ছোটগল্প

অমানুষ এবং অর্ধমানুষ

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০১৮, ০০:৪৪

নয়নতারার মন ভীষণ রকমের খারাপ। সে পর্দা টেনে দুপুর ৩টায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ফ্যান ঘুরছে ফুলস্পিডে। তবু ঘামাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে, পানি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁথা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কারণ উঠলেই নয়নতারার মনে হয় এখনও তাকে কেউ দেখছে, খুব ভয়ংকরভাবে দেখছে। চোখ বন্ধ করে কাঁথার ভেতর শুয়ে থাকলে মনে হয় কেউ দেখছে না তাকে। কেউ না। এই জগতের কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। এটা শুধুই তার জগত। এই জগত অন্ধকার কিন্তু এই জগতে কুৎসিত কিছু নেই। কোনো বিভীষিকা জাগানো ভয় নেই। কোনো ব্যথা নেই। কোনো বিদঘুটে স্পর্শ নেই। এখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। নিষ্পাপ স্বচ্ছ এবং বিশুদ্ধ। গত দুইদিন ধরে তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র আশ্রয়স্থল এই বিছানা, কাঁথা মুড়ি দেয়া বিছানা।

“ও তারা, হুতি রইলি ক্যান, ভাত খাইতি ন? ও তারা, তারা” বলে নয়নতারার মা ঢুকে রুমে। নয়নতারার বিরক্ত লাগে, রাগ লাগে। মা কেন এসেছে এখন? ইচ্ছে করছে না কারো সামনে যেতে, কেউ দেখুক তাকে।

“কিরে, জ্বর আইসে নি, এই গরমে হুতি রইলি কেন কাতা দি। উডি ভাত খাই ল।”

মা চলে যায়, এখন তার দুপুরের ঘুমের সময়। নয়নতারা কাঁথা ফেলে উঠে। প্রচণ্ড গরমে সে ঘেমে ভিজে একাকার। গোসল করতে হবে। বাথরুমে ঢুকে কাপড় না খুলেই শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। সময় গড়িয়ে যায় কিন্তু সে মাথায় ক্রমাগত পানি পড়তে দেয়। সে জানে, মাথায় পানি বেশি দিলে তার জ্বর উঠে। জ্বর যদি তাকে আগামীকালের বীভৎসতা থেকে মুক্তি দিতে পারে!

শরীর বেয়ে পানি ধারা নেমে যায়। প্রতিটি অঙ্গে পানি তার স্পর্শ রেখে যায়। ইশ! কী নরম তুলতুলে শীতল অনুভূতি! কী আরামদায়ক! কী প্রশান্তি এই রঙহীন পানিতে! আহা! যদি আজীবন এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যেতো! যদি আজীবনই এমন স্পর্শই সে পেতো! আর কোনও স্পর্শ চায় না সে। আর এক রত্তি স্পর্শ চায় না সে।

ধুয়ে যায় শরীরের স্যাঁতসেঁতে ঘাম, সাদা ধুলা এবং কর্কশ স্পর্শ। ধুয়ে যায় শরীরে লেগে থাকা সকল নোংরা অনুভূতি। এক তিল পরিমাণ ময়লা খুঁজে পায় না নয়নতারা। নিজেকে শুভ্র মনে হয়। সুন্দর মনে হয়। চকচকে ঝকঝকে নতুন জন্মানো সবুজ পাতা মনে হয়।

গোসল শেষে মায়ের বকার ভয়ে সে খেতে বসে টেবিলে। সাদা ভাত নেড়ে চেড়ে ক্লান্ত হয়ে যায়। ক্ষুধার কোন বোধ অনুভব হয় না। শুধু পানিই খেতে ইচ্ছে করে। আর কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না। কিচ্ছু না কিচ্ছু না। থালা ঠেলে উঠে বারান্দায় বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নয়নতারা। প্রবলভাবে তীব্রভাবে। শরীরের তো ময়লা দূর হল, মনের এই কুৎসিত ময়লা দূর করবে কীভাবে! গত দুইদিনের ঘিনঘিনে স্মৃতি মুছে ফেলবে কীভাবে? শুধু কি দুইদিন? যদি আগামীকালও হয়? ভয়ে চোখের পানি থেমে যায়, ফুঁপানো বন্ধ হয়ে যায়, দমও বন্ধ হয়ে যায়। বিস্ফোরিত চোখে সে তাকিয়ে থাকে সামনে। যেন সামনে সে দেখতে পাচ্ছে সেই বীভৎস দৃশ্য। সেই নিদারুণ যন্ত্রণার চিত্র। কিছু করতে না পারার হাহাকার। ভেতরে ঘৃণায় অপমানে লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া। সে কী ভয়ংকর! সে কী ভয়ংকর!

“মা” বলে এক তীব্র চিৎকার দেয় নয়নতারা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, গড়াতে থাকে মাটিতে। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। ছুটে আসে মা।

“কিরে কী হইছে, তারা কী হইছে?” মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। নয়নতারার থরথর করে কাঁপা শরীর মা কোনমতেই থামাতে পারে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও নয়নতারার কাঁপন বন্ধ করতে পারে না। মা বুঝে পায় না কী হয়েছে তার মেয়ের।

জ্বরের ঘোরে নয়নতারা বিড়বিড় করে কী যেন বলে চললো সারারাত। কোন কথার মানে বুঝতে পারেনি তার মা। শুধু বুঝলো, “আমি যাবো না”। কোথায় যাবে না? কী হয়েছে তার মেয়ের? এমন করছে কেন? উদ্বিগ্ন মা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে নয়নতারা পাশে।

৩ দিন পর নয়নতারা সম্পূর্ণ সেরে উঠে জ্বর থেকে। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে স্কুলে। এই বন্ধের সময় পাশের গলিতে তাকে আরবি শেখার ক্লাস শুরু করতে হয়েছে। তাই প্রতিদিন ১১টায় হুজুরের কাছে যেতে হয় নয়নতারার। সাথে থাকে রূম্পা, তারই সমবয়সী। দুইদিন ধরে রূম্পা যাচ্ছে না কারণ সে নানুবাড়ি বেড়াতে গেছে। এই দুইদিন নয়নতারা একা একা পড়তে গিয়েছে। যাওয়ার সময় সে স্বাভাবিক ছিল, আসার সময় সে বধির এক জড়পদার্থ হয়ে ফেরত এসেছে।

কী এমন হয়েছে যার জন্য সে আর ওখানে যেতে চায় না? কী এমন ঘটনা যা সে তার মাকেও বলতে ভয় পায়, লজ্জা পায়? তবুও সে সংকোচ নিয়ে মাকে বলেই ফেলে “মা আমি আর ওখানে পড়তে যাব না।” সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মা বলে “কেন, যাইতি না কিল্লাই, আরাবি শিখতে হইত ন? ফাঁকিবাজি করন চইলত ন, স্কুল শুরু হই গেলে আর যাইতি হাইত্তি ন। ওন এক্কানা কষ্ট করি যা।”

বলতে চায়, খুব করে বলতে চায় “মা ওখানে আমার ভাল লাগে না, আমার অসহ্য লাগে, ভয় লাগে, লজ্জা লাগে, অপমান লাগে। মা, আমার ব্যাথা লাগে।”

বলতে পারে না। গলা পর্যন্ত উঠে স্বর থেমে যায়। থমথমে চোখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে কাপড় বদলিয়ে বের হয়ে যায়। সেই নোংরা পথে। অন্ধকার পথে। ভয়ের পথে। পা চলতে চায় না, তবু তাকে টেনে নিয়ে যায়। খুব শক্ত করে বুকের কাছে বই দুইটা চেপে রাখে, যেন এই বই দুটো তাকে আগলে রেখেছে। যেন এই বই যত সে শক্ত করে ধরবে ততই তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কেউ না।

দরজায় সামনে এসে নয়নতারা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। মাথা না তুলেই সে পড়ার রুমে ঢুকে চুপ করে বসে পড়ে। বই নামাছে না টেবিলে। সেই একই রকম শক্ত করে ধরেই আছে।

“এসেছ?”

ধক করে উঠে নয়নতারার বুক। তীব্রভাবে উঠানামা করে। আরও শক্ত, আরও মজবুত করে সে বই চেপে রাখে বুকে।

তার হুজুর সামনের চেয়ারে বসে “বই নামাও, বই বুকে রাখলে পড়বে কীভাবে? দেখি নামাও, টেবিলে রাখো”

না টেবিলে সে নামাবে না। কিছুতেই না।

হুজুর হাত বাড়ায়। বইয়ের কোনা ধরে টানে। “আরে তুমি দেখি ভয় পেয়ে গেছো, ভয় পেয়ো না, তুমি চুপ করে থাকবে শুধু। কিচ্ছু হবে না। আসো, আমার কাছে আসো, একটু আদর করে দেই আসো”।

নয়নতারা কাঁপতে থাকে। প্রচণ্ড ভয়ে সে চোখ বুজে নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে ফেলতে চায়। যেন এই দৃশ্যে সে কোন পাত্রী না, যেন এই দৃশ্য মিথ্যা, এখানে সে নেই, তার সামনে কেউ নেই।

“দেখি বই রাখো, দেখি দেখি” বলতে বলতে বইয়ের কোনা থেকে হাত ধীরে ধীরে সরে নয়নতারার বুকে লাগে।

“আসো, দেখি এদিকে তাকাও না। আরে এত ভয়ের কি আছে? আসো”।

নয়নতারা কেঁদে ফেলে। হাউমাউ করে কাঁদে। শক্ত হাতের চাপে সে তীব্র ব্যথা পায়। সইতে পারে না। চিৎকার দিয়ে উঠে। “আম্মু” বলে গগনবিদারী চিৎকার দেয়। সাথে সাথে হুজুর তাকে ঝাপটে ধরে। মুখে হাত রেখে চেপে ধরে। “এই চুপ চুপ” খবরদার খবরদার, একদম চুপ।”

কিন্তু নয়নতারা থামে না, যতটা সম্ভব সে চিৎকার করেই যায়। ভারী হাতের থাবা ভেদ করে আওয়াজ বের হচ্ছে কিনা সে জানে না। কিন্তু তাকে চিৎকার দিতেই হবে। চিৎকার ছাড়া সে কিছু জানে না, এই চিৎকার তাকে ভুলিয়ে রাখছে কী ঘটছে তার সাথে। হুজুর তাকে চেপে ধরে কিছু করতে চাইছে। কিছু দিয়ে চাপতে চাইছে। ধস্তাধস্তিতে বই পড়ে গেছে, সেখানে এখন তীব্র ব্যথা। তাঁর শক্তিহীন হাত দিয়ে সে কোনোমতে সেই লোমশ ভয়ংকার হাত বুক থেকে সরাতে পারছে না।

পারছে না সে আর সইতে। রুমটা ঘুরছে। এদিক ওদিক দুলছে। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে সকল কিছু। কোথাও যেন ঝগড়া হচ্ছে। কে যেন কার সাথে ঝগড়া করছে। কে যেন বলছে “তোমরা না দিলে আমরা খাবো কী? দাও দেখি ৫০০ টা টাকা দাও। দাও তো লক্ষ্মী”।

“যা যা এখান থেকে যা, তোরা প্রতি মাসে মাসে এসে বড্ড জ্বালাস”।

“আহ মরণ! দে না, এমন করস ক্যান”।

নয়নতারা এসব শুনছে, কানে যাচ্ছে প্রতিটি শব্দ। তারা কারা জানে না। শুধু বুঝতে পারছে এই আওয়াজ অনেক কাছ থেকে আসছে। যদি তারা শুনতে পায় তার আর্তনাদ! যদি কোনমতে তাদের কানে পৌঁছানো যায় তার আহাজারি!

ভারী শরীরের ভার আর না নিতে পেরে শেষবার নিজের সব শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড ভীষণ এক কামড় বসিয়ে দিলো হুজুরের হাতে। হাত সরে গেলো ব্যথায় আর তারস্বরে গলা ফাটিয়ে চিৎকারে নয়নতারার নিজের কানের পর্দাও যেন ফেটে গেলো। এই শেষ চিৎকার, আর শক্তি নেই তার। আর জেগে থাকার তিল পরিমাণ শক্তি নেই তার।

নয়নতারা বেহুঁশ হয়ে যায়। দরজায় ভীষণ রকমের ধুপধাপ হতে থাকে। হুজুর ভয়ে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। সে বুঝে পাচ্ছে না কী করবে! পালাবে? কিন্তু কোথায় পালাবে, কীভাবে পালাবে? ভয়ে, তীব্র ভয়ে হুজুরের হাত পা যেন মাটির সাথে শক্ত হয়ে লেগে যায়। তার যে পালানোর চেষ্টা করা উচিত সেটাও সে ভুলে যায়। দরজা এক সময় খুলে যায়। এক দল বৃহন্নলা সমাজের ভাষায় যারা হিজড়া ঢুকে ঘরে।

“ওই হারামজাদা কী করস তুই এই মাইয়ারে লই?” এলোমেলো কাপড়ের নয়নতারাকে দেখে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না কী হতে যাচ্ছিল এই বদ্ধরুমে।

“আপা দেখেন মাইয়াটার হুশ নাই, ভাগ্যিস আমরা টাইমমত চিৎকার শুনতে পারছিলাম।”

“হারামি, এই ধর ওরে, মাইর লাগা।”

কয়েকজন হিজড়া মিলে হুজুরকে মারতে যায়, জড়ো হয় আরও মানুষ। ভয়ার্ত হুজুরের চোখ দিয়ে যেন প্রাণটাই বের হয়ে যাবে!

হিজড়া দল যাকে বড় আপা ডাকে তিনি নয়নতারার মাথায় মুখে পানি দেন। নয়নতারা একবার চোখ মেলে, কিন্তু কিছু দেখার শক্তি তার নেই। সে আবার চোখ বুজে। সে ক্লান্ত ভীষণভাবে বিধ্বস্ত। তার ঘুম দরকার। অতলে তলিয়ে যাওয়ার মত ঘুম।

বড় আপা নয়নতারাকে কোলে নেয়। কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক তাকে ঢেকে বের হয়ে যান। একজন থেকে ঠিকানা নেন এবং হেঁটে চলেন নয়নতারার বাসার দিকে। নয়নতারা শান্তিতে ঘুমায় বড় আপার কাঁধে মাথা রেখে। আহা কি শান্তি পাচ্ছে নয়নতারা! কি আরাম সেই কাঁধে! না কোন ভয় না কোন সংশয়। এই কাঁধ যেন তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। নয়নতারা আঁকড়ে ধরে সেই কাঁধ। বড় আপা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কারও কোন কথার জবাব না দিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে বড় আপা হেঁটে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে। মেয়েকে তার মায়ের কোলে দিয়ে আসতে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত