জার্মানির ডায়েরি থেকে (পর্ব-১)

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:৫৭

দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর। দিন না বলে, বলা হোক রাত। ঠান্ডা বাতাসে জ্যাকেট আর মাফলারকে আরেকটু পেঁচিয়ে হাঁটা ধরেছি রুমের দিকে। রাত তখন আনুমানিক ১ টা। কোথা থেকে ফিরছিলাম ঠিক মনে নেই। জার্মানি এসেছি, দুই মাস হয়ে গেলো। কিন্তু ঠান্ডাটা এখনও ঠিক মানিয়ে উঠতে পারিনি। তবে রাতে রুমে ফেরাটা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি। 

এই দুই মাসে পায়ে হাঁটার এই রাস্তাটা বেশ চেনা হয়ে গেছে। এক পাশে গাছের সারি, যদিও এই শীতে তারা এখন আর গাছের অবয়বে নেই। বরং তাদের গাছের কঙ্কাল বলা যায়। পাতা সব ঝরে গিয়ে কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার অন্যপাশে ত্রিভুজাকৃতির ছাদের বাড়িগুলো একের পর এক সাজানো। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, একটা বাড়ি বানিয়ে সেটাকেই কপি করে করে সমান দূরত্ব বজায় রেখে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রথম প্রথম দেখে খুব মজা করে বলেছিলাম, এরা নিজেদের বাসা চিনে কীভাবে?

সত্যি বলতে, সব বাসারই নিজস্ব একটা ধরণ আছে, গন্ধ আছে। একই রকম দেখতে অথচ কী সহজে সমাজে তারা তাদের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে। বাসার বাইরে কারো ফুলবাগান, কারো বা দোলনা। কারও বা গৃহকর্তার উদাসীন রঙচটা উঠোন। তবে সবগুলো উঠোনই এখন কম বেশি ক্রিসমাসের সজ্জায় রঙিন। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দেখি এরা ক্রিসমাস নিয়ে মেতে উঠে। পুরো মাস জুড়ে ঘরের ছাদ নতুবা সীমানা প্রাচীর মরিচ বাতির আলোয় ঝলমল। দেখছি আর ভাবছি। ভাবতে ভাবতে প্রথম বেঞ্চটার কাছে চলে এলাম। বাসায় যাওয়ার পথে এই একটা বেঞ্চ। বেশিরভাগ সময় এখানে কেউ না কেউ উদাসভাবে বসে থাকে। 

হাঁটছি, পায়ে অসম্ভব ঠান্ডা লাগছে, দ্রুত হাঁটা দরকার। কিন্তু দ্রুত হাঁটতে গিয়ে মরা পাতায় পা হালকা স্লিপ খাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে মরা বাদামী পাতার সারি। আজ সারাদিনের বৃষ্টিতে পাতাগুলো ভিজে কেমন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। 

সেই মুহুর্তেই সুন্দর গন্ধটি ভেসে এলো। এই একটা বাসা যেখানে অদ্ভুত এক সুগন্ধ ভেসে আসে। দিনে ঠিক টের পাওয়া না গেলেও রাত হলে গন্ধটা মনে হয় গাঢ় হয়। এ বাড়িটা সাজসজ্জা সবার চেয়ে আলাদা। আলো জ্বলছে কিন্তু প্রাণ নেই তাতে। মনে হচ্ছে, কেউ নেই। হয়তো ছুটিতে কোথাও গেছে। এ বাসার কাছাকাছি এলেই আমি বুঝতে পারি, চলে এসেছি। আর এতটুকু পথ।

হঠাৎ মনে হলো উপর থেকে কী যেন পড়ছে। একটু খোলা জায়গায় এসে বোঝার চেষ্টা করলাম, ঠিক কী পড়ছে! একটি দুটি নয় অজস্র বালুকণার মতো, তুলোর মতো। শুধু এখানে নয়, যতদূর চোখ যায়, ততদূর। না তুলো নয়, তুলোর মত বরফ। সেই কবে থেকে বসে আছি, তুষার দেখবো। অবশেষে তুষার পড়া শুরু হয়েছে। উফ! আমি তো ভাবতেই পারছি না, অবশেষে তুষার পড়া সত্যিই শুরু হয়েছে। 

Its snowing! its snowing! বলে চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলা বসে গেছে। তাছাড়া দেয়াটাও ঠিক হবে না। দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছি। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। মনে হচ্ছে, প্রকৃতির কত রূপ। কত কিছু দেয়ার আছে তার। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত মেলে ভাবছি, অনেক দূর চলে এসেছি। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে। এত দূরে যে প্রিয় মানুষগুলোর ঘড়ি কাঁটা আমার সাথে মিলিয়ে চলে না। 

আস্তে আস্তে তুষার পড়ার বেগ বাড়ছে, সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস। রুমে চলে আসলাম। হিটার অন করে, জানালার শেডটা হালকা তুলে দিলাম। কম্বলটা নিয়ে চেয়ার টেনে জানালার পাশে বসে আছি। এ এক অদ্ভুত রাত! স্নো দেখার রাত। গ্লাসের বাইরে বৃষ্টির মতো তুষার পড়ছে।

খুব সকালে ঘুম ভাঙলো। সাদা হয়ে আছে সবুজ আঙ্গিনা, সেখানের ক্রিসমাস ট্রি, ঘরের সিড়ি, বাদামী ত্রিকোনা পড়শির ছাদ। বাসার সামনের হাঁটার পথ। সেই কবে থেকে বাগানে রাখা একটি পুরনো সাইকেল, তুষার জমছে তার সিটে। ঝকঝকে বরফের টুপি পড়ানো একটি ল্যান্ডস্কেপ দাঁড়িয়ে আছে জানালার ওপাশে। ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের পাতা! 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত