সে এক পাথর ছিল কেবলই লাবণ্য ধরে...
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০১৬, ১৩:০৮
হালকা জারুল বেগুনী রঙের শাড়িটা। তাঁতের। নবরূপার প্যাকেট। তেমন দামী শাড়ি না। তবু তো উপহার। আমার জন্মদিন বা এরকম কিছু না। তবু শাড়ি উপহার। আজকাল আত্নীয়-স্বজন বা রক্ত সম্পর্কীয়রা ঈদ বা পালাপার্বনে টাকা দিয়ে দেয়। বলে, পছন্দমতো কিনে নিও। প্রিয়জনের সাথে দোকানে গিয়ে একটা শাড়ি বা পোশাক কেনা সেসব এখন আর হয় না। মানুষ প্রয়োজন বোঝে, সৌন্দর্যটা তাই কবে থেকে উহ্য! আমার চোখের কোণে একটু বোকা বোকা জল জমে। জানতে চাই,
: হঠাৎ শাড়ি কেন বল্লরী?
বল্লরী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে চুপ করে থাকে। তবে একটা হাসি দেয় লাখ টাকা দামের হাসি। এতো সুন্দর মেয়েটা! আমি শুধু তাকিয়েই থাকি। কিন্তু আজ কপট রাগ দেখাই। বলি,
: বল শাড়ি কেন? খুব পয়সা হয়েছে আজকাল?
ও বলে,
: আরে ধুর প্রাইস ট্যাগ দেখো একহাজার পঞ্চাশ। এই কিনতে পয়সা হওয়া লাগে নাকি!
আমি বলি, তবু তো বল কেন দিলি?
ও বলে, বাইরে আসো বলতেছি। বলে বল্লরী। বলে,
: তুমি যে শৌণকের কথা শুনে খুব খুশী হলে এটা তার প্রতিদান। আমরা দুজন নবরূপায় গিয়ে কিনেছি।
শৌণক হলো ওর বয়ফ্রেন্ড। আসল নাম না কিন্তু, ছদ্ম নাম এটা। আমি নামটা এখানে বললাম না। ও বলল,
: আপা শৌণক খুব খুশি হয়েছে জানো? তুমি যে আমাদের মেনে নিয়েছো! আ্যট লিস্ট আমার দিকে চোখের কোণ দিয়ে তাকাওনি, তাতেই আমি খুশি।
আমার হঠাৎ এতো কষ্ট হতে থাকে ওর কথা শুনে। প্রেম-সে যে ধরনের প্রেমই হোক সম্ভবত একনলেজমেন্ট চায়। স্বীকৃতি চায়। আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই, স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে...
বল্লরী তো খুব বেশি পড়ালেখা করেনি, তাই ও হয়তো বুঝিয়ে বলতে পারছে না। আমি বুঝতে পারছি। ও বিবাহিত, এক সন্তানের জননী। ওর প্রেমে পড়াটা হলো, পরকীয়া। যে ছেলেটার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে বিবাহিত নয়। আরও অনেক ধরনের জটিলতা আছে। এই সম্পর্কটা বল্লরী আর ওর প্রেমিক জানে কি না জানি না, আমি কিন্তু জানি যে কখনই পৌঁছাবে না বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটা পর্যন্ত। কিন্তু আশেপাশের কারো না কারো স্বীকৃতি কেন ওরা চাইছে?
আমি একটু বোঝার চেষ্টা করি। সম্ভবত ওরা প্রথা ভাঙতে চাইছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা বল্লরী জানাতে চাইছে যে, সে কোন অন্যায় করছে না। আমার স্বীকৃতিতে ওদের এমন কিছু লাভ লোকসান হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন কারণেই আমি ওদের কোনরকম সহায়তা চাইলেও করতে পারবো না। কিন্তু তবুতো একটা স্বীকৃতি। যা কিছু শুভ, যা কিছু প্রাণ বিভোর করে তার স্বীকৃতি মানুষ চায়। মানুষের এ এক অদ্ভুত চাওয়া!
বল্লরী আরোও অনেক কথা বলে। আমরা দুজন আবারও কফি হাতে ডুবে যাই। ও বলে,
: জানো আপা, কাল আমার সপ্তর্ষির সাথে দেখা হলো। অনেকদিন পর।
: কে সপ্তর্ষি?
: আরে আমার বান্ধবীটা, চেনো তো তুমি। একদিন না আসলো অফিসে, তুমি চা খাওয়াইলা?
: ও হ্যাঁ ঐ যে বায়িং হাউজে কাজ করে, তোর স্কুল ফ্রেন্ড। তো কি হলো?
: ওকে আমি শৌণকের কথা বললাম, খুব রুড হলো জানো! বললো, এইসব ছাড়, এইসব এক্সট্রা মেরিটেরিয়াল অ্যাফেয়ার কখনও ভালো কিছু বয়ে আনে না, ঐ ছেলের ভবিষ্যত নষ্ট করিস না।
আমি চুপ করে থাকি। ও গড়গড় করে বলতেই থাকে,
: কি হয় জানো! আমার খুব যন্ত্রণা হলো। হাজবেন্ডের সাথে যেকোন সমস্যায় সপ্তর্ষির সাথে শেয়ার করতে পারি। আর এই ব্যাপারটা ও এতো সংকীর্ণভাবে নিলো! আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার সাথে প্রেমে পড়ার আনন্দটা, বিভোরতাটুকু আমি শেয়ার করতে পারলাম না! আমি একটা জিনিস বুঝে গেছি, তুমি যদি ডিভোর্সি হও অথবা বিধবা- লোকে তোমার জন্য খুব আহা উহু করবে। তোমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তুমি যদি আপাত: সুখের সংসারে থেকে কোন প্রেমে পড়ো, তাহলে তোমাকে সোসাইটি গ্রহণ করবে না। তোমাদের নারীবাদ অদ্ভুত একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে আপা। সংস্কারমুক্ত হওয়া, সবদিক থেকে সংস্কারমুক্ত হওয়া অত সহজ না! হাহ!
আমি হেসে বলি,
: বল্লরী, সুখের সংসারে থেকে তুমি কেন প্রেমে পড়বে বলোতো?
বল্লরী একটু বুঝি থমকায়। বলে,
: শোন সুখের সংসার নয়, আপাত: সুখ। মানুষের অপূর্ণতা ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাপের মতোই, কখন তোমাকে ঘাসের আড়াল থেকে উঠে ছোবল দেবে তুমি জানতেও পারবে না। আর সুখের সংসার কারে বলে?
আমার কাজ ছিল। তাই বল্লরীকে বেশি আর কথা বাড়াতে দিই না। বলি,
: এনিওয়ে তোর দেয়া শাড়িটা পড়ে ফেসবুকে দেবো, তোকে ট্যাগ করবো ভাবিস না।
একটু যেন আহত হয় সে। বলে,
: লাগবে না এসব।
তারপর একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে করে সেই অমোঘ উচ্চারণ,
: যারা একলা থাকে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা অনেকেই ভাবে, দুঃখে তাদের কাঁধে হাত রাখতে চায়। কিন্তু যারা দোকলা, তারা কোন মুখে বলবে আমিও একা! সবাই তাদের একাকীত্বকে ন্যাকামি আর ঢং বলে উড়িয়ে দেয় যে!
আমি উঠে পড়ি। সব অনুভবের সঙ্গী হওয়া যায় না!