গল্প

আ সুইসাইড নোট

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০১৬, ১১:৩৯

এ পৃথিবীতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষ কত কি-ই করে, কত খাটে প্রাণপন!

আমার এক বন্ধু আছে গান শোনা যার বেঁচে থাকার একমাত্র দাওয়াই। এদেশের মেয়ে সে ভালোবাসে আরেক দেশের সত্তর উর্ধ্ব এক বুড়ো শিল্পীকে। সে নিজে একলা মা। দুসন্তানকে নিয়ে নিজেও থাকেন আরেক বিভূঁই-এ।যে শিল্পীকে ভালোবাসেন তাকে নিয়েও সমাজ-সংসারের অভিযোগ আর বাঁকা ক্রুর হাসির অভাব নেই। সে শিল্পী হিন্দু থেকে মুসলমান হয় তো সমাজের একপক্ষ তাঁকে ছিঁড়ে ফেলে আরেক পক্ষ হয়তো বাহবা দ্যায়। সে নামের আগে এক সাধকের নাম লাগায়- তা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক। সে রাজনীতিতে নাম লেখায়- আবার শুরু হয় তাকে নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের মারামারি। তাঁর গান নিয়ে আলোচনার অত সময় নাই সমাজ-সংসারের, যতটা সময় আছে তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ নিয়ে। আমার বন্ধুটি কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে ভালোবেসে যান তাকে। গভীর, একনিষ্ঠ আর স্পষ্ট সে প্রেম! তার ভালোবাসার শক্তি দেখে আমি হতবাক। আমার মনে হয়, এই শিল্পী আর তার গানের প্রতি প্রেমের আড়ালে আসলে আমার বন্ধুটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন। ঐ গান তার বেঁচে ওঠার, বেঁচে থাকার দাওয়াই বৈ আর কিছু নয়।

আমার আরেক বন্ধু আছেন, নিজেকে বাঁচাতে যিনি পড়েন আর লেখেন। সর্বভূক পাঠক সে। রাস্তায় বোরখায় মুখ ঢাকা মহিলাদের বিলি করা লিফলেট থেকে বিশ্বসাহিত্য বা বিশ্বঅর্থনীতি বা বিশ্বরাজনীতি বা বিজ্ঞান বা নৃবিজ্ঞান-কোন কিছুই বাদ দেন না তিনি। দূর গোলার্ধে রাজনীতির পট পরিবর্তন হলে কিভাবে সে ঢেউ এসে লাগে আলগোছে বয়ে চলা বাংলার নদীতে অথবা মাটিতে সেসব জানতে তিনি উন্মুখ হয়ে থাকেন। আমারই মতো ঈশ্বরে অবিশ্বাসী তিনি। আর জীবনানন্দের বিখ্যাত হাহকার আছে তার। জোছনায় দ্যাখেন কোন ভূত... এইসব ঠেকাতে তিনি পড়েন। আর পাশাপাশি কিছুটা লেখেন। তিনি আসলে জানেন, এসব মূলত: অর্থহীন জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ব্যর্থ চেষ্টা। আর লেখেন তার কারণ হিসেবে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতো বলেন, লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যেসব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানানোর জন্যই লিখি। অর্থাৎ লেখক মানেই উপায়হীন লেখক। আমাকে তিনি বলেন, যখন খুব হতাশ হবেন তখন একদম অজানা, অচেনা কোন বিষয়ে পড়বেন। দেখবেন ভালো বোধ করছেন। বিদেশী কোন ভাষাও শিখতে পারেন। দেখবেন হতাশা কেটে যাচ্ছে। আমি বুঝি, নিজেকে বাঁচাতেই এই পড়া আর লেখার বর্ম তার। ইংরেজি “এসকেপ” শব্দটায় নিন্দাবাচক অর্থ জড়িয়ে থাকলেও ও বস্তু না করে মানুষের উপায় নেই!

