী স্যার
- আজ সন্ধ্যা থেকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হতে যাচ্ছে, এটা তো জানেন তাই না?
- জ্বী স্যার
- সে হিসেবে কাল থেকে কাগজে কলমে আমার আর কোন ক্ষমতা থাকছে না
- জ্বী স্যার
- কিন্তু দেখুন দায়িত্ব তো আসলে আমাদেরই পালন করতে হবে
- জ্বী স্যার
- আপনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আর এটি একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যাই বৈকি। তাই আপনাকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দিতে আজ আমি ডেকে এনেছি
- জ্বী স্যার
মুখে ‘জ্বী স্যার’ বলেন ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত বোধ করেন নাজিমুদ্দিন। ভেতরের অনুভূতি যাই থাকুক, প্রধানমন্ত্রীর সকল কথায় 'জ্বী স্যার' বলে যাওয়াটাই এখানে নিয়ম। যতো বেশি জ্বী স্যার, ততো বেশি উন্নতি।
- নাজিমুদ্দিন সাহেব, এই ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে যা ঘটছে তা আসলে কেন ঘটছে, কি তার গতিপ্রকৃতি। সেই লক্ষ্যেই দেশের সব ধরণের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবচেয়ে তুখোড় ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের নিয়ে একটি গোপন টিম তৈরি করা হয়েছে যারা এই ঘটনার শুরু থেকে পর্যায়ক্রমিক সবকিছু বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করবে এর প্রকৃত রহস্য। এছাড়া এই টিমে আমাদের দেশ সেরা বৈজ্ঞানিকরাও থাকছেন।
- জ্বী স্যার
- স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনি এই টিমের মডারেটর হিসেবে থাকবেন। আপনার কাজ হবে এদের নিয়মিত কাজ তদারকি করা। এই টিম নিয়মিত আপনাকে রিপোর্ট করবে আর আপনি আমাকে রিপোর্ট করবেন
- জ্বী স্যার
- সমস্যার কারণ খুঁজে বের করতে পারলে আশা করি আমরা এর সমাধানও খুঁজে বের করতে পারবো এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে আবারো এই সরকার তার পূর্ণ ক্ষমতাবলে ফিরতে পারবে
- জ্বী স্যার
- আপনি বুঝতে পারছেন আশা করি আপনার দায়িত্বটুকু
- জ্বী স্যার
- ঠিক আছে, এবার আপনি আসতে পারেন। আমাদের এই টিমের চিফ কোওর্ডিনেটর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রোকন মাহমুদ শীঘ্রই আপনার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করবেন।
- জ্বী স্যার
প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বের হয়ে আসেন নাজিমুদ্দিন সাহেব। তার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়। একইসাথে বিষ্মিত এবং আতঙ্কিত বোধ করেন তিনি। নাজিমুদ্দিন বুঝতে পারছেন না তার আসলে আনন্দিত হওয়া উচিত নাকি শঙ্কিত! সেই ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে আজ ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবন তার। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আইনসভার সদস্য তিনি, আর মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন প্রথমবারের মতো। ব্যবসায় প্রশাসন থেকে পড়াশোনা করেও কালক্রমে হয়ে গিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী! এই যে কয়েক মাস আগে দেশে এতো বড় মহামারী গেল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তার সেখানে অনেক দায়িত্ব ছিল। অথচ নাজিমুদ্দিন সাহেব কোন দায়িত্বই ঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। উল্টো সব মিলিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা করেছেন। সাংবাদিকেরা তাকে নিয়ে অনেক ট্রল করেছে, দেশের মানুষ অনেক সমালোচনা করেছে। অন্য যেকোনো দেশ হলে তাকে পদত্যাগ করতে হতো। কিন্তু এই দেশে সেটার প্রয়োজন হয় না। এখানে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে এসব সমালোচনা গায়ে মাখতে হয় না। ওসব বোধটোধ যা আছে সেগুলো বাদ দিতে পারলেই এখানে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব। তাই দায়িত্ব পালন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে হয় না এখানে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। যদি সফলভাবে কাজটা করতে পারেন তাহলে কেল্লাফতে- পরের টার্মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসনটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু যদি কিছু উলটাপালটা হয় তাহলে কি হবে সেটা ভাবতেই আতঙ্কিত বোধ করেন নাজিমুদ্দিন। থাক, আপাতত ব্যর্থতার কথা ভাবতে চান না তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে উঠেন নাজিমুদ্দিন। এই প্রথম নিজের কোন দায়িত্ব নিয়ে ভীষণ চিন্তিত তিনি।
পাঁচ
সত্যি এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে কেউ ভেবেছিল কখনো? তিন মাস, মাত্র তিন মাসে সব কেমন উলটপালট হয়ে গেলো! নাজিমুদ্দিন সাহেব ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে থাকলেন আরো কিছুক্ষণ। দখিনা বারান্দার এতো বাতাসেও তার গরম লাগছে। এতো রাত অব্দি জেগে থাকায় প্রেশারটা বোধহয় বেড়েছে। ওষুধও খাননি আজ। সেই কখন থেকে কেবল পায়চারি করে যাচ্ছেন। ঘুমানো দরকার জানেন তিনি, কিন্তু আজ সন্ধ্যার এই মিটিং এর পর কেমন করে ঘুমাতে যাবেন তিনি? এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে দেশের অন্য সকল মানুষের মতো তিনি নিজেও সন্দিহান ছিলেন। তারও ধারণা ছিল সিনেমার মতোই এদেশের সকল বাহিনীর কাজ একটাই, সব শেষ হবার পর উপস্থিত হয়ে 'আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না' বলে ডায়লগ দেওয়া। কিন্তু তাদেরও যে এতো ইন্টেলিজেন্স আছে, এতো চৌকস অফিসার্স আছে, এতো আধুনিক ইকুইপমেন্টস আছে তিনি নিজেও জানতেন না। নইলে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দেয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশের এতো বড় এবং অভূতপূর্ব সমস্যার কারণ তারা খুঁজে বের করে ফেললো! নাজিমুদ্দিন সাহেব বুঝতে পারেন আসলে চাইলেই এদের দিয়েই দেশের যেকোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা আর নির্দেশনার।
নাজিমুদ্দিন সাহেব আবারো ঘড়ি দেখেন, ৩টা ৫২। রোকন মাহমুদ সাহেব কয়টায় এসেছিলেন? সাড়ে ৭টার দিকে হয়তো। ঐ সময়টাতেই সন্ধ্যার চা-নাস্তা খান নাজিমুদ্দিন। আজও তাই করছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রোকন মাহমুদ অবশ্য তার ঘন্টাখানেক আগেই ফোন করে জানিয়েছিলেন খুব ইমার্জেন্সি দরকার তাই আজকেই দেখা করতে চান তিনি। নাজিমুদ্দিন সাহেব সাধারণত বাসায় এরকম কারো সাথে দেখা করা পছন্দ করেন না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে জরুরি অবস্থা চলছে। তাছাড়া এই টিমের কথা জনসাধারণের কাছে একেবারেই গোপন রাখা হয়েছে। সবাই জানে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করছে অন্য একটি টিম। তাই চাইলেই যেকোনো জায়গায় বসেই রোকন মাহমুদ এর সাথে দেখা করা যায় না। মিডিয়া জানতে পারলে সমস্যা আছে। গত দুই সপ্তাহে আরো ১৯ জন মারা গেছে একইভাবে। দেশের পরিস্থিতি দিনদিন খারাপ হচ্ছে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে অথবা বহিঃশক্তির আক্রমণ হতে আর বেশিদিন লাগবে না। রোকন মাহমুদকে তাই না করতে পারেননি নাজিমুদ্দিন। ডাইনিংয়ে বসে চা খেতে খেতেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনলেন নাজিমুদ্দিন। বাসায় তখনও কাজের লোকেরা ছিল। নাসিরই দরজা খুলে দিলো। ফিরে এসে জানালো রোকন মাহমুদ সাহেব এসেছেন দেখা করতে, ড্রয়িংরুমে বসেছেন। 'বলো আসছি' বলে নাজিমুদ্দিন সাহেব আবারো চায়ে চুমুক দিলেন। পাশের চেয়ারে স্ত্রী আফিয়া চৌধুরী বসেছিলেন, বাড়িতে থাকলে সন্ধ্যার চা-টা এখনো তারা একসাথেই খান। ছেলেমেয়েরা তো সবই বিদেশে। তারা নিজেরাও ব্যস্ত থাকেন- নাজিমুদ্দিন সাহেব রাজনীতি নিয়ে আর আফিয়া চৌধুরী তার ব্যবসা নিয়ে। নিজেদের প্রয়োজনীয় কথাগুলো তাই তারা চায়ের টেবিলেই বলেন।
- ওনি কি বসবেন কিছুক্ষণ? শেফালীকে বলবো চা-নাস্তা দিতে?- বাড়িতে এবারই প্রথম এমন কেউ এলো তাই আফিয়ার উৎসুক প্রশ্ন
- কি জানি! বুঝতে পারছি না তো, দেও কিছু চা-টা
- আচ্ছা বলছি
আফিয়া চৌধুরী উঠে গেলেন, নাজিমুদ্দিনও চাটুকু শেষ করে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালেন।
- স্লামালিকুম স্যার- সালাম দিয়ে নাজিমুদ্দিনের বসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন রোকন মাহমুদ
- ওয়ালাইকুম সালাম, বসুন
নাজিমুদ্দিন সাহেবকে বসতে দেখে রোকন মাহমুদও বসলেন।
- স্যরি স্যার এতো সংক্্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আপনার সাথে দেখা করতে চাইলাম। আসলে স্যার সিচুয়েশনটাই খুব ইমার্জেন্সি
- না ঠিক আছে, বলুন কি অবস্থা আপনাদের কাজের
- স্যার আমাদের সব ইন্টেলিজেন্স অফিসাররা মিলে দেশের চলমান সমস্যার সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করতে পেরেছেন
- কী! সত্যি!- নাজিমুদ্দিন সাহেব এর চোখ চকচক করে উঠে। তার সামনে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবার লোভনীয় স্বপ্ন!
- জ্বী স্যার, যদিও কারণটা কিছুটা অদ্ভুত এবং প্রথম শুনলে কিছুটা উদ্ভটও মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমস্ত গবেষণা, তদন্ত সবকিছুই এটার দিকেই ইঙ্গিত করছে
- হুম, বলুন, আমি শুনছি - স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীত্বের হাতছানির লোভ সামলে কণ্ঠে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে উত্তর দেন নাজিমুদ্দিন
- স্যার এখানে বসেই বলবো? মানে এটা খুব হাইলি কনফিডেনসিয়াল ইনফরমেশন, যদি আপনার স্টাডিরুম বা একান্ত ব্যক্তিগত রুমে বসে কথা বলা যায় তাহলে ভালো হয়।
নাজিমুদ্দিন সাহেব একটু বিব্রত হন। তার কোন স্টাডিরুম নেই। সেই কবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে এসেছেন, তারপর থেকে তো রাজনীতি নিয়েই আছেন। রাজনীতিতে আর পড়াশোনার কি দরকার! তাই স্টাডিরুম করার কথা কখনো ভাবেননি তিনি। রোকন মাহমুদকে কি তিনি বেডরুমে নিয়ে যাবেন? সেটা কি ঠিক হবে? এজন্যই ছাতার মাথা তিনি বাসায় কাউকে দেখা করতে আসতে বলেন না। কিন্তু এই লোক এখন দেশের সবচেয়ে বড় সংকট সমাধানের প্রধান ব্যক্তি, আর এই সংকট সমাধান মানেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীত্ব নিশ্চিত। নাজিমুদ্দিন সাহেব একটু দোটানায় পড়ে যান।
- আপনি এখানেই বলুন, কোন সমস্যা নেই। আমার বাসায় তেমন কেউ নেই
- ওকে স্যার- চারপাশে তাকিয়ে ঠিক সন্তুষ্ট হতে না পারলেও নাজিমুদ্দিনের কথা মেনে নিলেন রোকন মাহমুদ
রোকন মাহমুদ যখন কথাগুলো বলে শেষ করলেন নাজিমুদ্দিন সাহেব তখনও বুঝতে পারছেন না ওনি ঠিক শুনেছেন নাকি ভুল। এটাও কি সম্ভব? নিজের অবিশ্বাস কাটাতেই হোক আর যাই হোক নাজিমুদ্দিন আরেকবার বললেন 'আর ইউ শিউর?' এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো একই প্রশ্ন করেছেন নাজিমুদ্দিন, তবু রোকন মাহমুদ ধৈর্য সহকারে উত্তর দিলেন, 'ইয়েস স্যার। আমাদের সব ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট এখানে আছে ডিটেইলস সহ। আপনি দেখতে পারেন'। রোকন মাহমুদ এর বাড়িয়ে দেয়া ফাইলটা হাত বাড়িয়ে নেন নাজিমুদ্দিন। কিন্তু ফাইলের ভেতর না তাকিয়ে আবারো রোকন মাহমুদ এর দিকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি।
- সবগুলো কেসেই একই ঘটনা?
- জ্বী স্যার
নাজিমুদ্দিন সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না কি বলবেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রোকন মাহমুদ একাই বলে যান।
- স্যার প্রথম যিনি মারা যান বদরুজ্জামান সাহেব, তিনি মিহিরপুর পাওয়ার প্ল্যান্টের হাইয়ার অফিশিয়াল ছিলেন। ভালো স্যালারি পেতেন প্লাস আদার্স ইনকামও ছিল। ওনার বাসায় শুধু ওনি ওনার স্ত্রী আর ৬ বছরের এক সন্তান ছিল। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি এই গ্লোবাল প্যান্ডেমিকের সময় তিনি যে পরিমাণ জিনিস স্টক করেছিলেন তাতে ৫ জনের একটি পরিবার অনায়াসে ৩ মাস খেয়ে-পরে চলতে পারতো। এমনকি সামর্থ থাকা সত্ত্বে তিনি গরীব মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। বিল্ডিং এর অনেকের সাথে আমরা কথা বলে জেনেছি, বদরুজ্জামান এর কাছে ত্রাণের জন্য টাকা চাইতে গিয়েছিল অনেকে কিন্তু তিনি কোন সহায়তা করেননি। আর শুধু তাই নয় স্যার, লকডাউনে বাসায় বসে মেজাজ খারাপের অজুহাত দেখিয়ে তিনি প্রায়ই তার স্ত্রীকে নির্যাতন করতেন।
নাজিমুদ্দিন সাহেব চুপ করে থাকেন। এর মধ্যেই শেফালি এসে চা আর নাস্তা রেখে যায় টেবিলে। শেফালিকে ঢুকতে দেখে রোকন মাহমুদও চুপ থাকেন। শেফালি চলে গেলে আবারও বলতে শুরু করেন রোকন মাহমুদ।
- স্যার নেক্সট মারা যান ধনকুবের শফিকুর রহমান, আপনি তো চেনেন তাকে, নেফাল গ্রুপের চেয়ারম্যান। ইনফ্যাক্ট আপনার এই বিল্ডিংটাও ওনারই ডেভেলপিং ফার্মের করা। ওনিও এই প্যান্ডেমিকের সময় শ্রমিকদের সুরক্ষার কথা না ভেবে নিজের লাভের জন্য গার্মেন্টস খুলে দিয়েছেন। লকডাউনের মধ্যে পেটের দায়ে এই শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটেই চলে আসেন বিভিন্ন শহর থেকে। ওনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক, চাইলেই তিনি কারখানা বন্ধ রেখেও শ্রমিকদের বেতন দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি এই মানুষগুলোকে মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন।
- তারপরের কেস?- নির্লিপ্তভাবে জানতে চান নাজিমুদ্দিন
- মওলানা মুজাহিদুল ইসলাম, এই মহামারীর সময় মহামারী সংক্রান্ত হাদিস না শুনিয়ে তিনি ওয়াজ মাহফিল করে ঘোষণা দিয়েছিলেন এই রোগ শুধু বিধর্মীদের হবে। আর স্যার যারা ধর্মের নামে মিথ্যে বলেছিলেন যে তীর্থস্নান করলে এই রোগ সেরে যাবে কিংবা স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা না ভেবে যারা চার্চগুলোতে ইস্টার সানডের আয়োজন করেছিলেন তারাও কিন্তু পরবর্তীতে একইভাবে মারা গিয়েছেন।
- হুম
- পরবর্তী সবগুলো কেসেই এভাবে কোন না কোন কানেকশন আছেই স্যার। কোন ব্যবসায়ী মহামারীতে সিন্ডিকেট করে জিনিসের দাম বাড়িয়েছেন, কেউ নিজের সাময়িক আনন্দের জন্য স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঘুরে বেড়িয়েছেন ফলে অন্যদের অসুস্থ করেছেন, কেউ মহামারীতে সেবা দেয়া চিকিৎসকদের অভিবাদন না জানিয়ে উল্টো উৎখাত করতে চেয়েছেন, কোন গৃহকর্ত্রী এই মহামারীতে তার বাসায় আটকা পড়া গৃহকর্মীকে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছেন, কোন জনপ্রতিনিধি ত্রাণ চুরি করেছেন, তো কেউ আবার ভাইরাস সংক্রমণ টেস্ট করার নাম করে কারো বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ করেছে, কেউ তার অধীনস্হ কর্মীদের জীবিকার কথা চিন্তা না করে নিজে বিলাসিতায় মগ্ন থেকেছেন, কেউ পরিবারের প্রতি সহিংস হয়ে উঠেছেন, কেউ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছেন, কেউ ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, কেউ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে চ্যারিটি কাজ করা অনেকের সম্পর্কে নোংরা ও মিথ্যা কথা প্রচার করেছেন, কেউ ঘরে বসে থেকে স্রেফ বিনোদনের জন্য বিষ খাইয়ে পাখি মেরেছেন। মানে স্যার এই মহামারীর সময়ে যেই অন্যের কথা না ভেবে কেবল নিজের কথা ভেবেছে, ঐ দুর্যোগকালীন সময়ে অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার উপর অন্যায় করেছে, নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি তারই পরবর্তীতে এভাবে মৃত্যু হয়েছে।
- হুম
- আসলে স্যার প্রতি ১০০ বছরে যে এমন একটা গ্লোবাল প্যান্ডেমিক তৈরি হয় সেটা তো প্রকৃতির উপর আমাদের ক্রমাগত অত্যাচারের একটা প্রতিশোধ। প্রকৃতিতে টিকে থাকতে হলে আমাদের আরো মানবিক হওয়া প্রয়োজন। এমন সংকটময় মুহুর্তে আমাদের আরো মেরুদণ্ড সোজা করে মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু আমরা যারা সেটা করিনি, শিরদাঁড়া টানটান করে না দাঁড়িয়ে আরো নত হয়েছি লোভের কাছে, ক্রোধের কাছে, লিপ্সার কাছে, তাদের মেরুদণ্ডটাই ধ্বংস করে দিয়েছে প্রকৃতি।
নাজিমুদ্দিন সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে রোকন মাহমুদ আবারও বলতে শুরু করেন ।
- স্যার আমরা যখন বুঝতে পারি এই দুর্যোগের কারণ কি তখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব ইনফরমেশন চেক করে আমরা একটি তালিকা তৈরি করেছি যারা এই গ্লোবাল প্যান্ডেমিকের সময় বিভিন্নভাবে অমানবিক কার্যক্রম করেছেন এবং অন্যদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। স্যার আমি আপনাকে যখন ফোন করে দেখা করতে চাই তখন আমাদের সেই তালিকা অনুযায়ী নেক্সট যে দুজন মানুষ ছিলেন যারা এভাবে আক্রান্ত হতে পারেন তার মধ্যে একজন হচ্ছেন বিরোধীদলের মহাসচিব জনাব আনোয়ার হোসেন। মহামারীকালীন দেশের সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে, এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের সাথে যুগপৎ কার্যক্রমের কথা চিন্তা না করে তিনি নিজের আখের গোছাতে চেয়েছেন, বেশি বেশি মানুষ মারা গেলে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করা যাবে বলে তিনি মানুষের মৃত্যুতে উল্লসিত হয়েছেন।
রোকন মাহমুদ একটু বিরতি নিয়ে আবার বলেন,
- স্যার আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমি যখন আপনার বাসার নিচে আসি তখনই আমার কাছে একটি ফোন আসে। জনাব আনোয়ার হোসেন আর নেই, সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে চা খাওয়ার সময় একইভাবে তার মৃত্যু হয়।
- বলেন কি? আনোয়ার আর নেই!- আর চুপ থাকতে পারেন না নাজিমুদ্দিন
- জ্বী না স্যার। আমাদের এই তালিকায় নেক্সট আরেকজনের নাম আছে যিনি একইভাবে আক্রান্ত হতে পারেন
- কার নাম?
- স্যরি টু সে স্যার কিন্তু পরবর্তী নামটি আপনার
- আমার!!- নড়েচড়ে বসেন এবার নাজিমুদ্দিন।
- জ্বী স্যার, আমরা হিসেব করে দেখেছি বিগত এই মহামারীর সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনার কিছু দায়িত্ব ছিল। কিন্তু আপনি সেগুলো যথাযথভাবে পালন করেননি। পিপিই ছাড়া এই দুর্যোগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া ডাক্তারদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তবু তাদের পিপিইর ব্যবস্থা না করেই তাদেরকে সেবা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আপনাকে প্রশ্ন করা হলে আপনি পিপিইর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেছেন। পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে পিপিই তৈরি করা হয়েছে কিন্তু সেখানেও আপনি সময়ক্ষেপন করেছেন আপনার পছন্দের মানুষকে কন্ট্র্যাক্ট দেয়ার জন্য। আমাদের যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে সেবা দিয়েছেন তাদের নিরাপত্তা ও তাদের ন্যুনতম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা আপনি করতে পারেননি। শুধু তাই নয় স্যার, আপনি…
রোকন মাহমুদকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন নাজিমুদ্দিন। তিনি জানেন তিনি কি কি করেছেন। নতুন করে আর শুনতে চান না তিনি।
- রোকন সাহেব, আপনাদের এই তদন্ত রিপোর্ট এর কথা আর কে কে জানেন?
- স্যার আমাদের টিমের বাইরে আর কেউ এখনো জানেন না। আমার আপনাকে রিপোর্ট করার কথা তাই আমি আপনার কাছেই সবার আগে এসেছি। তাছাড়া এটা আপনারও লাইফ কনসার্নের বিষয় তাই আপনাকেই সবার আগে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেছি, যদিও এ থেকে বাঁচার কোন উপায় আমরা এখনো জানি না। আমাদের টিমে যেসব সায়েন্টিস্ট ও চিকিৎসক ছিলেন তারা এখনো দিনরাত গবেষণা করে যাচ্ছেন। মেরুদণ্ডী প্রাণী হঠাৎ অমেরুদণ্ডী হয়ে উঠলে তাকে কোন উপায়ে বাঁচানো সম্ভব কিনা সেটাই গবেষণা করে দেখছেন তারা। তবে হ্যাঁ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছি আমাদের ইনভেস্টিগেশন শেষ হয়েছে। তিনি বলেছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে আপনার সাথে কথা বলে তার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি চাইলে আমরা আগামীকাল সকালেই তার সঙ্গে দেখা করতে পারি।
নাজিমুদ্দিন সাহেব উঠে দাঁড়ান। ভেতরের দিকে চলে যেতে যেতে তিনি কেবল অস্ফুটে বলেন, 'রোকন সাহেব আপনি এবার আসুন'। রোকন মাহমুদ উঠে দাঁড়ান। কি যেন একটা বলতে যান কিন্তু কিছু না বলে তিনিও পা বাড়ান দরজার দিকে। টেবিলে দেয়া চা-নাস্তা ওভাবেই পড়ে থাকে।
ডাইনিংয়ে বসে প্রায় সবই শুনেছিলেন আফিয়া। না, সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করেননি তিনি। আধা ঘন্টার মধ্যেই প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে চলে গিয়েছিলেন নর্দার্নব্রিজে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে। বাসার কাজের লোকদের এরপর নিজেই বিদায় করে দেন নাজিমুদ্দিন। রাতের খাবার রান্না করাই ছিল। নিয়মমতো ১০টায় ডিনার সেরে ঠিকই ঢুকেছেন তিনি শোবার ঘরে। কিন্তু ঘুমাতে আর পারেননি। রোকন মাহমুদ এর বলে যাওয়া কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল কানে। আর সেসব কথা মনে পড়তে পড়তেই চায়না থেকে কিনে আনা পর্দা, লন্ডনের হান্টার ফ্যান, নেফাল গ্রুপের চেয়ারম্যান এর সাথে মিলে বস্তি পোড়ানো সব কথা মনে পড়ে যায় তার। ৫৭ বছর বয়সী নাজিমুদ্দিন ভেবেছিলেন জীবনে সুখভোগের নিদেনপক্ষে আরো ২০ বছর বাকি। কিন্তু প্রকৃতি যে এমন করেও প্রতিশোধ নিতে জানে কে জানতো! হঠাৎ করেই সেগুন কাঠের দরজা, বেলজিয়ামের আয়না, গোদরেজ আলমারি, রাশিয়ান ভদকা, দখিনা বারান্দা সবকিছুই কেমন বিস্বাদ লাগে তার!
আর একটু পরেই ভোরের আলো ফুটবে। সকাল হলেই কি রোকন মাহমুদ চলে যাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে? এই রিপোর্ট কি মিডিয়ায় চলে আসবে? নাজিমুদ্দিন সাহেব যদি অন্যদের মতো এভাবে নাও মারা যান তবু এই রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রকাশ পাওয়া মানে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এর করুণ পরিণতি। যে দম্ভে তিনি বেঁচে ছিলেন তার কিছুই আর থাকবে না। তবে কি দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতায় হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া সেই ব্রিটিশ মন্ত্রীর মতো তারও আত্মহত্যার সময় ঘনিয়ে এসেছে? বিছানার পাশের মেহগনি রঙের মিনি কেবিনেট এর ড্রয়ার খুলে নিজের লাইসেন্স করা রিভলবারটা হাতে তুলে নেন নাজিমুদ্দিন। চেক করে দেখে নেন সবগুলো গুলিই আছে ঠিকঠাক। দূরের মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে। আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। শেষবারের মতো ঘড়ি দেখেন তিনি, ৪টা ২১। রিভলবারটার দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে নিজের মাথায় ঠেকান নাজিমুদ্দিন। ঠিক সে সময় হঠাৎ করেই তিনি টের পান তার মেরুদণ্ডের গোড়ায় এক অদ্ভুত শিরশিরানি।