আমি আরেকজনকে চিনি। খুব বেশিদূর আ্যকাডেমিক পড়া পড়েনি সে। ইংরেজি বা অন্যকোন ভাষা পড়তে বা লিখতে জানেন না। একটা মফস্বল শহরে সামান্য চাকরী করেন। কিন্তু জানা আর বুঝার তীব্র ক্ষিদে ছিল তার। তো এই ভদ্রলোক একসময় প্রেমে পড়ে গেলেন, কি বলবো কি বলবো, পূর্নেন্দু পত্রীর ভাষাতেই বলি-এক বিদ্যুৎ শিখার। সে কি সবকিছু তছনছ করা প্রেম! ভদ্রলোক তার অকিঞ্চিতকর জীবনের খোলনলচে পাল্টে ফেলার স্বপ্ন দেখেন সেই বিদ্যুতশিখার হাতে হাত রেখে। কিনতু যা হয়। সে মেয়ের প্রেম একসময় ফুরিয়ে যায়। সে যথারীতি ঝুলে পড়ে এক বড়লোকের গলায়। খুব স্পর্শ্যকাতর এই মানুষটি কঠিন এক অপমানের সময় পার করেন। মৃত্যুর চেয়েও শীতল আরেকটি জীবন দেখেন তিনি। কি করে তিনি আবার জীবনে ফেরেন জানেন? মুভি দেখে। সেসময় স্রেফ সিনেমাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। বিভিন্ন ভাষার শতশত মুভি তিনি বাড়িতে বসে ডিভিডি প্লেয়ারে দেখতে থাকেন। পর্দার অচেনা নানান জগত তাকে সেযাত্রা বাঁচিয়ে তোলে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কি দারুণ এক পথের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি।

আমি আরেকজনকে চিনি যার চোখ গভীর-শান্ত। যার শরীরের কাছে গেলে মন্দিরের ধূপের গন্ধ আর মসজিদের মার্বেল পাথরের জমিনের শীতলতা পাওয়া যায়। ভীষণ একলা মানুষ তিনি। নিজেকে এই পৃথিবীর ক্লেদ আর ক্লেশ থেকে বাঁচাতে যিনি ক্যামেরায় চোখ রাখেন। প্রায়ই চলে যান আশে-পাশের গ্রামে। ছবি তুলতে থাকেন, বিরামহীন। এই ফোটোগ্রাফির নেশাই নাকি তাকে বাঁচিয়ে রাখে।

আমি ভেবে দেখলাম, নিজেকে বাঁচানোর এইসব উপাদানের কোনটাই আমার সাথে যাচ্ছেনা আর। আমিও তো নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি নানাভাবে। ছবি আঁকতে চেয়েছি, গান বা কবিতায় নিজেকে ডুবাতে চেয়েছি, নাটক বা মুভি দেখতে চেয়েছি, বন পাহাড় আর সমুদ্রের কাছে গিয়েছি। কিংবা ধরুন আদেখলার মতো করছি শপিং, নিজেকে ভালোবাসার জন্য আরও কত কি করেছি ইতরের মতো। কিন্তু এখন বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এইবার তাই কুইট করতে চাই। পরিবার, প্রিয়জন আর স্বজন শুনছো তো সবাই? আমি কুইট করতে চাই। আমার সবই আছে কিন্তু ঐ যে “তবু সে জোছনায় দেখিলো কি ভুত...” আমি তবে যাই। এইযে নাজমুল, শুনছো তো আমি তবে যাচ্ছি। রাখি রায়, এবার তবে বিদায় দে। পয়েন্ট টু পিস্তল রেডি। একবার শুধু ট্রিগার টিপে দেওয়া। কোন কাব্যি-টাব্যি না, বিশেষ কোন হতাশা বা ন্যাকা ন্যাকা প্রেমের ব্যর্থতা না, আমার আসলে বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না আর। নো ম্যানস ল্যান্ড এ পেতে রাখা মাইনের উপর আটকে পড়া মানুষটির কথা মনে আছে তোমাদের? সে ভুল করে আটকে গিয়েছিল মাইন পাতা ট্রেঞ্চ-এ। নানাভাবে চেষ্টা করা হয় তাকে বাঁচাবার, কিন্তু ব্যর্থ সব চেষ্টা। সামান্য নড়াচড়াই যাকে নিয়ে যাবে অচেনা মৃত্যুর দরজায়। সে বাঁচতেই চায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব প্রচেষ্টাকারী যখন ফিরে যায় একে একে, লোকটির করুণ চিৎকার মিশে যায় সাত আসমানে। সিনেমাটার শেষ ওখানেই। যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা যে কত ধরনের হতে পারে তারই একটা খণ্ড ওই সিনেমাটা। আমি ভাবি, ওই লোকটির ওভাবে বেঁচে থাকার স্বাধ তো একসময় শেষ হবেই। তখন সামান্য নড়াচড়া করেই সে নিজেকে নিশ্চয়ই শেষ করে দেবে। এই আপাত সুন্দর পৃথিবীতে সাম হাউ আমারও নিজেকে ওই মাইন পাতা জমিতে আটকে পড়া মানুষটার মতো মনে হয়। হয়তো আমি ভয়ংকর অসুস্থ। হয়তো...কিন্তু আর ভালো লাগছে না সত্যিই।

তোমরা ভালো থেকো-তা বলছি না। আমি যখন থাকবো না তখন তোমরা ভালো থাকবে না খারাপ তা দিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। আমি তো জানি, আর কোন জন্মান্তর নেই। অবিশ্বাসী এই মানুষের বেঁচে থাকার সকল প্রয়োজন শেষ পর্যন্ত ফুরিয়েছে। শুভ বিদায় বন্ধু সকল।"

আফটার লাঞ্চ আমাকে একটা প্রেজেন্টেশন পাঠাতে হবে ডেনমার্কের হেড অফিসে। তার আগে সূপর্না, তনয় আর জাহানারার সাথে বসতে হবে মিটিং-এ। আক্ষরিক অর্থেই দম ফেলার সময় নেই। অথচ একটু আগে এই ফোন। নাজমুল জানালো, ওর ফ্ল্যাট নাকি খালি। আর একটা চিঠি চাপা দেওয়া টেবিলের উপর। ওদের একসাথে কি একটা এক্সিবিশন দেখতে যাওয়ার কথা ছিল বেজ গ্যালারিতে। নাজমুল ওর বাড়ি গিয়ে দেখে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ও ভিতরে নেই। আর চিঠিতে কিসব না কি লেখা। বাঁচতে ভালো লাগছে না, আই কুইট...ইত্যাদি ইত্যাদি। সেল ফোন বন্ধ। নাজমুল আমাকে বলল, তাড়াতাড়ি যেতে। আমি বজ্রাহতের মতো বসে আছি। কি করবো বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা কি সিরিয়াস না কি ওর খামখেয়ালীর অংশ আমি ধরত পারছি না। এরকম ঘটনা আগে সে ঘটায়ওনি। আমি যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিই। নিশ্চয় ওই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ আমার কাছে। সূপর্ণাকে ডেকে সব বুঝিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি। আমার হাত-পা কিছুটা কাঁপছে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে গিয়ে গাড়িটায় ঘষা খাওয়াই। দুদিন আগে মাত্র পোলিশ করিয়েছি। দারোয়ান একটু অবাক হয়। রোজই তো এই গ্যারেজ থেকে স্বচ্ছন্দে বের করছি গাড়ি, আজ কি হলো। কি হলো তা আমি জানি! টেনশন। কি হলো ওর? বাঁচতে ভালো লাগছে না মানে কি? মানুষ এতো ভালো-খারাপ চিন্তা করার সময় পায় কি করে? কদিন আগেই আমাদের এনজিও কাজ করেছে রানা প্লাজা ধ্বস নিয়ে। কয়েকজন ভিক্টিম এর সাথে কথা বলতে হয়েছিল আমাকে। কি বিভৎস, মুত্যুগন্ধী সব বর্ণনা। একজনের হাত, একজনের পা কেটে বের জীবিত বের করা হয়েছিল। কথা বলতে বলতে আঁতকে উঠছিল মানুষগুলো। বর্ণনাতীত ট্রমা। একজন বলল, শুধু বাঁচতে চাইছি, আর কিছু না...

আমি ইন্টারভিউ নিতে নিতে ভাবতাম, বেঁচে থাকার মতো আর্শ্চর্য্য সুন্দর আর কিছু আছে না কি? অথচ ও...কি হলো ওর? কেন মরতে চাইছে?

কি হয়েছে জানিনা, কিন্তু গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছি, আমি কি লালমাটিয়া থেকে বনানী পর্যন্ত আদৌ পৌঁছাতে পারবো না কি তার আগেই হার্ট ফেল করবো? নাজমুল বারবার ফোন করছে, রাখীও। আমি ফোন ধরার সাহস পাই না। আল্লাহ, আল্লাহ, সব যেন ঠিক থাকে, পুরোটা যেন ঠাট্টা হয়, আর কিছু চাইনা আমার..

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত